আমার রুমমেট ফয়সালের একটা অলৌকিক ব্যাপার আছে। সে ভূত দেখতে পায়। ভূতটা নাকি আমাদের ঘরেই থাকে। প্রথম প্রথম সে খানিকটা ভীতু ছিল, এখন বেশ সাহসী হয়েছে। আগে সে সারাদিন খাটের তলায় চুপচাপ মটকা মেরে পড়ে থাকত, এখন ফয়সালকে বিরক্ত করাই তার একমাত্র কর্তব্য। ফয়সাল পড়তে বসলে সে বই-খাতা সব তছনছ করে, ঘুমোতে গেলে নাকে-কানে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুমের বারোটা বাজায়, এমনকি পিছুপিছু টয়লেটে পর্যন্ত গিয়ে হাজির হয়। এমনিতেও পড়ালেখায় ফয়সালের গরজ কোনোকালেই তেমন ছিল না, অতিষ্ট হয়ে সে এবার টয়লেটে যাওয়াও কমিয়ে দিল।
ঘটনার সূত্রপাত মাস ছয়েক আগের কোনো এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়। টিউশনিতে গিয়েছিলাম। ছাতা নিতে ভুলে যাবার মাশুলস্বরূপ ফিরতে হয়েছিল কাকভেজা হয়ে। বৃষ্টিস্নানে পকেটে থাকা রাস্তাখরচের চেহারা সনাক্তকরণের অযোগ্য হয়ে পড়লে পায়ে হেটে কাদাজলের বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেওয়াটাও বাকি থাকেনি। সারাদিনের ভ্যাপসা গরমের পরে হুট করে নামা বৃষ্টিটা তাই ঘরে বসে হাস-ফাস করতে থাকা মানুষগুলোর কাছে প্রশান্তিদায়ক, প্রেম যমুনায় হাবুডুবু কপোত-কপোতীদের কাছে রোমান্টিক, আর ভোজনরসিকদের কাছে ‘‘ইশ, দুপুরে হলে ডিম-বেগুনভাজি-সর্ষে ইলিশ দিয়ে জমিয়ে খিচুড়ি খাওয়া যেত!’’ প্রভৃতির আফসোস হলেও, আমার কাছে ধরা দেয় বর্ণনাতীত সব খিস্তি-খেউড় অনুশীলনের মওকা হিসেবে। যাইহোক, সিটি কর্পোরেশনের কর্মদক্ষতা আর আমার ওপর ভাগ্যদেবীর সদা-আশীর্বাদী মনোভাবের প্রামাণ্যচিত্র হয়ে মেসে ফিরে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলাম, যখন দেখলাম ফয়সাল খাটের পাশে মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে। তার হাতের মুঠোয় পেপারওয়েট, সেটা দিয়ে ঢিল ছোড়ার মতো ভঙ্গি করছে বারবার। লক্ষ্য খাটের তলা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘করিস কী?’
‘আপদ খেদাই।’
‘কী? বেড়াল?’
মেসে বেড়ালের খুব উৎপাত। তিনটা বেড়ালের একটা দল আছে। এই দলের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল নিয়মিত আমাদের ঘরে হানা দিয়ে খাবার হাপিশ করা। ভাতটা বেড়ে রেখে হাতটা ধুতে গেছি, ফিরে এসে দেখব প্লেটের অর্ধেকটা ফাকা। বহুদিন বাদে মীলাদের তাবারক হিসেবে তেহারী অর্জনের পর প্রফুল্লচিত্তে ধার করা লেবু-মরিচ-শসা-টমেটো দিয়ে সালাদ বানাচ্ছি, সেই সঙ্গে কত সপ্তাহ অথবা মাস কিংবা বছর আগে শেষবার ভালমন্দ কিছু পেটে পড়েছিল সেই হিসেব কষছি; হুটোপুটির শব্দে সম্বিত ফিরলে দেখা যাবে এত সাধের তেহারী মেঝেতে, আর খাদ্যসৈনিকেরা কব্জি থুক্কু নাক-মুখ ডুবিয়ে ভুড়িভোজে মত্ত।
তো ফয়সাল যখন আমার প্রশ্নের উত্তরে ‘‘আপদ খেদাই’’ বলল, স্বভাবতই আমি ধরে নিলাম ত্রিরত্নের একটাকে পাকড়াও করেছে সে। কতদিন কতভাবে চেষ্টা করেছি, ব্যাটাদের লেজটাও ছুতে পারিনি। অবশেষে আজ এসেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অস্ত্রের আশায় এদিক-ওদিক চাইলাম। ঝুলঝাড়ুটা চোখে পড়তেই বাগিয়ে ধরে ফয়সালের পাশে পজিশন নিলাম। কিন্তু কোথায় বেড়াল? একটা ঝুড়ি, দুটো বাক্স আর পুরোনো বইখাতার স্তুপ বাদে কিছুই চোখে পড়ল না।
‘কীরে, কী খেদাস? বেড়াল-টেড়াল কিছুই তো দেখছি না!’
‘পালিয়েছে।’
‘পালিয়েছে! একটা জ্বলজ্যান্ত বেড়াল চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে গেল, অথচ আমি তা দেখতে পেলাম না?’
‘বেড়াল নারে উল্লুক!’
‘তাহলে?’
‘ভূতাচী।’
‘ঘামাচী-ব্যাঙ্গাচীর কথা জানি, কিন্তু ভূতাচী! সেটা আবার কী জিনিস?’
‘ভূতের বাচ্চা। বদমাশটা কোত্থেকে এসে জুটেছে কে জানে!’
ভূতাচী... ভূতের বাচ্চা... ফয়সালের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। ব্যাটা আমার সাথে মশকরা করছে! মেজাজটাই বিগড়ে গেল। কত আশা নিয়ে বাসর রাতের আগেই বেড়াল মারতে এসেছিলাম!
ফয়সাল ঠাট্টা-মশকরা করছে, সেটাও ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। সে আর যাই হোক, ঠাট্টা-মশকরা করার লোক নয়। ফয়সালের নামে এমন অপবাদ দেবার আগে তার চরম শত্রুও দশবার ভাববে। অবশ্য তার কোনো শত্রু আছে বলে মনে হয় না। শত্রুর কথা পরে, ফয়সালের তো বন্ধুরই অভাব। অধিকন্তু, আমার ধারণা তিনকুলে কেউ নেই তার। ফয়সাল মেসে এসেছে দু’বছর হতে চলল, এরমধ্যে একটা রাতও সে বাইরে কাটায়নি। মানে, বলতে চাচ্ছি, বাড়িতে-টাড়িতে যায়নি। এমনকি ঈদের সময়, যখন পুরো মেস ফাকা হয়ে যায়, তখনো সে কোথাও যাবার গা করে না। তার একটা মোবাইল ফোন আছে- মাল্টিমিডিয়া সেট না, নরমাল- কিন্তু তাতে সিম কোম্পানি বাদে অন্য কারো কল আসতে দেখিনি কখনো।
প্রয়োজন না পড়লে ফয়সাল বাইরে বেরোয় না খুব একটা। তার মতো নিঃসঙ্গ মানুষের তো আর আড্ডা-ফাড্ডা মারার অবকাশ নেই। তার অধিকাংশ সময় কাটে পড়ার টেবিলে। তাই তাকে পড়ুয়া ভেবে বিভ্রান্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। প্রথম প্রথম আমি নিজেও এই বিভ্রান্তিতে পড়েছিলাম। তবে ভালমতো খেয়াল করার পর আমার ভুল ভাঙ্গল। ফয়সাল পড়ার টেবিলে মুখ গুঁজে বসে থাকে ঠিকই, কিন্তু বইয়ের সাথে তার সাক্ষাত ঘটে খুব কম। তার সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে একটা রঙচটা খয়েরী ডায়েরী। বেশিরভাগ সময় সে সেই ডায়েরীতে খসখস করে কীসব লেখে, আবার কখনো কখনো গভীর মনোযোগের সাথে সেসব লেখা পড়ে। হঠাৎ হঠাৎ সে আনন্দে শিষ দিয়ে ওঠে, মাঝেমাঝেই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে, আবার অনেকসময় রাগে-হতাশায় মাথার চুল ছিঁড়ে। মোদ্দাকথা, ফয়সালের সময় কাটানোর একমাত্র মাধ্যম ঐ মলিন, রঙচটা ডায়েরী। তার সঙ্গী, বন্ধু, সহচর যদি কেউ হয়ে থাকে, তা কেবল ঐ ডায়েরীটাই। তার আনন্দ-বেদনাসহ যাবতীয় আবেগ-অনুভূতি ঐ ডায়েরীকে ঘিরে।
এমনিতেই ফয়সাল চাপা স্বভাবের, ডায়েরীর ব্যাপারে জানতে চাইলে আরো বেশি গুটিয়ে নেয় নিজেকে। আর ফয়সাল কোনো ব্যাপারে বলতে না চাইলে, তার পেটে বোম মেরেও কথা বের করার সাধ্য নেই কারো। তাই বারকয়েক জিজ্ঞাসাবাদের পরেও কোনো সদুত্তর না পেলে, রুমমেটের স্বভাবের সাথে পরিচয় থাকায় ক্ষান্ত দিলাম।
যাইহোক, সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে কিন্তু ফয়সালের রুটিন বদলে গেল। পড়ার টেবিলে ডায়েরী হাতে নয়, এখন তার দিন কাটে পেপারওয়েট-ঝাড়ু-ছেঁড়া স্যান্ডেল নিয়ে খাটের পাশের মেঝেতে। কিছুক্ষণ পরপর সে সেসব উচিয়ে ধরে অদৃশ্য কাউকে হুমকি-ধামকি দেয়। এরিমধ্যে আরো কয়েকবার আমি খাটের তলায় চিরুনি অভিযান চালিয়েছি। ঝুড়ি, বাক্স আর পুরোনো বইখাতার স্তুপ ছাড়া কিছু পাইনি কোনোবারই। ফয়সালকে সেকথা বলায় পাল্টা প্রশ্ন করে বসল,
‘ভূতের বাচ্চাটা দেখছি তোর গন্ধ পেলেই লেজ গুটিয়ে পালায়! রহস্যটা কী বল তো?’
‘রহস্য-টহস্য কিছু নেই। আমার মতো একটানা চার-পাঁচদিন গোসল না করে থাকলে তোর গন্ধেও ভূত পালাবে।’
কিন্তু ফয়সাল ঝাড়া দশদিন গোসল না করার পরেও ভূত পালানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। উল্টো মেসবাসীদের পাততাড়ি গুটাবার উপক্রম হল। খাল কেটে কুমির ডেকে আনার জন্য মনে মনে নিজের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করলাম। ওদিকে ফয়সাল আবার আমার ওপর মহাখাপ্পা। আমার দেওয়া টোটকায় তো কোনো কাজ হচ্ছে না! শেষটায় আমাকে তার হাতে-পায়ে ধরে বলতে হল,
‘ভাই, হারামজাদাটার মনে হয় সর্দি লেগেছে। তাই তোর এমন প্রাণঘাতী ইয়েও ব্যাটার নাকে যাচ্ছে না। কিন্তু তার নাকে না গেলেও, আমাদের তো মরে ভূত হবার দশা। একটা ভূতের ঠেলাতেই তোর অবস্থা কাহিল, এতগুলোকে সামলাবি কীভাবে? তাই, তোর দু’টি পায়ে পড়ি, আল্লাহর ওয়াস্তে গোসলে যা! নিজেকে বাঁচা, সাথে আমাদেরকেও।’
ফয়সাল গোসলে গেল ঠিকই, তবে শীঘ্রই ভূত জব্দ করার নতুন উপায় বার করে ফেলল। ভূতটার কানের কাছে গিয়ে সে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করল। ভূত বাবাজীর কি কানেও গন্ডগোল নাকি! ফয়সাল যেসব ভাষা ছাড়ে, তাতে বয়রা না হলে কবেই নাকের পানি চোখের পানি এক করে বিদায় হবার কথা, অথচ তার যেন কোনো বিকার নেই! ভূতেদের আত্মসম্মানবোধের নমুনা দেখে হতাশই হলাম।
কিন্তু ভূতেদেরও যে আত্মসম্মানবোধ আছে, সে প্রমাণ পেতে খুব বেশি দেরি হল না। ফয়সালের এই দূর-ছাই ব্যবহারের ফলে অন্তর্মুখী স্বভাবের ভূতটা হুট করে খানিকটা আগ্রাসী হয়ে গেল। ভূতেদের সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। ফয়সালের বাড়াবাড়িতে তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সে এবার প্রতিশোধ নিতে লাগল। এতদিন ভূতটা খাটের তলায় চুপটি করে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকত কেবল, এবার সে ফয়সালের পেছনে লাগতে শুরু করল। ফয়সাল পড়তে বসলে সে বইখাতা সব তছনছ করে, ঘুমোতে গেলে নাকে-কানে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুমের বারোটা বাজায়, এমনকি পিছুপিছু টয়লেটে পর্যন্ত গিয়ে হাজির হয়। মাঝেমধ্যে ফয়সাল কষিয়ে দু’-চার ঘা বসিয়ে দেয়, কিন্তু সে সেসবের থোড়াই কেয়ার করে।
ধীরে ধীরে ভূতের উপদ্রব চরম মাত্রায় পৌছুল। ভূতটার বোধহয় বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। সে খুব দুঃসাহসী হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং সে নতুন আরেকটি অপকর্ম করতে শুরু করেছে। ফয়সাল টয়লেটে বসলেই সে তার পশ্চাদ্দেশে চিমটি কাটে। বাধ্য হয়ে ফয়সাল খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিল। খেলেই তো টয়লেটে যেতে হবে। আর টয়লেটে গেলেই...
তবে ভূতটার সব লম্ফঝম্ফ আমার মেসে না থাকাকালীন সময়ে সীমাবদ্ধ। কোনো এক অজানা কারণে আমাকে খানিকটা ভয় পায় সে। আমি ঘরে থাকলে সে সুবোধ বালক বনে যায়। তখন সে টুঁশব্দটিও করে না। ভূতের ভয়ের কারণ হতে পেরে গর্বে আমার বুকের ছাতি ছ’ ইঞ্চি ফুলে গেল। কিন্তু সেই ফুলে ওঠা বুক ফাটা বেলুনের মতো চুপসে দেবার ব্যবস্থা করল ফয়সাল। সে আবদার করে বসল,
‘তুই রুমে থাকলে ভূতাচীটার অত্যাচার থেকে একটু রেহাই পাই আমি। এক কাজ কর, ভূতের বাচ্চাটা বিদায় হবার আগ অবধি আর বাইরে-টাইরে যাস না। রুমমেটের জীবন বাঁচাতে এতটুকু স্যাক্রিফাইস কি তুই করতে পারবি না?’
স্যাক্রিফাইস তো করতেই পারতাম। তাছাড়া মনীষীরাও বলেছেন- ভোগ নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। কিন্তু তাতে না খেয়ে মরতে হত। নিজের জান বাঁচানো ফরজ, তাই চুপচাপ সটকে পড়লাম।
ফয়সালের এসব গাঁজাখুরি গপ্পো যে আমি বিশ্বাস করি, তা কিন্তু না। ব্যাটার মাথাটা যে গেছে, তা বেশ বুঝতে পারছি। (অনেকে এবার নাকটা গলিয়ে বলবেন, ‘‘ফয়সালকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হল না কেন? গল্পকথকের কি কোনো আক্কেলজ্ঞান নেই!’’ তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- জনাব, সাইকিয়াট্রিস্টের ভিজিটিং ফি-টা কি আপনি দেবেন? আপনি তো ঐ নাক গলিয়েই খালাস! এদিকে যে আমার টিউশনির টাকায় নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সে খেয়াল কি আপনার আছে?) এই যেমন এখনের কথাই ধরা যাক! মাথার সমস্যা না থাকলে কি কেউ এই মাঘরাতে কারো শীতনিদ্রা ভাঙার মতো মহাপাপ করে! তাও আবার এমন আচানক ধাক্কা দিয়ে! র্যাপিড আই মুভমেন্টের স্তরে ছিলাম, ধাক্কার চোটে উঠে বসলাম তড়বড় করে। বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানি শুরু হল।
‘ভূতাচী দেখবি?’
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বদ্ধ উন্মাদের সাথে মেজাজ দেখিয়ে বেঘোরে প্রাণটা খোয়াবার কোনো মানে নেই। তাই চুপ থাকলাম। আর মনে মনে কাল সকালে উঠেই ঘর বদলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ফয়সালের সাথে আর বেশিদিন থাকলে চৌরাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে জন্মদিনের পোশাকে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে হবে।
‘উল্লুকটা খাটের তলায় বসে আছে। তোকে দেখা দিতে চায় আজ। আয়, ভূতাচী দেখবি আয়।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হল। আলো জ্বেলে খাটের তলায় উকি দিলাম। একটা ঝুড়ি, দুটো বাক্স আর পুরোনো বইখাতার স্তুপ... সেই একই দৃশ্য। ভূতাচী-টূতাচী কিছু নেই। থাকার কথাও না অবশ্য। হঠাৎ কী হল জানি না, দাত-মুখ খিচিয়ে খিস্তির তুবড়ি ছোটালাম-
‘শালার পাগলের বাচ্চা পাগল! রাতদুপুরে পাগলামি মারাস?’
ভেবেছিলাম খিস্তি শুনে ফয়সাল তেড়েফুঁড়ে আসবে। কিন্তু তার বদলে সে হাসছে, রহস্যময় হাসি। বইখাতার স্তুপ ঘেটে কিছু একটা বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। জিনিসটা আর কিছুই না, সেই রঙচটা খয়েরী ডায়েরী। মলিন মলাটের ওপর গোটাগোটা হরফে লেখা শব্দটা জ্বলজ্বল করছে- ‘‘ভূতাচী’’!
পরিশিষ্ট
পরদিন সকাল থেকে ফয়সালকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। খুব যে খোঁজাখুঁজি করা হল তাও নয়। ফয়সালের মতো একজন নিঃসঙ্গ মানুষকে অতো খুঁজতে যাবেটাই বা কে? আমার কি আর সে সময় আছে! আর সত্যি কথা বলতে, পাগলের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ায় আমি খুশিই হয়েছিলাম।
ফয়সালের সেই খয়েরী ডায়েরীর রহস্যোদ্ধার হয়েছে। সারাদিন বসে সে তাতে গল্প লিখত। ঠিক গল্প না, উপন্যাস- অতিপ্রাকৃত উপন্যাস। সেই অতিপ্রাকৃত উপন্যাসের একমাত্র ভৌতিক চরিত্রের নাম ভূতাচী। সাহিত্য ভাল বুঝি না, কিন্তু ফয়সালের লেখা পড়ে মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এল। তার মতো একটা মানুষ এতটা ভাল লেখে কীভাবে!
ফয়সালের ভূত দেখা রোগটা যে আসলে হ্যালুসিনেশন ছিল, সেটা আগেই বুঝেছিলাম। হ্যালুসিনেশনের হেতুটা এবার পাওয়া গেল। আমি এই ব্যাপারটার একটা নতুন নাম দিয়েছি- কল্পফাঁদ। একজন মানুষ যখন কোনো নির্দিষ্ট কল্পনায় রাতদিন বিভোর হয়ে থাকে, তখন সে এমন কল্পফাঁদে আটকা পড়ে। তার কল্পজগত আর বাস্তবজগতের মধ্যকার দেয়াল ভেঙ্গে যায়, কল্পজগত-বাস্তবজগত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সে আর সেগুলোকে আলাদা করতে পারে না। তার কাছে তখন কল্পনাকেই বাস্তব মনে হয়, বাস্তবকে মনে হয় কল্পনা। ফয়সালের সাথেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল বলে অন্তত আমার ধারণা। ভূতাচীর সাথে সে এত বেশি জড়িয়ে পড়েছিল যে একসময় এই কল্পনার ভূতই বাস্তবে হানা দিতে শুরু করে।
বছর পার হয়ে গেছে, ফয়সালের আর কোনো হদিশ মেলেনি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন ছেলেটা। সর্বগ্রাসী সময় আরো অনেককিছুর সাথে তার অস্তিত্বটুকুও গিলে খেয়েছে। ভুল বললাম। ফয়সালের অস্তিত্বের একটা বড় অংশ এখনো আমার কাছে অক্ষত অবস্থায় আছে। আর সেটা যাতে অক্ষতই থাকে, সেই বন্দোবস্ত করেছি এবার। এবারের বইমেলায় ‘‘ভূতাচী’’ নামক অতিপ্রাকৃত উপন্যাস আসছে অমুক প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদটাও চুড়ান্ত হয়ে গেছে আজ। লেখকের জায়গায় নামটা অবশ্যই আমার। গায়েবী লেখকের নামে বই বের করাটা কোনো কাজের কথা না।
খুট করে একটা শব্দ হল হঠাৎ। সম্বিত ফিরে পেলাম। ফয়সালের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে আমার মধ্যেও দেখছি বেশ একটা লেখক-লেখক ভাব এসেছে! নইলে এত কথা লিখে ফেললাম কীভাবে! আবার হল শব্দটা- খুট খুট খুট...। খাটের তলায় কিছু একটা নড়ে উঠল বলে মনে হল। নাহ, বেড়ালগুলো তো জ্বালিয়ে মারল! পেপারওয়েট হাতে সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলাম। মুহূর্তেই দপদপ করে উঠল কপালের শিরা। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শুরু হল। সেই শব্দ লক্ষগুণ জোরালো হয়ে কানে এসে একঘেয়েভাবে বেজে চলল- ভূতাচী, ভূতাচী...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:২১