আমার বন্ধু আফজাল একজন ''মহা-অবিশ্বাসী'' গোছের মানুষ। কোন কিছুতে তাকে বিশ্বাস করাবার একমাত্র টেকনিক হচ্ছে গিভ এ্যান্ড টেক। প্রথমে তাকে প্রমাণ দেখাতে হবে। [তাকে যদি বলা হয়, 'আমার ডায়রিয়া হয়েছে।' সে মুখ-চোখ কঠিন করে বলবে, 'প্রমাণ দেখাও।'] সেই প্রমাণ যদি তার কাছে যথোপযোক্ত বলে মনে হয়, তবে সে এই বিষয়ে একটা আলোচনায় আসতে পারে। এই আলোচনায় আসার মানে এই নয় যে সে বিষয়টি বিশ্বাস করে ফেলেছে। এর মানে তার সাথে একটি যুগপৎ তর্কযুদ্ধে নিজেকে অবতীর্ণ করা। যেখানে সুবুদ্ধি প্রয়োগেই হোক কিংবা কুবুদ্ধি ব্যবহারে, আফজালকে কাৎ করা এককথায় অসম্ভব।
বন্ধুবরের এইরুপ স্বভাবের সাথে অতিপরিচিত হওয়ায় এবার আমাকে একটু ভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে হল। মানে কিঞ্চিৎ চাটুকারিতার আশ্রয় নিতে হল আরকি! কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ের জন্য যখন আমাকে দৌলতগড়ের জনৈক বৃক্ষবাবার ফু গ্রহনের পরামর্শ দেয়া হল, তখন আমি আফজালের কাছে এসে বললাম,
'দোস্ত, জব্বর খবর আছে। দৌলতগড়ে এক বৃক্ষবাবা সামান্য ফু দিয়েই সব রোগ-বালাই সারিয়ে দিচ্ছে। কি কান্ড বল তো!'
'ঘোড়ার ডিম। কি করে যে তোরা এইসব বস্তাপচা গুজব বিশ্বাস করিস!'
'নারে দোস্ত, সত্যি। আমি নিজে দেখে এসেছি।' এটা মিথ্যে বললাম।
'কি দেখে এসেছিস? তোর গাছবাবা ফু দিয়ে ক্যান্সার-এইডস এইসব রোগ চিকিৎসা করছে?'
'গাছবাবা নারে পাগলা, বৃক্ষবাবা।'
'ঐ হল। দে, তোর গাছবাবার তেলেসমাতির প্রমাণ দে।'
এতোক্ষণে ব্যাটাকে কাদায় ফেলতে পারলাম। প্রমাণের দোহাই দিয়ে তাকে আমার সাথে বৃক্ষবাবার কাছে যেতে রাজি করিয়ে ফেললাম। বৃক্ষবাবার কাছে যাবার পর কি হবে, আদৌ তার কোন ক্ষমতা আছে কিনা, এসবের থেকে আফজালকে যেতে রাজি করতে পারাটাই আমার কাছে বিজয়সম বলে মনে হল। পরদিন দুপুর নাগাদ রওয়ানা হলাম আমরা।
কাঠবাজার থেকে দৌলতগড়ের দুরত্ব প্রায় পাঁচ মাইল। প্রথম দুমাইল বেবীতে বেশ আরামসেই যাওয়া যায়। এরপর থেকে শুরু হয় দুর্ভোগ। একটি মাত্র খেয়া থাকায় দুপাশের ঘাটে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ লাইন। সেই লাইন পেরিয়ে দু'ঘন্টার কম সময়ে ওপাড়ে পৌছতে পারাটাকে রীতিমতো সৌভাগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। আমরা বিরাট সৌভাগ্যবান। তাই দু'ঘন্টা পূর্ণ হবার এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড আগে নিজেদের অপর পাড়ে আবিস্কার করলাম। এরপরের সোয়া দুই মাইল পথ যেতে হয় ভ্যানে করে। ''আন্তর্জাতিক মানের'' সড়ক ব্যবস্থা হওয়ার কারণে সেখানে পাকস্থলি আলাদা হয়ে গেলে অবাক হবার কিছু নেই। ষোলকলা পূ্র্ণ করতে সবশেষ আধ মাইল হন্টনের ''সুব্যবস্থা'' আছে!
এতোসব ঝক্কি পেরিয়ে যখন আমরা বৃক্ষবাবার সান্নিধ্যে পৌছলাম, তখন গোধুলির শেষ আলোটুকুও নিঃশেষিত হতে চলেছে। বাবা তার প্রিয় ডেরা বটগাছের নীচে গভীর ধ্যানে মগ্ন। আমি ইতস্তুত করছি। এই লোক যদি এতো গুনী ব্যক্তিই হন তবে তো চারিদিকে লোকে-লোকারণ্য থাকার কথা। অথচ কাছে-পিঠে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আফজালের মতি-গতিও ঠিক সুবিধের ঠেকছে না। খেয়াঘাটে এসে সেই যে গোটা পাঁচেক ইংরেজি গালি কপচালো, তার পর থেকে আর একটা রা নেই মুখে! এখনো গুম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কোন ফন্দি আটছে কিনা কে জানে?
বাবার পোষাক-আষাক খুটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ্য করলাম। এনাকে সাধু-সন্নাসী হিসেবে ঠিক মানাচ্ছে না। সাধু-সন্নাসীরা গেরুয়া, লম্বা পাঞ্জাবী পড়বে। গলায় এক ডজন তাবিজ-কবচ ঝোলাবে। বড় বড় চুল-দাড়ি থাকবে তাদের। এনার সে সবের বালাই নেই। লুঙ্গি-ফতুয়া পরনে গলায় গামছা ঝোলানো লোকটি কি আসলেই সন্ন্যাসী, নাকি ভন্ড? এসব কথা ভেবে ভেবে টেনশনে আমার ঘন-ঘন হাই উঠছে, এমন সময় তিনি চোখ মেলে চাইলেন। নিতান্তই গোবেচারা চাহনী। নাহ, সারাদিনের পরিশ্রম সবটাই বোধহয় জলে গেল!
'কি চান বাবারা?'
আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
'আপনাদের আগমনের কারণটা?' আবারো প্রশ্ন করলেন তিনি।
'আপনিই কি গাছবাবা?' আফজালের পাল্টা প্রশ্ন এবার।
'লোকে আমায় বৃক্ষবাবা নামে ডাকে।'
'বাবা, আমি এক আজন্ম কোষ্ঠকাঠিন্য রোগী। একজীবনে এই একটি মাত্র রোগের পেছনে কতো ডাক্তার-বৈদ্য যে লাগালাম, অপদার্থদের কেউই ব্যাটাকে ঝেটিয়ে দুর করতে পারেনি। বেয়াদবি মাফ করবেন বাবা, একটু উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলে ফেলেছি। কি করব বলুন, নির্ঝঞাটে পায়খানা করতে পারার যে কি আরাম তা যে করেছে সেই বোঝে। গোটা জীবনভর এই স্বর্গসুখ থেকে আমি বঞ্চিত, ভাবা যায়?' পাছে আফজাল বেফাঁস কিছু বলে ফেলে, এই ভয়ে হড়হড় করে যে মেশিনগান আমি ছোটালাম, ততটাও বাকোয়াজ নই।
'আপনার মত বাচাল মানবের তো কোষ্ঠকাঠিন্য হবার কথা নয়।'
লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। বৃক্ষবাবাই উদ্ধার করলেন আমায়। কাছে ডেকে তার পবিত্র ফু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর রওয়ানা হতে বললেন আমাদের। কিছুদুর যাবার পর আমরা একটা বাগান সামনে পাবো। সেই বাগানের সব থেকে ছোট গাছটিতে কাঁচা-পাঁকা ফল ধরে আছে। সেখান থেকে তিনটি কাঁচা ফল সংগ্রহ করে আগামীকাল থেকে তিনদিন পর্যন্ত রাতের শেষ প্রহরে উঠে খালি পেটে খেতে হবে। তিনি বারবার করে বললেন, মনের ভুলেও যেন আমরা পাঁকা ফলে হাত না দিই।
'পাঁকা ফল খেলে কি হবে?' ফট করে জিজ্ঞেস করে বসল আফজাল।
'ধ্বংস, সুনিশ্চিত ধ্বংস।'
এতোক্ষণের নিতান্ত গোবেচারা মানুষটির হাব-ভাব মুহুর্তেই কেমন যেন বদলে গেল। অনেক রাত হয়ে গেছে। আমরা দেরি না করে রওয়ানা হলাম। আমি হতাশই হয়েছি। এতো রাতে বাগান থেকে ফল সংগ্রহ করতে হবে তা কে জানতো? ফল খেয়েই যদি অসুখ সারাতে হয়, তবে বাবার ফু'য়ের কি জোর? সবটাই কেমন বুজরুকি বলে মনে হচ্ছে। তাও যখন এতো কষ্ট করে এসেছি, ফলটা নিয়েই না হয় গেলাম। অসুখ আমার সারলেই তো হল!
ভাগ্য ভাল, সাথে টর্চ নিয়ে এসেছিলাম। নইলে আজ মুশকিলেই পড়তে হতো। টর্চ থাকাতে অতি অল্পক্ষণেই গাছটার হদিশ পাওয়া গেল। ছোট্ট গাছটাতে কাঁচা-পাঁকা যে ফলগুলো ধরে আছে চেহারায় সেগুলিকে আঙ্গুর আর চেরীর সাথে তুলনা করা চলে। তবে সাইজে একেকটা সুপারির সমান। একটি জিনিস খেয়াল করে দেখলাম, এই গাছটিসহ বাগানের সব গাছই কেমন অদ্ভুত দর্শন। এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না যে এমন সব গাছও এই পৃথিবীতে আছে। যাই হোক, এসব তুচ্ছ বিষয় আমলে না নিয়ে আমি ঝটপট তিনটি কাঁচা ফল ছিড়ে নিলাম। এমন সময় আচমকা যে কাজটি আফজাল করল, তাতে আমার অন্তরাত্মা খাচাছাড়া হবার জোগাড়। সে ফট করে একটা পাঁকা ফল ছিড়ে টুক করে তাতে কামড় বসিয়ে দিল। ফল খেতে খেতে সে উল্লসিত কন্ঠে বলল,
'কিরে, আমি ধ্বংস হলাম না তো! চল, চল তোর গাছবাবার কাছে। ব্যাটার ভন্ডামি আজকে জন্মের মতো ছুটিয়ে দেব।'
আমি তখন কোন কথা বলার মত অবস্থায় নেই। মাথাটা কেমন বনবন করে ঘুরছে। চোখে লাল-নীল বাতি দেখতে শুরু করেছি। আফজাল যে এই কান্ড ঘটিয়ে বসবে তা কে ভেবেছিল? আমি চাবি দেয়া পুতুলের মতো তার পিছু পিছু ফিরে চললাম বৃক্ষবাবার ডেরায়।
'কি ব্যাপার গাছবাবা? আমি এইমাত্র আপনার অদ্ভুত দর্শন গাছের কিম্ভুৎ দর্শন পাঁকা ফল খেয়ে এলাম। কই, আমি এখনো ধ্বংস হচ্ছি না কেন?'
'এতো তাড়া কিসের বৎস? সবুর কর, জানিস তো, সবুরে মেওয়া ফলে। না না, সবুরে শিকড় মেলে। হা হা হা... যা, আজকের মতো চলে যা। আবার আসবি তুই। আবার আমার বাগানে আসতে হবে তোকে। আজ থেকে তুই আমার বৎস, আমি তোর পিতা। আমি বৃক্ষবাবা, আর তুই... শিকড়মানব! হ্যা, তুই শিকড়মানব। হা হা হা...'
পরিশিষ্ট
আফজালকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেশের সেরা ডাক্তাররা মেডিকেল বোর্ড গঠন করেও যখন কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে ব্যর্থ হল তখন উচ্চস্তরের চিকিৎসার জন্য সরকার তাকে নিজ খরচে দেশের বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা নেয়। আমার ধারণা সরকার তাকে দেশ থেকে উপড়ে ফেলতে পেরে মহাখুশি। হবে নাই বা কেন? রোগটা তো ছোয়াচেও হতে পারে! কোন সরকারই বা চাইবে যে তার দেশের জনগন সব শিকড়মানবে পরিণত হোক? কিন্তু আমি জানি, রোগটা ছোয়াচে নয়। রোগটা... রোগটা আসলে রোগই নয়। আফজাল ফিরে আসবে। ফিরে আসতে আফজাল বাধ্য। বৃক্ষবাবার মহৌষধি গাছবাগানের সদস্য বৃদ্ধি করতে হবে যে!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই গল্পের বিষয়বস্তু সহ সমস্ত চরিত্রই সম্পূর্ন কাল্পনিক। যদি তা কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে হুবহু মিলে যায়, তবে সেটা একান্তই কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। সেজন্য লেখক কোনক্রমেই দায়ী থাকবেন না।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:২২