ছুটির দিনে ভোরে উঠতে একটুও ভালো লাগেনা জয়িতার । তার উপর এখন ভোরের রোদের সাথে ভেজা ভেজা কুয়াশাও মিশে থাকে । কাঁথাটা আরো জোরে আকড়ে ধরে সে । কিন্তু বেশিক্ষনের জন্য না... হঠাত মনে পড়ে যায় , আরে ! আজ তো ১৫ নভেম্বর । জয়ির জন্মদিন ।
আর কোন কিছু না ভেবেই বাথ রোব আর তোয়ালে নিয়ে সোজা বাথ্রুমে ঢুকে পড়ে সে । গোসল সারতেই মন আরও ফুরফুরে হয়ে গেলো ...একেবারে গোলাপ ভেজানো কুসুম পানি যে ! রুমে এসে মাথায় পেচানো টাওয়াল সরাতেই ভেজা চুল গুলো কাঁধে আছড়ে পড়ে । তোয়ালে দিয়ে যতই ঘষছে সেগুলো ততই এলোমেলো হচ্ছে ।
এবার সাজু করার পালা ...তার আগে কি একবার শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দেখবো নাকি ? পরে যদি ভালো না দেখায় ? যদি ওর পছন্দ না হয় ?সাদা শাড়িটা আয়রন করাও বাকি ! আচ্ছা চুল কি ছেড়ে রাখবো না বেঁধে ?
সব চিন্তা একবারে মাথায় হানা দিল । নো নো , এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব গুব্লে যাচ্ছে ... যেদিন ও আসার কথা থাকে সেদিন এমন্টাই হয় । উত্তেজনায় জয়িতা সব তাল্গোল পাকিয়ে ফেলে ।
নাহ ! এবার একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ভাবতে শুরু করা যাক প্রথম থেকে ।
নাস্তা করা হয় নি । প্রথমে খেয়ে নেয়া যাক না হলে মুখ শুকনো দেখাবে ... ভেবে ভেবে ধবধবে সাদা একটা রুটি বানিয়ে নিল ।
খাওয়া শেষে রুমে ফিরেই ডিভিডি প্লেয়ারটা ছেড়ে দিল । রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে । তপু এত সুন্দর করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারে ! না শুনলে বিশ্বাসই হয় না !
' আবার তপু-তে হারিয়ে গিয়েছিস , না ? ' নিজেকেই ধমক লাগালো ।
গান শুনতে শুনতে ড্রায়ার হাতে শুকিয়ে আসা চুল গুলো শুকাতে লাগল । হাওয়া পেয়ে লম্বা চুল একবার এদিক যায় তো একবার ওদিক যায় । নিজের এলোমেলো চুল নিয়ে এভাবে খেলতে জয়িতার খুব ভালো লাগে । ' আচ্ছা , ও কি কখনো আমার চুল নিয়ে খেলতে চাইবে ? ... কিন্তু ওর যে ঢেউয়ের মত চুল পছন্দ । আর জয়িতার চুল মোটেও উত্তাল ঢেউয়ের মত না , নদীর মত শান্ত , নিশ্চুপ ।
ভাবতে ভাবতে সে আবার হারিয়ে যায় ।
আসলে যেদিন থেকে তপু ছেলেটা তার জীবনে চলে এসেছে তার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে সে কেবল হারিয়েছে নিজেকে , তপুর মাঝে ।
ছেলেটা আর সবার থেকে অন্যরকম । নিজেকে খুব কঠিন হৃদয়ের বোঝাতে চায় । জয়িতাও প্রথমে তাই ভেবেছিল । কিন্তু , এই সেদিন যখন ছোট্ট বাচ্চাদের মত তার দুয়ারে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল , সেদিন জয়িতা চুপ করে থেকেও যেন হঠাত সব বুঝে ফেলেছিল ।
টিউট । ওহ ফোনটাকে চার্জ করে নেয়া উচিত । চারজার কানেকশন লাগিয়ে জয়িতা এবার শাড়ি দুটো হাতে নিল ।
প্রায় বছর দুয়েক আগে সিলেট থেকে ফোন করে একবার তপু বলেছিল , 'আচ্ছা, আমি ঢাকায় এলে তুমি কি শাড়ি পড়তে পারো ? '
আজ জয়িতা শাড়ি পড়বে ঠিক করেছে ।
কোনটাতে ওকে বেশি সুন্দর লাগবে ? সাদা জর্জেটে? নাকি এই নীলরঙা সিল্কে?
সাদা শাড়িটা ওর দাদির । শাড়িটার মধ্যে কেমন জেনো একটা মায়া জড়ানো । আর নীল শাড়িটাটা ওর মায়ের । যেদিন এই শাড়িটা প্রথম পড়েছিল , মা অদ্ভুত দৃস্টিতে একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন ,
-তোমার রাজপুত্র যেদিন প্রথম তোমাকে দেখতে আসবে তোমাকে এই শাড়িটা পরাবো । দেখবা, তোমার থেকে আর চোখই ফেরাতে পারবে না ।
-কি যে বলো আম্মু ! যাও , আমি পরবো না। লজ্জা পেয়ে জয়ি ওটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিয়েছিল ।
- আরে ফেলছো কেন... তোমাকে এটা দিয়ে দিলাম .. তোমার আল্মিরাতে রেখে দাও । আমার মেয়ে কবে এত বড় হয়ে গেলো , টেরই পেলাম না । একদিন তো তোমাকে রাজপুত্রের হাতে দিয়েই দিতে হবে ।
- শোন আম্মু, আমি তোমাদের রেখে কোত্থাও যাবো না । আমার এই শাড়িও লাগবে না ।
- আরে ... মেয়ে আমার রাগ করে খালি । আচ্ছা যেও না ...
জয়িতার ভেজা চুল শুকিয়ে এসেছে । গায়ে লোশন লাগাতে লাগাতে ভাবলো ,
আচ্ছা , ওর জন্য একটা কেক বানালে কেমন হয় ? এই কয়দিন ক্যাম্পে কি খেয়েছে তা তো ভালই জানা আছে ।
কিচেনে ঢুকে একে একে ময়দা , বেকিং পাউডার , চকোপাউডার , বাটার - সব বের করে সাজালো । আজ বাসায় কেউ নেই , তাই কিচেন একদন ফ্রি ! ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে নিয়ে আসলো । শুরু হলো কেক বানানো । গরম ওভেনে ব্যাটার-টা ঢুকাতেই কেমন শিহ্রিত হল , কেমন হবে কে জানে ! ওর ভালো লাগবে তো ! একবার শখ করে লাজানিয়া বানিয়ে কি কেলেঙ্কারিটাই না হল, ঠান্ডা লাজানিয়া খেতে যে কতটা খারাপ সেটা পরে বুঝতে পেরে ঘাসফড়িঙ এত্ত লজ্জা পেয়েছিল । ছি ! আর ও-ও কি কম ! ওকে কে বলেছিল ওই অখাদ্য গুলো খেতে ! কপ কপ করে সব গুলো খেয়ে ফেলসে এমন ভাবে যে বিরাট সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে !
কেক্টা যতই বেক হচ্ছে আর জয়ির হারটবিট ততই বেড়ে যাচ্ছে । সময় হবার আগেই টুথপিক দিয়ে একটু একটু করে দেখে লাগল ...শেষে যখন বের করে আনল , উম্মম্ম ... দারুন গন্ধ বের হচ্ছে তো !
আচ্ছা , এখনো কেন ফোনটা আসছে না ? কাপা হাতে ডায়াল করল ০১৭১... ফোন বন্ধ ।
জয়িতার উৎসাহ দমে যেতে লাগল । তবে কি আজও ...
নাহ ! আজ হবেই হবে । ইটক্স বিন সিক্স মান্থস এন্ড মোর আফটার অল দে ডিডিন্ট মিট !
আবার ডায়াল করল । ফোন বন্ধ ।
হতাশা ঢাকতে জয়িতা এবার শাড়িটা পড়ে নিল । গলায় সোনার একটা চেইন সবসময়ই পড়া থাকে । কানে এক জোড়া দুল পড়ে নিল । দুহাত ভরে তার কখনো চুড়ি পরা হয় না । আজ পড়ল । কাচের চুড়ি টুংটাং শব্দ করছে । চোখের নিচে হাল্কা একটু কাজলও টেনে দিল । ওর চোখগুলো তেমন আকর্ষণীয় না । হয়ত এজন্যই তপু ওর দিকে না তাকিয়ে এতটা সময় থাকতে পারে ।... সময় আস্তে আস্তে এগুচ্ছে । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে । জয়িতা চুপ করে বসে আছে ।
বিকেলের সূর্য তার চোখের কোনে ডুব দিল ।
অন্ধকারে ঝাপসা চোখে জয়িতা নিজের দিকে তাকাল । শুধু চোখ না, ওর আসলে কোন কিছুই সুন্দর না । কোলের উপর হাত দুটো চুপ করে পরে আছে , চুড়িগুলোও আর শব্দ করছে না । এই হাতে চুড়িও মানায় না । এজন্যই তপু হাত দুটো ধরার জন্য কখনো ছুটে আসে না ।
.
.
.
.
.
.
.
.
জয়িতা খালি বাসার সবগুলো বাতি নিভিয়ে বারান্দার কোনে বসে আছে । তার আঁচল ফোটা ফোটা জলে ভিজুক আর নাই ভিজুক , সেটা না হয় অজানাই থাক