আই ও এন এপোলজি টু মাই ফ্যামিলি
রাজীবের মৃত্যুপরবর্তী ঘটনায় আমার এমনটাই মনে হয়েছিলো। আজ তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীর মৃত্যুর ঘটনা জেনে প্রয়োজনটুকু তীব্র মনে হলো।
কালির দাগ আর শুকনো রক্তের কালো দাগ আলাদা, কলমের আড়াআড়ি টানে কেটে দেওয়া বাক্য আর মানুষের গলা কেটে দেওয়ার ভেতরে তফাত অনেক কিন্তু কালি- কলম বাক্য আর বক্তব্যের জের ধরে মানুষকে কতল করে ফেলা উন্মাদনায় মেতে আছে আমার স্বদেশ এ সত্য বিশ্বাস করা কঠিন।
ব্যক্তিগত জীবনযাপনের উল্লাসে কিংবা আনন্দে নিজের মতো থাকতে চাওয়ার আগ্রহে তেমন পাত্তা দেওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে নি, নিজের ভালো থাকলে ক্ষতি করার কেউ নেই বিশ্বাসটাও গত কয়েক সপ্তাহে ভেঙে গেছে। ফাঁকা স্টেডিয়ামে সম্পূর্ন নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকার মতো অনুভুতি তৈরি হয়েছে এই সময়টাতে।
গণজাগরণের উল্লাসে অন্য সবার মতো মিশে যেতে পারার আনন্দ, দেশটাকে নতুন করে ভালোবাসার আনন্দের তীব্রতা ছিলো, মাদকতা ছিলো, সবাই মিলে ভীড়ের কোরাসে গলা মিলিয়ে " এমন দেশটি কোথাও খঁজে পাবে না কো তুমি সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি" উচ্চারণে বুকের ভেতরে আনন্দের ক্ষরণ আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে।
আমাদের দাবি দেশকে লাঞ্চনা অবমাননা মুক্ত করার দাবি, আমাদের দাবি ন্যায় বিচারের দাবি, আমাদের দাবি একাত্তরের চেতনার বাংলাদেশ নির্মানের দাবি, অথচ রাজীবের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু স্পষ্ট করে দিলো ঘাতকের দল সংঘবদ্ধ, তারা নিজেদের পরিকল্পনায় এমন সংঘবদ্ধ হয়েই বেছে বেছে মানুষ খুন করবে। গণজাগরণ আমাদের যতটা শক্তিশালী করেছে, তাদের ততটাই আতংকিত করেছে, আতংকিত মানুষ নির্দ্বিধায় শোভন মুখোশ খুলে তাদের হিংস্র নখর নিয়েই হত্যাযজ্ঞে ঝাপিয়ে পরবে। নিজেদের ভেতরের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে, আস্তিক-নাস্তিক-মতাদর্শিক বিভেদ ভুলে গিয়ে শুধু দেশপ্রেমিক এবং দেশবিরোধী মানুষদের ভেতরের তফাতটুকু স্পষ্ট বুঝে লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
তারা তালিকা বানিয়েছে, সে তালিকায় কারা আছেন কারা নেই আমি জানি না, কিন্তু নিশ্চিত জানি তালিকায় যারা আছে তাদের সবার হৃদয়ে দেশপ্রেমের টলটলে স্রোত বইছে, তাদের ধর্মবিশ্বাস যেমনই হোক না কেনো তারা বাংলাদেশকে অন্য সবকিছুর চেয়ে বড় ভাবে, এই ভালোবাসার প্রতি তীব্র আক্রোশে তাদের নামে মৃত্যু পরোয়ানা পাঠাবে ওরা।
আমি কিংবা আমরা তাদের চিনি না, তারা আমাদের আশেপাশেই আছে, আমাদের দেশপ্রেমের পরিমাণ বুঝে তারা টালি খাতায় লিখে রাখছে, ভাবছে এভাবেই ওরা আমাদের হত্যা করে জিতে যাবে পুনরায়, ৭১ এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে।
প্রতিবার নিহত কিশোরের ছবি দেখে অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছি, আমরা তার কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি নি, নারায়নগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রাফিউর রাব্বির ব্যক্তিগত ক্ষতির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের কোনো ভাষা নেই আমার। শোকের স্তব্ধতার ভেতরে এক ধরণের অশান্ত ক্রোধ তৈরি হচ্ছে।
স্পষ্ট করেই আমরা তোমরার বিভাজন রেখা টেনে দিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি তাদের আক্রমণের ধরণ বদলায় নি, পিতার কর্মকান্ডে পুত্রকে, পুত্রের কর্মকান্ডে পিতাকে হত্যা করে যারা ১৯৭১ এ ৩০ লক্ষ মানুষের লাশের স্তুপ জমিয়েছিলো তাদের নির্মম বর্বরতার বিচার চাওয়ায় তারা পুনরায় একই কায়দায় মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
এক দিক দিয়া ভাবলে যারা গণজাগরণ মঞ্চকে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে, যারা এগিয়ে এসেছে তাদের সবারই নিশ্চিন্ত ঘরে ফেরার দিন শেষ, তাদের পেছনে মৃত্যুর ফেউ ঘুরছে।
মৃত্যু যখন ঘরের দুয়ারে হানা দেয় আমি সতর্ক হতে চাই, বাসায় ঢোকার আগে গলির দিকে তাকিয় নিশ্চিত হই কেউ পেছনে আসে নি, পিঠ শিরশির করে প্রতিটা বাঁক ঘুরলেই, এক ধরণের অসস্তি তাড়া করে
এইটা একটা লড়াই যে লড়াইয়ে আমি পরিবারকে আলাদা রাখতে চাই কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। আগের মতো আমিও রিকশায় হুড ফেলে বৌ-সন্তান নিয়েযেতে চাই বৈশাখী মেলায় যেতে চাই প্রভাতফেরীতে আর বিজয় উৎসবে। কিন্তু এখন প্রতিকূল সময়ে আমি চাই না তারা আমার সাথে থাকুক, এ লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত, বিজয় সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত, যতক্ষণ প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয় আমি ওদের সাথে নিয়ে বাইরে যেতে চাই না। আমি তাদের সাথে দুরত্ব নির্মাণ করতে চাই।
প্রতি মুহূর্তে স্ত্রী পরিবারের সাথে বাইরে থাকার সময় অহেতুক আশংকা আর চাপ নিয়ে বসবাস আমার পছন্দ না। যদি দেশকে ভালোবাসার অপরাধে আমার উপরে কোনো আঘাত আসে আমি চাই আঘাতটা আমার উপর দিয়ে যাক। স্বার্থপর মানুষের মত নিজের পরিবারের সদস্যদের এই আঘাত থেকে সুরে রাখতে চাই।
আমার স্ত্রী হয়তো বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ, হয়তো অসন্তুষ্ট কিন্তু ঘরে ফিরতে দেরী হলে সেও উদ্বিগ্ন হয়, আমি বিরক্ত হই এই অহেতুক উদ্বেগে, জানি যদি আঘাত আসেই সেটাকে এড়ানোর সামর্থ আমার নেই। বরং আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সচেতন ভাবে আঘাত এড়িয়ে যেতে হবে।
তার এই উদ্বেগ আতংক এক ধরণের স্পষ্ট ক্রোধে প্রকাশিত হচ্ছে, এক ধরণের অসহায় প্রতীক্ষা কতটা দুরহ অস্থির সময় তা জানে।দেশপ্রেম তার যে কম তাও না কিন্তু একই সাথে পরিবারের প্রতি এক ধরণের মমত্ববোধ তার আছে। সেই মমত্ববোধ থেকে সে চায় আমরা আরও কয়েক বছর হেসে খেলে আনন্দে কাটাই, চায় ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে উঠুক আমাদের যৌথ স্নেহে।
সে চায় আমি সাবধানে থাকি, আমি তার সাথে থাকলে নিরাপদ থাকবো এমন বিশ্বাস থেকে সে আমার পাশে থাকতে চায় আর আমি চাই সে আমার কাছ থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক।
সংঘবদ্ধ ভাবে অন্ধ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, আমরা যে লড়াইয়ে নেমেছি সেখান থেকে পিছু হটে আসবার কোনো সুযোগ নেই।
সন্ত্রাসের রাজনীতি মানুষের মেরুদন্ড নুইয়ে দেয়, মানুষকে সন্ত্রস্ত করে মানুষের আড়াল থেকে ছুড়ে দেয় নিজের নিজের গর্তে, আতংকিত মানুষ নিজের ছায়া দেখে চমকে উঠে, এভাবে গণভীতি ছড়িয়ে গণের সঙ্গ থেকে মানুষকে একাকী নিঃসঙ্গ করে দেয়।
আমরা পিছু হটবো না, আমদের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে সময়ের সাথে সাথে, আমরা আরও বেশী চিহ্নিত হবো হয়তো, আমাদের আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকবে কিন্তু সেই ভয়কে আমরা দেশপ্রেমের আগুণে পুড়িয়ে ফেলবো। আমাদের জীবন একটাই, আমরা ভীতু মানুষের মতো একাকী গৃহকোণে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করবো না বরং উজ্জ্বল রৌদ্রের নীচে বন্ধুর হাত হাত রেখে আমরা প্রতীক্ষা করবো, আমরা আঘাতের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবো,
যদি দেশকে ভালোবাসার জন্যে কেউ আমাকে কিংবা আমার স্বজনকে হত্যা করতে আসে আমরা ১ থেকে ১০, ১০ থেকে ১০ হাজার হয়ে প্রতিঘাত করবো। আমাদের সম্মিলিত শক্তির সামর্থ্য ওদের জানা। আমরা সিনা টান করে দাঁড়ালে ওরা কেঁচোর মতো নিজের গর্তে লুকিয়ে যাবে।
তারা যেভাবে বেছে বেছে হত্যা করছে আমরা এই বর্বরতা উপেক্ষা করতে পারি না , কিন্তু আমাদের সমেবেত উপেক্ষায় তাদের নাকচ করে দিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিতে পারি ঘাতক তুমি যতই ছুড়িতে শান দাও না কেনো আমি তোমার চোখের আড়ালের ভয় দেখে ফেলেছি, আমি জানি তোমার ভেতরের মৃত্যুভয় তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তোমার ধ্বংসের দিকে, আমরা শুধু সোজা চোখে তাকালেই এই উদ্যত ছুড়ি তুমি আমার পিঠে ঢুকিয়ে দিতে পারো কিংবা আতংকে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করতে পারো।
আমি নিশ্চিত জানি যদি কোটি চোখ নিস্কম্প নির্ভয়ে তাকিয়ে থাকে তুমি নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করবে।
১. ০৮ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৩৯ ০