somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিশিহন্টন

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘তুমি কেমন আছো, নিশাদ?’
মিষ্টি, মিহি মেয়েলি কন্ঠস্বর, কেমন যেন নেশা ধরে যায়। নেশাখোর যুবকেরা ফেন্সিডিল, গাঁজা কিংবা হালের ইয়াবায় বুদ না হয়ে বরং নিয়ম করে দু’বেলা এই কন্ঠস্বর গিলত সন্ধান পেলে। বিত্তবান ভদ্রমহোদয়রা রেড ওয়াইনের বদলে এই কন্ঠস্বরের মালকিনের সাথে কথা বলতে পারতেন। রেড ওয়াইন দুই-চার-পাঁচ পেগের পর আর খাওয়া যায় না। কন্ঠস্বরের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
‘কোথায় ছিলে এতদিন?’
আমার আপাতত নেশা চড়াবার ইচ্ছে নেই। তাই শুনেও না শোনার ভান করছি। একটা হেডফোন থাকলে ভাল হত। কানে সুরের সমুদ্র ঢেলে সবকিছু উপেক্ষা করা যেত খুব সহজে। আমার কাছে হেডফোন নেই। অগত্যা নিজের সাথে ছল করতে হল। কাজটা আমার মতো পাকা অভিনেতার জন্য কঠিন হবার কথা নয়। কিন্তু আমাকে বেশ বেগ পেতে হল। অন্যের সাথে অভিনয় করাটা যত সহজ, নিজের সাথে ততটা না বোধহয়।
‘কত সহস্র রাতের শিশিরকণারা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই দু’চোখের সুনামীতে হার মেনেছে তা কি তুমি জানো?’
আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে মিষ্টির লোভ জয় করা কঠিন। আর সেই মিষ্টি নিজে থেকে এসে কানে গুতোগুতি করলে কারোরই কিছু করার থাকে না। আমারো কিছুই করার নেই, উৎকর্ণ হয়ে কন্ঠের শরবত গেলা ছাড়া।
‘তোমার মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা হবার কথা? সেই যে কদমতলী গ্রামে! কি লাজুকটাই না ছিলে তুমি…’
আমি তখন মহাশূন্যে ডুবন্ত এক নভোচারী। আমার সামনে অগণিত উজ্জ্বল নক্ষত্রের ঝলমলানি। এই মেয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল সুভাষিনী। কানে বেজে চলা অপরূপ মুর্ছনার এই অধিকারিনীটির নাম যদি সুভাষিনী না হয়, তাহলে সুভাষিনী বলে কোনো শব্দ থাকাটাই বাতুলতা। সমস্যা হল, অধিকাংশ বাঙালিরই বাংলা নাম ব্যবহারের অধিকার নেই। হয় বাঙালির নাম রাখা হবে সহীহ অমুক ভাষায়, নয়তো পিওর তমুক ভাষায়। এই মেয়েটিও তার ব্যতিক্রম না। এর নাম সম্ভবত, লিসা। আমার অবশ্য লিসার নাম জানার কথা না। কিন্তু আমি জানি।
নিশিহন্টন আমার কাছে এক ধরণের নেশা। আর রাতটা যদি হয় অমাবস্যা, তাহলে তো কথাই নেই। আমি বেরিয়ে পড়ি, উপভোগ করি ধরণীর কৃষ্ণসৌন্দর্য। দেখি, গোটা ধরাধাম গায়ে আবলুশ আলো মেখে নিত্যনতুন কলঙ্ক ঢাকায় ব্যস্ত। আমি হেসে উঠি, খিলখিলিয়ে। জোরালো অট্টহাসিতে ধর্ষিত হয় অমানিশার নিস্তব্ধতা। আমি হাসতে হাসতে বলি,
‘ওহে প্রকৃতি! তুমি তো দেখছি আমার মতোই পাকা অভিনেতা। আমি ছল করি অন্যের সাথে, তোমার ছল তোমার নিজের সাথে। চোখে কালো আলো বেধে তুমি স্বেচ্ছান্দ হও। তুমি এড়িয়ে যেতে চাও মহাবিষধরের গুহায় বিচরণ। আচ্ছা প্রকৃতি! কালো আলোয় তুমি নাহয় চোখ বাধলে, কিন্তু কান? শিকারি বাঘ আর বুলির গর্জন থেকে কি তুমি নিস্তার পাও? নাকি তুমি জন্মকালা?’
প্রকৃতি জবাব না দিয়ে নিশ্চিত করে তার জন্মবধিরতা। আমি শরীর দুলিয়ে হাসতে থাকি। দুলুনির চোটে মৃদু ভূ-কম্পন সৃষ্টি হয়, আস্তে করে কেঁপে ওঠে পৃথিবী। সেই মৃদু কম্পনকেই সবলচিত্তহীনেরা মহাপ্রলয় ভেবে বসে। আতঙ্কিত চিৎকারে পলকা হাওয়া স্থুল হয়ে ওঠে। হুড়োহুড়ি আর ওজনদার পদাঘাতে কম্পন বেড়ে যায় বহুগুণ। পত্রিকায় পরদিন খবর বেরোয়,
“তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সারাদেশ; নিহত অগণিত বীর্য, আহত সংখ্যাতীত কামাতুর হৃদয়।”
আজো তেমনি নিশিহন্টনে বেরিয়েছিলাম। হেটে চলেছিলাম এলোমেলো পদক্ষেপে। বাহবা দিচ্ছিলাম প্রকৃতির নাট্যপ্রতিভাকে। আচমকাই দাঁড়িয়ে গেলাম। বর্ণে বর্ণে সঙ্গমে প্রসব হল একটি নাম, অজান্তেই।
‘…আমাকে কনের সাজে সাজিয়ে তুমি হারিয়ে গেলে। গুম হয়ে গেলে একদম। তারপর যেমন হঠাৎ করে হারিয়েছিলে, তেমন হঠাৎই ফিরে এলে আজ। এতদিন কোথায় ছিলে, নিশাদ? আমাকে কি তোমার একটুও মনে পড়েনি?’
এই মেয়ে আমাকে নিশাদ ভাবছে। নিশাদ হলে আমি আনন্দিতই হতাম। আফসোস, আমি নিশাদ নই। কিন্তু এসব আমি কি ভাবছি! আমি কি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি? অন্যকে মোহাচ্ছন্ন করা এই আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি? মানবীয় আবেগ-অনুভূতি কি আমাকে স্পর্শ করছে? সেটা কি সম্ভব?
‘আবার আমাকে ফেলে চলে যাবে নাতো? ওহ নিশাদ! কথা বলো প্লিজ! নিশাদ!’
আমি থমকে যাই, চিন্তারাজ্য মুখ থুবড়ে পড়ে। ফাকা মাথায় বাজতে থাকে কেবল একটাই নাম- নিশাদ, নিশাদ, নিশাদ…

পরিশিষ্ট

এখন আর আমার পথচলা এলোমেলো, উদ্দেশ্যহীন নয়। আমি হেটে চলি দৃপ্ত পদক্ষেপে, নির্দিষ্ট গন্তব্যে। একসময় থমকে দাড়াই। বর্ণের সাথে বর্ণের সঙ্গম ঘটে, প্রসব হয় একটি নাম- “লিসা”। লিসা বেরিয়ে আসে, শুরু হয় আমাদের নিশিহন্টন। হাটতে হাটতে লিসা গল্প বলে; ওর গল্প, আমার গল্প, আমাদের গল্প। ভুল বললাম। লিসা গল্প বলে ঠিকই; ওর গল্প বলে, নিশাদের গল্প বলে, ওদের দুজনার গল্প বলে। আমি নিশাদ নই, আমি অভিনেতা। আচ্ছা! লিসা কি আমার অভিনয় বুঝতে পারে? লিসা কি ধরতে পারে, নিশাদ আর নিশির পার্থক্য?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:০৩
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×