‘তুমি কেমন আছো, নিশাদ?’
মিষ্টি, মিহি মেয়েলি কন্ঠস্বর, কেমন যেন নেশা ধরে যায়। নেশাখোর যুবকেরা ফেন্সিডিল, গাঁজা কিংবা হালের ইয়াবায় বুদ না হয়ে বরং নিয়ম করে দু’বেলা এই কন্ঠস্বর গিলত সন্ধান পেলে। বিত্তবান ভদ্রমহোদয়রা রেড ওয়াইনের বদলে এই কন্ঠস্বরের মালকিনের সাথে কথা বলতে পারতেন। রেড ওয়াইন দুই-চার-পাঁচ পেগের পর আর খাওয়া যায় না। কন্ঠস্বরের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
‘কোথায় ছিলে এতদিন?’
আমার আপাতত নেশা চড়াবার ইচ্ছে নেই। তাই শুনেও না শোনার ভান করছি। একটা হেডফোন থাকলে ভাল হত। কানে সুরের সমুদ্র ঢেলে সবকিছু উপেক্ষা করা যেত খুব সহজে। আমার কাছে হেডফোন নেই। অগত্যা নিজের সাথে ছল করতে হল। কাজটা আমার মতো পাকা অভিনেতার জন্য কঠিন হবার কথা নয়। কিন্তু আমাকে বেশ বেগ পেতে হল। অন্যের সাথে অভিনয় করাটা যত সহজ, নিজের সাথে ততটা না বোধহয়।
‘কত সহস্র রাতের শিশিরকণারা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই দু’চোখের সুনামীতে হার মেনেছে তা কি তুমি জানো?’
আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে মিষ্টির লোভ জয় করা কঠিন। আর সেই মিষ্টি নিজে থেকে এসে কানে গুতোগুতি করলে কারোরই কিছু করার থাকে না। আমারো কিছুই করার নেই, উৎকর্ণ হয়ে কন্ঠের শরবত গেলা ছাড়া।
‘তোমার মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা হবার কথা? সেই যে কদমতলী গ্রামে! কি লাজুকটাই না ছিলে তুমি…’
আমি তখন মহাশূন্যে ডুবন্ত এক নভোচারী। আমার সামনে অগণিত উজ্জ্বল নক্ষত্রের ঝলমলানি। এই মেয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল সুভাষিনী। কানে বেজে চলা অপরূপ মুর্ছনার এই অধিকারিনীটির নাম যদি সুভাষিনী না হয়, তাহলে সুভাষিনী বলে কোনো শব্দ থাকাটাই বাতুলতা। সমস্যা হল, অধিকাংশ বাঙালিরই বাংলা নাম ব্যবহারের অধিকার নেই। হয় বাঙালির নাম রাখা হবে সহীহ অমুক ভাষায়, নয়তো পিওর তমুক ভাষায়। এই মেয়েটিও তার ব্যতিক্রম না। এর নাম সম্ভবত, লিসা। আমার অবশ্য লিসার নাম জানার কথা না। কিন্তু আমি জানি।
নিশিহন্টন আমার কাছে এক ধরণের নেশা। আর রাতটা যদি হয় অমাবস্যা, তাহলে তো কথাই নেই। আমি বেরিয়ে পড়ি, উপভোগ করি ধরণীর কৃষ্ণসৌন্দর্য। দেখি, গোটা ধরাধাম গায়ে আবলুশ আলো মেখে নিত্যনতুন কলঙ্ক ঢাকায় ব্যস্ত। আমি হেসে উঠি, খিলখিলিয়ে। জোরালো অট্টহাসিতে ধর্ষিত হয় অমানিশার নিস্তব্ধতা। আমি হাসতে হাসতে বলি,
‘ওহে প্রকৃতি! তুমি তো দেখছি আমার মতোই পাকা অভিনেতা। আমি ছল করি অন্যের সাথে, তোমার ছল তোমার নিজের সাথে। চোখে কালো আলো বেধে তুমি স্বেচ্ছান্দ হও। তুমি এড়িয়ে যেতে চাও মহাবিষধরের গুহায় বিচরণ। আচ্ছা প্রকৃতি! কালো আলোয় তুমি নাহয় চোখ বাধলে, কিন্তু কান? শিকারি বাঘ আর বুলির গর্জন থেকে কি তুমি নিস্তার পাও? নাকি তুমি জন্মকালা?’
প্রকৃতি জবাব না দিয়ে নিশ্চিত করে তার জন্মবধিরতা। আমি শরীর দুলিয়ে হাসতে থাকি। দুলুনির চোটে মৃদু ভূ-কম্পন সৃষ্টি হয়, আস্তে করে কেঁপে ওঠে পৃথিবী। সেই মৃদু কম্পনকেই সবলচিত্তহীনেরা মহাপ্রলয় ভেবে বসে। আতঙ্কিত চিৎকারে পলকা হাওয়া স্থুল হয়ে ওঠে। হুড়োহুড়ি আর ওজনদার পদাঘাতে কম্পন বেড়ে যায় বহুগুণ। পত্রিকায় পরদিন খবর বেরোয়,
“তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সারাদেশ; নিহত অগণিত বীর্য, আহত সংখ্যাতীত কামাতুর হৃদয়।”
আজো তেমনি নিশিহন্টনে বেরিয়েছিলাম। হেটে চলেছিলাম এলোমেলো পদক্ষেপে। বাহবা দিচ্ছিলাম প্রকৃতির নাট্যপ্রতিভাকে। আচমকাই দাঁড়িয়ে গেলাম। বর্ণে বর্ণে সঙ্গমে প্রসব হল একটি নাম, অজান্তেই।
‘…আমাকে কনের সাজে সাজিয়ে তুমি হারিয়ে গেলে। গুম হয়ে গেলে একদম। তারপর যেমন হঠাৎ করে হারিয়েছিলে, তেমন হঠাৎই ফিরে এলে আজ। এতদিন কোথায় ছিলে, নিশাদ? আমাকে কি তোমার একটুও মনে পড়েনি?’
এই মেয়ে আমাকে নিশাদ ভাবছে। নিশাদ হলে আমি আনন্দিতই হতাম। আফসোস, আমি নিশাদ নই। কিন্তু এসব আমি কি ভাবছি! আমি কি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি? অন্যকে মোহাচ্ছন্ন করা এই আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি? মানবীয় আবেগ-অনুভূতি কি আমাকে স্পর্শ করছে? সেটা কি সম্ভব?
‘আবার আমাকে ফেলে চলে যাবে নাতো? ওহ নিশাদ! কথা বলো প্লিজ! নিশাদ!’
আমি থমকে যাই, চিন্তারাজ্য মুখ থুবড়ে পড়ে। ফাকা মাথায় বাজতে থাকে কেবল একটাই নাম- নিশাদ, নিশাদ, নিশাদ…
পরিশিষ্ট
এখন আর আমার পথচলা এলোমেলো, উদ্দেশ্যহীন নয়। আমি হেটে চলি দৃপ্ত পদক্ষেপে, নির্দিষ্ট গন্তব্যে। একসময় থমকে দাড়াই। বর্ণের সাথে বর্ণের সঙ্গম ঘটে, প্রসব হয় একটি নাম- “লিসা”। লিসা বেরিয়ে আসে, শুরু হয় আমাদের নিশিহন্টন। হাটতে হাটতে লিসা গল্প বলে; ওর গল্প, আমার গল্প, আমাদের গল্প। ভুল বললাম। লিসা গল্প বলে ঠিকই; ওর গল্প বলে, নিশাদের গল্প বলে, ওদের দুজনার গল্প বলে। আমি নিশাদ নই, আমি অভিনেতা। আচ্ছা! লিসা কি আমার অভিনয় বুঝতে পারে? লিসা কি ধরতে পারে, নিশাদ আর নিশির পার্থক্য?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:০৩