মধ্যদুপুর। ভ্যাপসা গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার। ঘন্টাখানেক হল ঠায় বসে আছি। জ্যাম ছাড়ার নাম-গন্ধও নেই। রিকশাওয়ালা লোকটা রিকশা ছেড়ে পাশের আইল্যান্ডে গিয়ে বসেছে। তার হাতে একটা আধখাওয়া বিড়ি। বিরক্তির লেশমাত্র নেই চোখেমুখে। জ্যাম লাগায় বরং খুশিই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আয়েশী ঢঙ্গে ধোয়ার রিং উড়িয়ে চলেছে। চমৎকার আর্ট! কিন্তু আমার কাছে চরম বিরক্তিকর বলে মনে হল। জ্যামে আটকা পড়ার সুযোগটা তাহলে বিরক্তি মহাশয়া ভালমতই কাজে লাগিয়েছেন দেখা যাচ্ছে! ইতোমধ্যেই তিনি তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে দিয়েছেন। এই ভদ্রমহিলা এতো পজেসিভ কেন কে জানে?
রিকশাওয়ালার কাজ-কারবার দেখে এবার মেজাজটাও বিগড়ে যাচ্ছে। সে এখন নাসিকারন্ধ্র পরিস্কারের কাজে মনোনিবেশ করেছে। এই কাজটি অতীব জরুরী এবং একই সাথে উপকারীও বটে। নিয়মিত নাসিকারন্ধ্র পরিস্কার না করলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে বললে কি অত্যুক্তি হয়ে যাবে? নির্মল বিনোদনের সহজতর মাধ্যম হিসেবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। পাঠ্যপুস্তকে কি ''নাসিকারন্ধ্র পরিস্কারের প্রয়োজনীয়তা'' টাইপের কোন রচনা আছে? থাকা তো উচিত! এইসব অতি দরকারী জিনিসগুলোই যদি না শেখানো হয়, তবে ছেলে-পেলেদের স্কুলে পাঠিয়ে লাভটা কি?
এ জাতীয় অতি উচ্চমার্গীয় চিন্তা-ভাবনা করতে করতে দেখলাম, বিরক্তি মহাশয়া মেজাজ সাহেবের সাথে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে বাসে উঠে পড়েছেন। যাক বাবা, এ যাত্রায় মিস ভাবনার কল্যানে সহজেই রক্ষা পাওয়া গেল। লম্বা করে শ্বাস নিলাম। পিলপিল করে এক খাবলা লু হাওয়া নাকে এসে ঢুকল। বাস-ট্রাকগুলো ক্রমাগত ভেঁপু বাজিয়ে যাচ্ছে। এরা কি এই শহরে নতুন? এরা কি জানে না, এখানে ভেঁপু বাজালে জ্যাম ছাড়ার বদলে উল্টো হাটু গেড়ে বসে!
নাহ। এখানে থাকাটা আর নিরাপদ নয়। ফট করে কখন আবার বিরক্তি-মেজাজ দম্পতি গোটা দশেক আন্ডা-বাচ্চাসহ এসে হাজির হবেন কে বলতে পারে? তাদের সে সুযোগ করে দেয়াটা কোনমতেই ঠিক হবে না। রিকশাওয়ালার ভাড়া চুকিয়ে হাটা ধরলাম। ব্যাটা ডাবল ভাড়া নিয়েছে। গন্তব্যের অর্ধেক পথ এসেছি, তার উচিত ছিল অর্ধেক ভাড়া নেয়া। সে ডাবল চেয়ে বসল। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ডাবল ভাড়া দিলাম। গ্যাঞ্জামে বিরক্তি-মেজাজ দম্পতির দৃষ্টি আকর্ষণের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে কিনা?
মাথার ওপর তপ্ত সুর্য, চারিদিকে মানুষের কোলাহল। কেমন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব এসে যাচ্ছে। সুর্যকিরণেরও একটা অদ্ভুত বশীকরণ ক্ষমতা আছে। সে এখন আমার ওপর তার বশীকরণ ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। অসহ্য রকমের ভাললাগা নিয়ে আমি রুদ্ররুপ দর্শনে মজেছি। সে যে শুধু রুপ দেখিয়েই ক্ষান্ত হল তা নয়, নিজের বিরুপও উন্মোচন করল। আমার মোহ কেটে গেল। ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছি। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। এমন সময় দেখলাম লোকটাকে। শরবতওয়ালা।
এমনিতে আমি বাইরের জিনিস খুব একটা খাই না। কিন্তু আজ ঠোটটা না ভিজালেই নয়। শরবত খেয়ে তৃষ্ণা দুর করা যাবে। এই ফাকে লোকটার সাথে আলাপ জমিয়ে একটু জিরিয়েও নেয়া যেতে পারে। চটজলদি এগিয়ে গেলাম তার মাছি ভনভনে গাড়িটার দিকে।
'শরবত কত করে?'
'পাঁচ ট্যাকা গেলাস।'
'মাছি ভনভন করে কেন?'
ব্যাটা কোন উত্তর দিল না।
'দাও দেখি হাফ গ্লাস। দেখা যাক, কেমন স্বাদ তোমার মাছির শরবতের!'
শরবতওয়ালা ফোসফোস করে উঠল। মনে হয় না এর সাথে আলাপ জমানো যাবে। এই একটা জিনিস খেয়াল করে দেখলাম, শরবতওয়ালাদের অধিকাংশই তিরিক্ষিমেজাজী। ঝালমুড়িওয়ালাদের ক্ষেত্রে আবার ঠিক উল্টোটা। তাদের বেশিরভাগই ঠান্ডা মেজাজের অধিকারী। অথচ এর বিপরীতটা হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। শরবতওয়ালাদের হওয়া উচিত ছিল শরবতের মতো ঠান্ডা প্রকৃতির, আর ঝালমুড়িওয়ালাদের হওয়া উচিত ছিল বোম্বাই ঝাল কিংবা গোলমরিচ প্রকৃতির।
দ্রুত পা চালালাম। তৃষ্ণাটা বেড়েছে। ক্ষুধাও লাগার কথা, লাগেনি। তৃষ্ণার জন্যই বোধহয় ক্ষুধাটা ঠিক টের পাওয়া যাচ্ছে না। এই মুহুর্তে তৃষ্ণাকে একটা স্যালুট দিতে ইচ্ছে করছে। তাতো সম্ভব না। তৃষ্ণা মানুষ না। মানুষ হলে তাকে স্যালুট দেয়া যেত। মানুষ না হোক, অন্তত অবয়ব থাকলেও তাকে স্যালুট দিতে পারতাম। তৃষ্ণার অবয়ব নেই, সে অদৃশ্য। আমি কাউকে কখনো বাতাসকে উদ্দেশ্য করে স্যালুট দিতে দেখিনি। তবে একথাও তো ঠিক, ফোনে সম্পর্ক হওয়া অদেখা প্রেমিকাকে আমরা ভালবাসার বুলি শুনাই। ফেসবুকে পরিচয় হওয়া জিএফের সাথে রিলেশনশীপ স্ট্যাটাস দিই। কিসি ইমোটিকন দিই। তারাও তো আমাদের কাছে অদৃশ্য, অন্তত কিছু সময়ের জন্য তো বটেই। অদৃশ্য মানেই তো অস্তিত্বহীন নয়! তৃষ্ণার অস্তিত্ব আছে, সে আমার এতো বড় উপকার করল। তাকে সামান্য স্যালুট কিংবা ন্যুনতম ধন্যবাদটুকু দিতে বাধা কোথায়? শুধু শুধু অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকতে যাব কেন?
আমি কল্পনা করবার চেষ্টা চালালাম। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে তৃষ্ণা নামের কোন মানবী। আমি অনেকটা মিলিটারীদের মতো ভঙ্গী করে তাকে স্যালুট দিলাম। সে আমার দিকে চেয়ে মুচকী হাসল... নাহ। আর কল্পনা করা যাচ্ছে না। তৃষ্ণার মুখটা ঠিক মতো কল্পনায় আসছে না। যাকগে, অন্তত স্যালুট তো দেয়া গেছে! এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা দরকার। বাড়ি গিয়ে একগ্লাস শরবত খাওয়া যাবে। বিলুকে বললেই ও করে দেবে। গ্লাসে বেশ কয়েকটা বরফকুচি দিতে বলতে হবে। শরবত পান করা মাত্রই তৃষ্ণা চলে যাবে। দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। তৃষ্ণা চলে যাচ্ছে। আমি তাকে স্যালুট ঠুকে বললাম, 'ধন্যবাদ, আবার আসবেন।'
বাড়ি এসে বিলাসবহুল সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। বিলুকে ডেকে শরবত দেবার কথা বলতে যাব, এমন সময় ধারাম করে পড়লাম। বিলু পড়ি-মড়ি করে ছুটে এল।
'লাগেনি, আমার কোথাও লাগেনি, বিলু। আসলে সোফা মনে করে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। ভাঙ্গা চেয়ারটার এই ঝক্কি সহ্য হয়নি। সত্যিই, আজকাল এমন কল্পনার ভূতে পেয়েছে না! জানো বিলু, কল্পনার একটা নিয়ন্ত্রন মাত্রা আছে। দশ হচ্ছে নিয়ন্ত্রন মাত্রার শেষ সীমা। আমি কল্পনার নিয়ন্ত্রন মাত্রা অতিক্রম করে ফেলেছি। আমি এখন যে স্তরে আছি তার নাম ভ্রম। অত্যাধিক ভ্রম হওয়া নাকি পাগলামির লক্ষণ! আচ্ছা বিলু, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?'
জবাবে বিলু ''মিউ মিউ'' করে উঠল। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মনে পড়ল, আমি বাদে দ্বিতীয় কোন মানুষ এবাড়িতে থাকে না।
পরিশিষ্ট
অচেনা-অজানা গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে হেটে চলেছি। সুর্যকিরণ আজও তার রুপ-বিরুপের পসরা সাজিয়েছে। প্রখর রৌদ্রে আমি ঘেমে নেয়ে একাকার। গ্রাম পেরিয়ে বিশাল এক মাঠে এসে দাড়ালাম। চারিদিকে ধু ধু রোদ্দুর। হঠাৎ কোত্থেকে এক বটগাছ এসে হাজির হল। খানিক আগেও এটা এখানে ছিল না। কেবলই মাটি ফুড়ে উদয় হয়েছে যেন! আমার এসব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। আমি বটগাছের ছায়ায় গিয়ে বসলাম।
হু হু করে দমকা হাওয়া বয়ে গেল। প্রশান্তিতে ঘোরলাগা ভাব চলে এসেছে। এমন সময়, কেউ একজন পাশে এসে বসল। গায়ের ঘ্রাণটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। সে আমার পরিচিত, অতি পরিচিত। কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারছি না। কে হতে পারে?... মনে পড়েছে, মনে পড়েছে আমার। এটা তো তরুর গায়ের ঘ্রাণ। আচ্ছা, তরুর চেহারাটা যেন কেমন? কি আশ্চর্য! তরুর গায়ের ঘ্রাণটা পর্যন্ত মনে আছে অথচ তার চেহারাটাই মনে নেই? খুব ইচ্ছে করছে, ঘাড় ফিরিয়ে তরুর মুখটা দেখি। কিন্তু আমি তাকালাম না। কে জানে? হয়তো দেখব, বাতাসে দোল খাচ্ছে ক্ষুদ্র এক তরুলতা। হয়তো তাকালেই হানা দেবে বাস্তবতারা, পতন ঘটবে কল্পরাজ্যের!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫১