আমার বন্ধু প্রয়াত জয়নাল আবেদীন তার নরসিংহগড়ের একটি বাড়ি আমার নামে উইল করে গেছেন। আমার মতো হতদরিদ্র একজন মানুষের এই খবর শুনে হার্টফেল করা উচিত। আমি হার্টফেল করলাম না। তবে মুর্ছা গেলাম। আমার জ্ঞান ফিরল তিনদিন পর। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। সেই জ্বর অগ্রাহ্য করে আমি তড়বড় করে উঠে বসলাম।
'আরে কর কি, কর কি?'
'উইল... উইলটা কোথায়?'
'কিসের উইল?'
জয়... আমার নামে... বাড়ি... দিয়েছে... সেই উইল?'
'জ্বরের ঘোরে কি সব উল্টোপাল্টা বকছো? ওরে আমার একি সর্বনাশ হল রে... ওনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে রে...'
পত্নী মহাশয়া ফুল ভলিউমে বিলাপ জুড়ে দিলেন। সেই বিলাপের শব্দ বোমার গর্জনকেও হার মানায়। কানের পর্দা ছিড়ে ফালা ফালা হয়ে গেল বলে ধারণা হল। আমি আবারো মুর্ছা গেলাম। যাই হোক, জ্বর থেকে সেরে উঠে উইল দেখিয়ে অবশেষে আমার স্ত্রীকে বিশ্বাস করানো গেল যে হ্যা, সত্যিই একখানা বাড়ি আমার করায়ত্ব হয়েছে। আরো একদফা চিল-চিৎকার পর্ব চলল। না, এবার আর বিলাপ নয়, হৈ-হুল্লোড়সুলভ চিৎকার।
''শুভ কাজে দেরি করতে নেই।'' এই প্রবচনটি আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। অনতিবিলম্বেই তাই নরসিংহগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। নিজের জিনিস যত তাড়াতাড়ি নিজের দখলে নেয়া যায় ততই মঙ্গল। লং জার্নি শেষে নরসিংহগড়ে যখন পৌছলাম, রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটার মতো হবে। ক্ষুধা-ক্লান্তিতে চোখ মুদে আসছে বারবার। পরমুহুর্তেই সব ভুলে আমার চক্ষু চড়কগাছ, যখন দেখি রিকশাওয়ালা বিশাল এক রাজপ্রাসাদের সামনে এসে রিকশা দাড় করাল। উচু পাচিলঘেরা সুবিশাল এই তে-তলা ভবনটিকে প্রাসাদের মতোই দেখাচ্ছে। আমার মেজাজ গেল বিগড়ে। আমি রিকশাচালককে কষে ধমক লাগালাম।
'এই মিয়া। গাঞ্জা খেয়ে রিকশা চালাও নাকি? এই, এই ব্যাটা তোমার মতলবটা কি?'
'গাল পাড়তাছেন ক্যা? আফনেই তো এইহানে আইতে কইলেন!'
অতঃপর পূর্ণদৈর্ঘ্য এক বাকবিতন্ডা শেষে বুঝতে পারলাম, এটাই আমার গন্তব্য। উইল করে আমাকে এই প্রাসাদই দেয়া হয়েছে। এবং এর বর্তমান মালিক এই নগন্য আমি। আমার গা-হাত-পা কাঁপতে লাগল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো মুর্ছা গেলাম আমি। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে খানদানি বলা চলে এমন এক পালঙ্কে শায়িত অবস্থায় আবিস্কার করলাম। প্রৌঢ় এক লোক আমার চোখে-মুখে পানি ছিটাচ্ছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে সে হাসিমুখে বলল,
'এখন কেমন লাগছে, স্যার?'
এতো বয়স্ক একজন মানুষের মুখ থেকে স্যার ডাক শুনে আমার লজ্জাই লাগল। লাগারই কথা। গোটাজীবনে এই প্রথম কেউ আমাকে স্যার বলে ডাকল। আমাদের মতো গরীবদের কেউ স্যার বলে সম্বোধন করে না। ভুল বলে ফেললাম। এখন তো আর আমি গরীব নই। এখন আমি প্রাসাদ মালিক। নিজেকে কেমন রাজ-রাজড়া বলে মনে হচ্ছে। ভাগ্যের কি পরিহাস! গরীব হওয়ায় সারাজীবন ন্যুনতম সম্মানটুকুও পেলাম না। ধনী বনে গিয়ে আজ একদিনেই...
'স্যার!'
'হু... ও। এখন ভালই লাগছে। আপনি...'
'আমি স্যার এই বাড়ির দেখাশোনা করি... মানে করতাম আরকি। আমার নাম ফজলু মিয়া।'
'করতাম বলছেন যে? এখন আর করেন না নাকি?'
'করি... মানে... এখন তো স্যার আপনার বাড়ি। আপনার অনুমতি না নিয়ে দেখাশোনা করি বলাটা বেয়াদবি হবে। আমি স্যার এখন আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। আপনি চাইলে আগের মতো বাড়ি দেখাশোনা করব, না চাইলে এই বাড়ি থেকে দুর হয়ে যাব।'
এতো তেল আগে কখনো কেউ আমায় মেরেছে বলে মনে হয় না। ফজলু মিয়াকে আমার পছন্দ হয়ে গেল। ইতোমধ্যে ফজলু মিয়ার স্ত্রী এসে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল, রাত একটা বাজতে চলেছে। দয়াপরবশ হয়ে আমি পানাহার গ্রহণ করলে সে কৃতার্থ হয়। খেতে খেতে ফজলু মিয়ার সাথে কথা বলে জানলাম, সে আর তার স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ এই বাড়িতে থাকে না। ফজলু মিয়ার তৈলমর্দন আর তার স্ত্রীর অতি উপাদেয় খাবারে বিগলিত হয়ে তাদেরকে এ বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়ে দিলাম। অনুমতি দেয়ার মাঝেও যে এতো আনন্দ আছে তা আজ প্রথম বুঝলাম।
রাতে ভাল ঘুম হল না। ভাল ভাল জিনিস বেশি ডোজে পড়লেও সমস্যা। আমি এখন সেই সমস্যায় পড়েছি। তৈলমর্দন, উপাদেয় খাবার তার সাথে আবার এই রাজপালঙ্কে শয়ন, সব মিলিয়ে আমার হজমে গন্ডগোল হয়ে গেল। পেটের হজমে গন্ডগোল হলে পেট খারাপ হয়। আমার হয়েছে মনের হজমে গন্ডগোল। তাই আমার ঘুম খারাপ হল।
পরদিন ফজলু মিয়ার সাথে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখলাম। ফজলু মিয়া আমাকে জানাল বাড়িটা আসলেই একসময় রাজপ্রাসাদ ছিল। তারপর অনেকদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে থাকে। তার আগের মনিব মানে আমার বন্ধু জয়নাল আবেদীন বাড়িটা কিনে ঠিক-ঠাক করে নেয়। কার কাছ থেকে কেনে তা তার জানার কথা নয়। সেটা নিয়ে আমারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমি রাজবাড়ির লোকদের পরিণতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। যে উপাখ্যান ফজলু মিয়া আমাকে শোনাল তার সারমর্ম অনেকটা এরকম-
নরসিংহগড়ের রাজা অতীন্দ্র বর্মা যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন রাজ্যের চরম দুঃসময় চলছে। মুহুর্মুহু আক্রমনের মুখে রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভঙ্গুরপ্রায়। অমিত বিক্রম অতীন্দ্র বর্মা শত চেষ্টাতেও রাজ্য রক্ষা করতে পারলেন না। শত্রুবাহিনী রাজধানীর উপকন্ঠে পৌছে গেছে প্রায়, এইসময় এক সাধুর আবির্ভাব হল। তার হাতে মাঝারি আকৃতির একটা ঘন্টি। সে রাজদরবারে হাজির হয়ে বলল, তার ঘন্টির এক আশ্চর্যজনক ক্ষমতা রয়েছে। তার ঘন্টির সাহায্যে সময়কে আগুপিছু করা যায়। কিন্তু তার জন্য ঘন্টিটা একটি বদ্ধকক্ষে স্থাপন করতে হবে। এমন কক্ষ, যেখানে একটা ছিদ্র পর্যন্তও নেই। আর হ্যা, ঘন্টি স্থাপনের আগে অতি অবশ্যই কোন উচ্চবংশীয় নবজাতকের বুকের রক্ত দিয়ে ঘরটাকে পবিত্র করে নিতে হবে।
অতীন্দ্র বর্মা এসব গাঁজাখুরি গপ্প বিশ্বাস করলেন না। বিশ্বাস করলেও তিনি সময়ের হাত থেকে পলায়ন করতেন কিনা সেটাও ভাববার বিষয়। বর্মাদের রক্তে কাপুরুষতার লেশমাত্র নেই কিনা! যাই হোক, এরপর চন্দ্ররাজেরা সহজেই রাজ্য দখল করে নেয়। অতীন্দ্র বর্মা এবং তার পরিবারের লোকদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বর্মাদের পরিণতিতে আজব ঘন্টির গল্প নতুন করে রাজ্যে আলোড়ন তোলে। কানাকানিতে সেকথা চন্দ্ররাজ অতীশ চন্দ্রের কানে যেতেও বাকি রইল না। তিনি সাধুবাবাকে ডেকে পাঠালেন। সাধুবাবা তাকে সব কথা খুলে বললে তিনি নিজ নবজাতকের বুকের রক্ত দিয়ে ঘন্টি স্থাপন করেন। যে ঘরে ঘন্টি স্থাপন করা হয় সাধুবাবার পরামর্শে সেটিকে কালকক্ষ নামে নামাঙ্কিত করা হয়।
কালকক্ষের মাধ্যমে সময় ভ্রমণের নিয়ম হচ্ছে, গোলাপ জলে স্নান শেষে সম্পুর্ণ নগ্ন হয়ে কক্ষে প্রবেশ করতে হবে। বদ্ধকক্ষে চোখ বুজে একমনে শুধুমাত্র ঘন্টির কথা ভাবতে হবে। এভাবে কিছুক্ষণ সাধনা করলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অচেতনপ্রায় অবস্থায় পৌছানো সম্ভব। এরপর ঘন্টি সামনের দিকে ঠেলে বাজালে ভবিষ্যত, পেছনের দিকে টানলে অতীত ভ্রমণের ব্যবস্থা। একবার ঘন্টি বাজালে এক শতাব্দী, দু'বারে দুই শতাব্দী এভাবে গণনা হবে।
রীতিমতো পঞ্জিকা দেখে চন্দ্ররাজ কালকক্ষে প্রবেশ করলেন। ভবিষ্যতে গিয়ে তার কোন লাভ নেই। তার প্রয়োজন অতীত ভ্রমণের। স্বীয় পুর্বপুরুষদের সাথে দেখা করা দরকার। তিনদিন তিনরাত কালকক্ষে অবস্থান করলেন তিনি। সাধুবাবা বাদে অন্যদের মনে তেমনটাই ধারণা হল। চতুর্থদিন ভোরে কালকক্ষের দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শোনা গেল। চন্দ্ররাজ ফিরে এলেন। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে ঘোষনা করলেন, আবার তিনি অতীত ভ্রমণে যেতে চান। এবার সপরিবারে যাওয়া হবে। পুর্বপুরুষরা বারবার করে তাকে পরিবারসমেত ঘুরে আসার অনুরোধ জানিয়েছে।
চন্দ্র রাজবংশ তৈরী, কালকক্ষের দ্বার উন্মোচনের আনুষ্ঠানিকতা চলছে। আশু অভিযানের সদস্যদের মনে টানটান উত্তেজনা। এই সেই শুভলগ্ন, এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এমন সময় সাধুবাবা এসে হাজির। তিনি বাধা দিয়ে বললেন, একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। তিনি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, কালকক্ষের মাধ্যমে শতাব্দীতে একবারই সময় ভ্রমণে যাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়বার এ চেষ্টা করলে বড় অনর্থ বাধবে। রাজামশাইও নাছোড়বান্দা। তিনি সময় ভ্রমণে যাবেনই। একবার গিয়ে তিনি ভালভাবেই ফিরে এলেন, আরেকবার গেলে অনর্থ বাধবে, এ কেমন কথা? তিনি ভাবলেন, সাধুবাবা কারো সাথে চক্রান্ত করে তার সময় ভ্রমণে বাধা দেবার জন্য এসব বলছেন। তাকে হত্যার আদেশ দিলেন তিনি।
সাধুবাবার দ্বিখন্ডিত লাশ মাড়িয়ে শুরু হল চন্দ্র রাজবংশের সময়যাত্রা। শুরু হল, কিন্তু শেষ হল না। চন্দ্ররাজেরা আর ফিরে আসেনি। তাদের সাথে কি হয়েছিল, তারা কি অতীতেই থেকে গিয়েছিল, না ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তা আর জানা যায়নি। চন্দ্র রাজবংশের ফিরে না আসার জের ধরে রাজবাড়ি আর তার কালকক্ষ সাধুবাবার পবিত্রাত্মার অভিশাপে অভিশপ্ত বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মুলত এরপর থেকেই প্রাসাদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। জয়নাল আবেদীনই আবার এ প্রাসাদে প্রাণের অস্তিত্ব ফিরিয়ে এনেছে।
এমন একটি রোমহর্ষকর উপাখ্যান শুনে পাক্কা একঘন্টা আমি ঝিম মেরে বসে রইলাম। ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে বিজ্ঞানীরা এই কালকক্ষের খবর পেলে কি করবে সে বিষয়ে অতি উচ্চস্তরের চিন্তা-ভাবনা করলাম। এরপর ফজলু মিয়াকে যে কথাটা বললাম তাতে তার চক্ষু ছানাবড়া।
'আচ্ছা ফজলু মিয়া, সেই কালকক্ষটি কি এখনো আছে এ বাড়িতে?'
'আছে, স্যার। তালাবন্ধ অবস্থায় আছে। বাড়ির ওদিকটার ছায়াও মাড়াই না আমরা।'
'এই ঘটনার পর এক শতাব্দী তো পার হয়ে গেছে, হয়েছে না?'
'জী, স্যার। আরো বেশি। এই প্রায় তিন শতক পার হতে চলল।'
'আমি গোসল করব। ঘরে কি গোলাপ জল আছে? না থাকলে আনাবার ব্যবস্থা করুন। আর কালকক্ষের তালাটা খুলে রাখুন।'
'আপনি... আপনি কি...'
'হ্যা, আমি সময় ভ্রমণে যাব। এক শতাব্দীর জায়গায় তিন শতাব্দী পার হয়ে গেছে। এখন তো আর কোন সমস্যা হবার কথা নয়!'
'ইয়ে মানে... তবুও স্যার। ওঘরে যাওয়াটা কিন্তু একেবারেই উচিত হবে না।'
'আপনার পরামর্শ চাইনি আমি। আপনাকে যেটা আদেশ করা হয়েছে আপনি সেটা করুন।'
'ই... ইয়ে... জী আচ্ছা, স্যার।'
পরিশিষ্টঃ
পাঁচ শতাব্দী ভবিষ্যতে পৌছতে কোন সমস্যা হয়নি আমার। সমস্যা হয়েছে এখানে পৌছবার পর। সম্পুর্ণ নগ্নভাবে চলাফেরার অভিযোগে এখানকার পুলিশ আটক করে আমায়। হাজতের বদলে এ্যাসাইলামে পাঠানো হয় আমাকে। আমাকে এরা পাগল ঠাহরে বসেছে। জানে না, এদের চেয়ে পাঁচ শতাব্দী প্রবীণ আমি। জানে না, কি রোমহর্ষকর ভ্রমণের স্বাদ পেয়েছি আমি। জানে না, আমি এমন সত্য জানি, এদের দুনিয়ার কোন মানুষ যা আজতক জানে না। আর সেই আমাকেই কিনা এরা পাগল ঠাহর করছে? পাগল তো এরা নিজেরাই। পাগল তো এই পাগলের ডাক্তারগুলো। নইলে সাল জিজ্ঞেস করলে এরা ২০১৬ বলে কেন? হিসেব মতে তো এদের ২৫১৬ বলবার কথা? যত্তসব পাগলের গোষ্ঠী!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই গল্পের বিষয়বস্তু সহ সমস্ত চরিত্রই সম্পূর্ন কাল্পনিক। যদি তা কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে হুবহু মিলে যায়, তবে সেটা একান্তই কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। সেজন্য লেখক কোনক্রমেই দায়ী থাকবেন না।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৬