১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭
জামায়াতের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে
সমকাল প্রতিবেদক
গত পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং এর নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাস-দুর্নীতিতে জড়িত নন বলে তারা দাবি করে থাকেন। গত দশ বছর পর পর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় এবং বহু সংখ্যক স্থানীয় নেতাকে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি আইনে শাসন চালিয়ে দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তাতে জামায়াতের কেউ এখনো ধরা না পড়ায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হয়ে খুন-জখমে লিপ্ত এই দলটি শদুব্দ বলে দাবি করার সুযোগও পাচ্ছে। কিন্তু সমকালের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জামায়াতের চার জন সাবেক সংসদ সদস্য ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাদের পলাতক হওয়ার কারণ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের 'গডফাদারদের' চেয়ে ক্ষমতায় থাকা জামায়াতি 'গডফাদারদের' সন্ত্রাসের চিত্র কোনো অংশে কম ভয়াবহ নয়। তারা প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় কায়েম করেছিলেন একচ্ছত্র রাজত্ব ও কার্যত জামায়াতি শাসন। গড়ে তুলেছিলেন ভয়ঙ্কর সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। বিরোধী শিবিরের ওপর চালিয়েছেন হত্যা-নির্যাতন-সন্ত্রাস। চালিয়েছেন টেন্ডারে হস্তক্ষেপ ও চাঁদাবাজি। রাতারাতি হয়েছেন পাহাড়সম সম্পদের মালিক।
সাঈদী
জোট সরকারের পাঁচ বছরে পিরোজপুর-১ নির্বাচনী এলাকায় ৪৯৭টি কাবিখা-কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ১৫৫ টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া টিআর প্রকল্পের আওতায় স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির, রাস্তা সংস্কার ও মাঠ ভরাটের নামে ১ হাজার ২৯৭টি প্রকল্পের ২ কোটি ৬ লাখ ৮৭০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এসব প্রকল্পের নামমাত্র কাজ করে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ও চাল গম আত্নসৎ করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পের সঠিক কাগজপত্রও সংশ্লিষ্ঠ দফতরে নেই বলে জানা গেছে।
জোট সরকারের শাসনকালে সাঈদী ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে মাত্র তিনটি ইউনিয়নকে নিয়ে জিয়ানগর নামে নতুন উপজেলা গঠন করেন। তিনি প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে তার নিজ বাড়ি সাঈদখালী পর্যন্ত নির্মাণ করিয়েছেন বিশাল রাস্তা। বাড়ির সামনে তথাকথিত 'সাঈদী বাজার' নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করে তার পেছনে ব্যয় করেছেন ৬ লক্ষাধিক সরকারি টাকা। বাজারের বটবৃক্ষটি রক্ষণাবেক্ষণেই খরচ করেছেন ৪৫ হাজার টাকা।
গত পাঁচ বছরে সাঈদী প্রতিষ্ঠিত এসডি মদিনাতুল দাখিল মাদ্রাসা, সাঈদী ফাউন্ডেশন, পিরোজপুর ইসলামিয়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, ভৈরমপুর ইসলামিয়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস কলেজ, তাফহিমুল কুরআন মাদ্রাসা, দরুল কুরআন মহিলা মাদ্রাসা, খলিশাখালী মহিলা মাদ্রাসা, নাজিরপুর দাখিল মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা ও প্রতিষ্ঠানে অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেই তৈরি করেছেন বহু মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বসিয়েছেন নিজেদের লোক।
অন্যদিকে নাজিরপুর কোষকাধী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শুসেন হালদারকে বরখাস্ত করে সেখানে নিয়োগ করা হয়েছে সাঈদীর পছন্দের ব্যক্তিকে। উপরন্তু অধ্যাপক শুসেনকে পুলিশি নির্যাতনের শিকার এবং মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়েছে।
সাঈদীর সুবাদে তার ভাই মোস্তফা সাঈদী ও ভাতিজা রুমী সাঈদীর ভয়ে তটস্থ থাকত বালিপাড়া, সাঈদখালী ও পত্তাসী এলাকার লোকজন। সাঈদখালীর চরে ছিল মোস্তফা সাঈদীর লাঠিয়াল বাহিনী। এছাড়া খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদারের সঙ্গে রুমি সাঈদীর সখ্য থাকার কারণে এলাকায় সে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক।
জোট সরকার ক্ষমতায় থাকায় পিরোজপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের চেয়েও বেশি লাভবান হয়েছে জামায়াত নেতাকর্মী এবং সাঈদীর আত্নীয়স্বজন। জেলা জামায়াতের সেত্রেক্রটারি মাওলানা শফিকুল ইসলাম মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মাওলানা শফিকের ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো বিভিন্ন দফতরের কর্তাব্যক্তিদের। নিজ নামে কোনো লাইসেন্স না থাকলেও সততা এন্টারপ্রাইজ, গালিব এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে এসব কাজ নেওয়া হতো।
পিরোজপুর বন বিভাগে চাকরিরত জামায়াত নেতা খন্দকার জাকির নামে-বেনামে ঠিকাদারি কাজ করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন। গত পাঁচ বছরে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এলাকায় পুলিশ প্রটোকল নিয়ে এবং সাইরেন বাজিয়ে চলাচল করতেন। ক্ষমতার মেয়াদপূর্তির পর তিনি এলাকায় এসে পুরোদমে নির্বাচনী কর্মকা- শুরু করেন। নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্রও জমা দেন। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা, গণসংযোগকালেও পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করতেন। তবে জরুরি অধ্যাদেশ জারির পর তাকে আর এলাকায় দেখা যায়নি।
সাঈদী তার গ্রামের বাড়িতে কোনো বাড়ি বা সম্পদ না করলেও ঢাকায় তার পাঁচতলা বাড়িসহ বহু সম্পদ এবং তার ছেলেদের নামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন।
'খুনকার' থেকে 'অৎকা সৈয়দ' :
পরিচিত ছিলেন খন্দকার তাহের হিসেবেই। এখন তিনি সৈয়দ তাহের। গ্রামের মানুষ তাকে ডাকে 'অৎকা সৈয়দ'। বাবার ছিল তাবিজ-কবজের ব্যবসা। লোকে 'খুনকার' (খন্দকার) বলত। পাঁচ ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় তাহের ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের সুবাদে চৌদ্দগ্রাম আসনের (কুমিল্লা-১২) সাংসদ হয়ে যান। অভিযোগ আছে, নির্বাচনের দিন সবক'টি কেন্দ্র দখলে নিয়ে জয় নিশ্চিত করেন। এরপর চৌদ্দগ্রামকে 'আওয়ামী লীগমুক্ত' করতে কাছা মেরে নামেন। সেই থেকে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের অভয়ারন্যে পরিণত হয় চৌদ্দগ্রাম।
উপজেলার রক্তঝরা ইউনিয়ন আলকরার পশ্চিম ডেকরা গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে তাহেরের জন্ম। নিজ ইউনিয়নে তার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার পবরাউ এক এক করে পাঁচটি হত্যাকা- ঘটে। এর পর আলকরার পার্শ্বার্বতী গুণবতী আর জগন্নাথদীঘির একাংশ পরিণত হয় তাহেরের সাম্রাজ্যে। দরিদ্র পরিবারের তাহের বনে যান গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল মিলের মালিক। আছে আদম ব্যবসা। কুমিল্লার বেসরকারি সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তিনি হন চেয়ারম্যান। নারায়ণগঞ্জে হায়দরি টেক্সটাইল মিলস ও গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তার তিন ভাই সাদেক, হারুন ও সরোয়ার।
১৯৯১ সালেই তিনি চৌদ্দগ্রামের আসনটি করায়ত্ত করতে প্রতি্টন্ি্টতা শুরু করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগের মুজিবুল হকের কাছে হেরে যান। এরপরই শুরু করেন সন্ত্রাসী লালন। তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে খুন হন আলকরা ইউনিয়নের কুলাসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা জসীম (২৫), একই ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের যুবলীগ কর্মী আনোয়ার (৩০), ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর (২২), সোনাইছা গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল (৪০) ও কুলাসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা বাদল (২৫)। কুপিয়ে হত্যা করা হয় গুণবতী ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাজী আবদুল মালেককে (৬০)। সম্প্রতি জোট সরকারের ক্ষমতার শেষ সময়ে চিওড়া ইউনিয়নের শাকতলা গ্রামের যুবলীগ নেতা হেদায়েত উল্লাহকে (৩৪) অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটা জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের কাজ বলেই অভিযোগ করা হয়েছে।
তাহেরের সন্ত্রাসে পঙ্গু হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। বোমার আঘাতে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লক্ষ্মীপুরের যুবলীগ কর্মী হেলানের (২৮) ডান পা ও একই গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ আলীর পা। কুলসার গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী জানু (৩০) এখন অন্দ। তাহেরের বাহিনীর বীভৎসতার ইতিহাস ও সংখ্যা বেশ দীর্ঘ।
২০০১-এর নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন তাহের। তাই কৌশল হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ সহস্রাধিক ক্যাডারকে আনা হয় চৌদ্দগ্রামে। রাখা হয় সমর্থকদের বাড়িতে। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো পরিণত হয় ওইসব ক্যাডারের আস্তানায়। গ্রামবাসীকে বলে দেওয়া হয় ওরা সবাই 'মেহমান'। ভোটারদের জানিয়ে দেওয়া হয় ভোটকেন্দ্রে না যেতে। কারণ এবার ভোট দেবে মেহমানরা। নির্বাচনে জয়লাভের পর এলাকাবাসী বলতে শুরু করেন 'মেহমানের এমপি'।
নবম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একই কায়দায় জিততে এবারো মেহমানদের আনা হয়েছিল। কিন্তু দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরদিন দ্রুত পালিয়ে যায় মেহমানরা।
২০০১-এর নির্বাচনে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরে নির্বাচনী কাজে অংশ নিয়েছিল ওইসব ক্যাডার। সে সময় কাশীনগরে সেনা পোশাক পরা এক ক্যাডার আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে বোমাসহ ধরা পড়ে। উত্তেজিত জনতা তাকে পুলিশে তুলে দিলেও ক'দিন পরই সে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়।
২০০১-এর নির্বাচনে জয়লাভ তাহেরকে অপ্রতি্দ্বন্দী করে তোলে। শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিধন ও বিএনপি তাড়াও অভিযান, টেন্ডার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জমি দখল। তার ছোট ভাই সৈয়দ একরামুল হক হারুন চৌদ্দগ্রামের 'ছোট সাহেবে' পরিণত হন। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা হয় ক্যাডার বাহিনী। এ চত্রেক্রর অপর দুই সদস্য ছিলেন মেশকাতউদ্দিন সেলিম ও উপজেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহজাহান। তাদের নেতৃত্বে প্রতিটি ইউনিয়নে ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনীর অন্যরা হলেন বাচ্চু মেম্বার, হামিদা চোরা, রাসেল, রিপন, মমিন, মামুন, অলি আহম্মদ, আবু সায়েদ, আঃ আজিজ, বেলাল, জামাল, মহিন ডাইক, মোবারক, মিঠু ওরফে মিঠাইয়া চোরা, হানিফ, বাহার প্রমুখ।
উপজেলার কালুজুড়ি খালের ৩০ হেক্টর এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের লিজ পেয়েছিলেন মেসার্স এমআর এন্টারপ্রাইজের মিজানুর রহমান। তাহেরের ক্যাডার গাজী আবু বকর, ইকবাল হোসেন কাজল, জাফর ইকবাল লিটন, খোকন ও জহির ঠিকাদারকে মারধর করে থানায় সোপর্দ করে এবং বালুমহালটি দখল করে রাখে। তার নিদরাউশে উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপুর মৌজার দীঘিটি ২০০১ সালের ১১ অক্টোবর অবৈধভাবে দখল করে নেয় জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। ওই দখল অভিযানে নেতৃত্ব দেয় জামায়াত ক্যাডার শাহাবউদ্দিন ও নূর ইসলাম। দীঘিটি জবরদখলের পর কুমিল্লা সার্কিট হাউসে এক সভায় সাবেক সাংসদ তাহের বলেছিলেন, 'এখন থেকে আমি না বললে চৌদ্দগ্রামে কোনো পাতা নড়বে না।'
উপজেলার বাতিসা গ্রামের অসহায় মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন ১৫ বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোবিন্দমানিক্য দীঘি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে আসছিলেন। পরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা লিজ নিয়ে একটি অস্থায়ী খাবার হোটেল খোলেন। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই দীঘিটি দখল নিয়ে নেয় তাহেরের ক্যাডাররা। হোটেলটি দখল করার পর উল্লাসে মেতে রান্না করা খাবার রাস্তায় ছিটিয়ে আনন্দ করেছিল ক্যাডার বাহিনী।
শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালের দীঘির চন্দ্র নাগের দান করা বিদ্যালয়ের ৮ শতক জায়গাও জবরদখল করেন এ সাবেক সাংসদ। দখল করা জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন 'ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ সংস্থা'। চৌদ্দগ্রামের ঐতিহাসিক জগন্নাথ দীঘিও জবরদখল করে ভোগ করেন ওই সাবেক সাংসদ ও তার ক্যাডার বাহিনী।
২০০৩-এর ২৯ অক্টোবর জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা পল্লী বিদু্যতের ডিজিএমকে প্রকাশ্যে মারধর করে। এলাকার ডাকাত ও সড়ক ডাকাতরাও জোট সরকার আমলে জামায়াত-শিবির করেছে। চোরাকারবারিরাও তার দলে নাম লিখিয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লালবাগ থেকে মোহাম্মদ আলী বাজার পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সীমান্তর্বতী মহাসড়কে চোরাকারবারি ও সড়ক ডাকাতির মূল নেতা তাহেরের ছোট ভাই হারুন ওরফে ছোট সাহেব।
সাতকানিয়ার সম্রাট :
কালো নেকাব আর বোরকা ছাড়া সাতকানিয়ায় কোনো নারী ঘর থেকে বের হতে পারেন না। 'বেপর্দা চলাফেরার' ওপর অলিখিতভাবে এ 'আইন' চালু করেছিলেন চট্টগ্রামের জামায়াতি গডফাদার ও সাতকানিয়া আসনের সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী। এ আইন কার্যকর করার দায়িত্ব ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্টে্প সজ্জিত শাহজাহানের বিশাল ক্যাডার বাহিনীর। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি তার এলাকায় চালিয়েছেন জামায়াতি শাসন। তার প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরও নগরীর দিদার মার্কেটের জামায়াত অফিসে দফায় দফায় সাংগঠনিক সভা করেছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবারও নিজ নির্বাচনী এলাকায় মাহফিলে বক্তব্য রাখেন। শনিবার রাতে নগরীর রাহাত্তারপুলস্থ শাহজাহানের বাসভবনে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় ধরে পুরো সাতকানিয়া ছিল ক্ষমতাধর শাহজাহান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে। তার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত স্থানীয় জামায়াত নেতা নুরুল হক, আবুল ফয়েজ ও আতাউল্লাহসহ আরো কয়েকজন চিহিক্রত জামায়াত নেতা সাতকানিয়া থানা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বিশেষ করে জোট সরকার আমলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল_ থানায় মামলা হবে কি হবে না, মামলার ধরন কী হবে কিংবা আসামি ছাড়া পাবে কি পাবে না সবকিছুর নিদরাউশনা দিতেন শাহজাহান চৌধুরী! তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে অসহায় আত্নসমর্পণ করে প্রশাসন। এ নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে ছিল স্থানীয় বিএনপির তুমুল ্টন্্ট।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা শাহজাহান চৌধুরী গত শতকের আশির দশক থেকে সাতকানিয়ায় প্রথম ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেন। ১৯৯১ সাল থেকে ওই ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সাতকানিয়ায় শুরু হয় ত্রাসের রাজত্ব। এরপর সেখানে পড়তে থাকে একের পর এক লাশ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীর জয়লাভের পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখেন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আমিনুল ইসলাম। কিন্তু তাকে ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার অপরাধে ২০০৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শাহজাহানের ক্যাডার বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, একই অপরাধে ক্রসফায়ারে ফেলা হয় চেয়ারম্যান আহমদু্যা ও যুবদল নেতা মিনহাজকে।
শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় একাধিক হত্যাকা-সহ ৩০টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে কেবল জোট সরকারের ক্ষমতাকালে হত্যা মামলাসহ প্রায় ২০টি মামলা থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় খালাস পেয়ে যান তিনি। তার বিরুদ্ধে সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কবির, কাঞ্চনা ইউপি মেম্বার মোঃ হাফেজ, মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ কাদেরী, মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা নজির আহমদকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করলেও শাহাজাহান তার তিন ভাইকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন আমেরিকায়। আরেক ভাইকে নিয়োগ দিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠিত 'জামায়াতের গোডাউন' বলে পরিচিত সাতকানিয়া আদর্শ মহিলা কলেজের শিক্ষক পদে। অপর ভাই আবদুল আউয়াল টুকু ও ভাগিনা মুরাদকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিত্তবৈভব দেখাশোনার।
২০০৫ সালের শেষের দিকে শুল্ক্কমুক্ত ৫০ লাখ টাকা দামের গাড়ি কিনে ফায়দা লুটতে শাহজাহান তা বিক্রি করে দেন ব্যবসায়ী নুর আহমদের কাছে। এছাড়া সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান ও পাকিস্তানে তার ব্যবসা রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। বন্দরনগরীর রাহাত্তারপুলের শিবির নিয়ন্ত্রিত কমার্শিয়াল ইনসি্টটিউট সংলগ্ন এলাকায় তার রয়েছে তিনতলা বিলাসবহুল বাড়ি।
খুলনার আমির :
নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে যাওয়া খুলনা-৫ আসনের সাবেক সাংসদ ও নগর জামায়াতে ইসলামীর আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার বহাল তবিয়তে রয়েছেন। নিজে গাড়ি বাণিজ্য, চরমপন্থি কানেকশন, ভাইদের দিয়ে জুট মিল ও ঘের দখল, বিভিন্ন সরকারি দফতরের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি প্রকল্পের কমিশন গ্রহণসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে জানা যায়। 'আঙুল ফুলে কলাগাছ' বনে যাওয়া গোলাম পরওয়ার যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযানেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন।
গোলাম পরওয়ার আশির দশকের শেষ দিকে নগরীর বয়রা ইসলামিয়া কলেজের প্রভাষক ছিলেন। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় সভাপতি হন। তখন সংগঠন থেকে 'ফুল টাইমার' (সংগঠনের কাজ ছাড়া অন্য কিছু করা যাবে না) হিসেবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো। ১৯৯৬ সালে মহানগর জামায়াতের আমির নির্বাচিত হন। সাংসদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সংগঠন থেকে পেতেন মাসে সাত হাজার টাকা। এই টাকায় চলত তার সংসার।
২০০১ সালের নির্বাচনে খুলনা-৫ আসন থেকে জোট প্রার্থী হিসেবে চরমপন্থি দল নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিরর প্রধান মৃণাল ও তার বাহিনীর সহযোগিতায় এমপি নির্বাচিত হন। কিছুদিন পর ৩৯ লাখ ১ হাজার ৮৭৯ টাকায় শুল্ক্কমুক্ত এমএল-৫০০ অফরোড ভেহিকেল (মাসর্িডিজ বেঞ্জ) গাড়ি আমদানি করেন। গাড়িটি ১ কোটি ১৮ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। এ গাড়ি বাণিজ্যে লাভ হয় প্রায় ৮০ লাখ টাকা। র্বতমানে তিনি জাপানি টয়োটা রাভা গাড়িতে চড়েন। ২০০২ সালে বাড়ির দুই রুম সম্প্রসারণ করেছেন। সে বছরের আগস্টে ভাই মিয়া গোলাম কদু্দুস নগরীর আটরা শিল্পাঞ্চলের আফিল জুট মিল দখল করে মিলের গদুামে রক্ষিত প্রায় ৩০ লাখ টাকার পাটসহ অন্যান্য মালামাল বিক্রি করে দেন। মিল মালিক আবদুল কাদের পিন্টু খানজাহান আলী থানায় জিডি করলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পরে অবশ্য গোলাম কদু্দুস মিল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
সাবেক সাংসদের দু'ভাই মিয়া গোলাম কদু্দুস ও গোলাম খায়ের ডুমুরিয়ার শরাফপুর ইউনিয়নের চাঁদগড় এলাকায় ৪০০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ঘের করছেন। কিন্তু জমি মালিকদের লিজের টাকা পরিশোধ করেননি বলে অভিযোগ। এছাড়া ডুমুরিয়ায় ছোট-বড় অসংখ্য ঘের রয়েছে। অধিকাংশ ঘের থেকে উপঢৌকন হিসেবে গোলাম কদু্দুস প্রতি মাসে মোটা অগ্ধেকর টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। পরোয়ারের পরিবারের লোকজন শিরোমণি বিসিক শিল্প নগরীর জায়গা দখল করে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে পোলট্রি ফার্ম করেছেন।
ফুলতলা ও ডুমুরিয়ায় যত টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের কাজ হয়েছে তার অধিকাংশই জামায়াতের থানা আমির ও রোকনদের মাধ্যমে করিয়েছেন গোলাম পরওয়ার। জোট সরকারের আমলে যেসব গভীর নলকূপ এসেছে তার বেশিরভাগ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। জোট সরকারের ৫ বছরে ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলায় যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। অভিযোগ আছে, অধিকাংশ কাজ থেকেই গোলাম পরওয়ার ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়েছেন গোলাম কদু্দুসের মাধ্যমে। দু'ভাই মিয়া গোলাম কদু্দুস ও গোলাম খায়ের ফুলতলা এবং ডুমুরিয়ার এলজিইডিসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে মাসে লাখ টাকা আয় করেন।
মৃণাল বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে এখনো সাবেক সাংসদ পরওয়ারের সখ্য রয়েছে। ডুমুরিয়ায় এখনো পুলিশের কথিত সোর্স বাহিনী সক্রিয়। এসব সোসরাউর অনেকেই বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থক। তাদের আশ্রয়দাতা জনাব পরওয়ার।
ভাই মিয়া গোলাম কদু্দুস আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আকরাম হোসেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে বোমা হামলা চালায় বলে অভিযোগ। পাশাপাশি বোমা হামলার মামলায় গ্রেফতার হওয়া চরমপন্থি নুরুল ইসলাম গত বছরের ৯ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিল, মিয়া গোলাম কদু্দুসের নিদরাউশে তারা এ বোমা হামলা চালায়। অবশ্য পরে ৩১ জুলাই সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহার করে নেয়।
গত পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং এর নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাস-দুর্নীতিতে জড়িত নন বলে তারা দাবি করে থাকেন। গত দশ বছর পর পর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় এবং বহু সংখ্যক স্থানীয় নেতাকে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি আইনে শাসন চালিয়ে দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তাতে জামায়াতের কেউ এখনো ধরা না পড়ায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হয়ে খুন-জখমে লিপ্ত এই দলটি শদুব্দ বলে দাবি করার সুযোগও পাচ্ছে। কিন্তু সমকালের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জামায়াতের চার জন সাবেক সংসদ সদস্য ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাদের পলাতক হওয়ার কারণ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের 'গডফাদারদের' চেয়ে ক্ষমতায় থাকা জামায়াতি 'গডফাদারদের' সন্ত্রাসের চিত্র কোনো অংশে কম ভয়াবহ নয়। তারা প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় কায়েম করেছিলেন একচ্ছত্র রাজত্ব ও কার্যত জামায়াতি শাসন। গড়ে তুলেছিলেন ভয়ঙ্কর সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। বিরোধী শিবিরের ওপর চালিয়েছেন হত্যা-নির্যাতন-সন্ত্রাস। চালিয়েছেন টেন্ডারে হস্তক্ষেপ ও চাঁদাবাজি। রাতারাতি হয়েছেন পাহাড়সম সম্পদের মালিক।
সাঈদী
জোট সরকারের পাঁচ বছরে পিরোজপুর-১ নির্বাচনী এলাকায় ৪৯৭টি কাবিখা-কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ১৫৫ টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া টিআর প্রকল্পের আওতায় স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির, রাস্তা সংস্কার ও মাঠ ভরাটের নামে ১ হাজার ২৯৭টি প্রকল্পের ২ কোটি ৬ লাখ ৮৭০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এসব প্রকল্পের নামমাত্র কাজ করে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ও চাল গম আত্নসৎ করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পের সঠিক কাগজপত্রও সংশ্লিষ্ঠ দফতরে নেই বলে জানা গেছে।
জোট সরকারের শাসনকালে সাঈদী ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে মাত্র তিনটি ইউনিয়নকে নিয়ে জিয়ানগর নামে নতুন উপজেলা গঠন করেন। তিনি প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে তার নিজ বাড়ি সাঈদখালী পর্যন্ত নির্মাণ করিয়েছেন বিশাল রাস্তা। বাড়ির সামনে তথাকথিত 'সাঈদী বাজার' নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করে তার পেছনে ব্যয় করেছেন ৬ লক্ষাধিক সরকারি টাকা। বাজারের বটবৃক্ষটি রক্ষণাবেক্ষণেই খরচ করেছেন ৪৫ হাজার টাকা।
গত পাঁচ বছরে সাঈদী প্রতিষ্ঠিত এসডি মদিনাতুল দাখিল মাদ্রাসা, সাঈদী ফাউন্ডেশন, পিরোজপুর ইসলামিয়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, ভৈরমপুর ইসলামিয়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস কলেজ, তাফহিমুল কুরআন মাদ্রাসা, দরুল কুরআন মহিলা মাদ্রাসা, খলিশাখালী মহিলা মাদ্রাসা, নাজিরপুর দাখিল মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা ও প্রতিষ্ঠানে অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেই তৈরি করেছেন বহু মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বসিয়েছেন নিজেদের লোক।
অন্যদিকে নাজিরপুর কোষকাধী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শুসেন হালদারকে বরখাস্ত করে সেখানে নিয়োগ করা হয়েছে সাঈদীর পছন্দের ব্যক্তিকে। উপরন্তু অধ্যাপক শুসেনকে পুলিশি নির্যাতনের শিকার এবং মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়েছে।
সাঈদীর সুবাদে তার ভাই মোস্তফা সাঈদী ও ভাতিজা রুমী সাঈদীর ভয়ে তটস্থ থাকত বালিপাড়া, সাঈদখালী ও পত্তাসী এলাকার লোকজন। সাঈদখালীর চরে ছিল মোস্তফা সাঈদীর লাঠিয়াল বাহিনী। এছাড়া খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদারের সঙ্গে রুমি সাঈদীর সখ্য থাকার কারণে এলাকায় সে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক।
জোট সরকার ক্ষমতায় থাকায় পিরোজপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের চেয়েও বেশি লাভবান হয়েছে জামায়াত নেতাকর্মী এবং সাঈদীর আত্নীয়স্বজন। জেলা জামায়াতের সেত্রেক্রটারি মাওলানা শফিকুল ইসলাম মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মাওলানা শফিকের ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো বিভিন্ন দফতরের কর্তাব্যক্তিদের। নিজ নামে কোনো লাইসেন্স না থাকলেও সততা এন্টারপ্রাইজ, গালিব এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে এসব কাজ নেওয়া হতো।
পিরোজপুর বন বিভাগে চাকরিরত জামায়াত নেতা খন্দকার জাকির নামে-বেনামে ঠিকাদারি কাজ করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন। গত পাঁচ বছরে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এলাকায় পুলিশ প্রটোকল নিয়ে এবং সাইরেন বাজিয়ে চলাচল করতেন। ক্ষমতার মেয়াদপূর্তির পর তিনি এলাকায় এসে পুরোদমে নির্বাচনী কর্মকা- শুরু করেন। নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্রও জমা দেন। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা, গণসংযোগকালেও পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করতেন। তবে জরুরি অধ্যাদেশ জারির পর তাকে আর এলাকায় দেখা যায়নি।
সাঈদী তার গ্রামের বাড়িতে কোনো বাড়ি বা সম্পদ না করলেও ঢাকায় তার পাঁচতলা বাড়িসহ বহু সম্পদ এবং তার ছেলেদের নামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন।
'খুনকার' থেকে 'অৎকা সৈয়দ' :
পরিচিত ছিলেন খন্দকার তাহের হিসেবেই। এখন তিনি সৈয়দ তাহের। গ্রামের মানুষ তাকে ডাকে 'অৎকা সৈয়দ'। বাবার ছিল তাবিজ-কবজের ব্যবসা। লোকে 'খুনকার' (খন্দকার) বলত। পাঁচ ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় তাহের ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের সুবাদে চৌদ্দগ্রাম আসনের (কুমিল্লা-১২) সাংসদ হয়ে যান। অভিযোগ আছে, নির্বাচনের দিন সবক'টি কেন্দ্র দখলে নিয়ে জয় নিশ্চিত করেন। এরপর চৌদ্দগ্রামকে 'আওয়ামী লীগমুক্ত' করতে কাছা মেরে নামেন। সেই থেকে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের অভয়ারন্যে পরিণত হয় চৌদ্দগ্রাম।
উপজেলার রক্তঝরা ইউনিয়ন আলকরার পশ্চিম ডেকরা গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে তাহেরের জন্ম। নিজ ইউনিয়নে তার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার পবরাউ এক এক করে পাঁচটি হত্যাকা- ঘটে। এর পর আলকরার পার্শ্বার্বতী গুণবতী আর জগন্নাথদীঘির একাংশ পরিণত হয় তাহেরের সাম্রাজ্যে। দরিদ্র পরিবারের তাহের বনে যান গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল মিলের মালিক। আছে আদম ব্যবসা। কুমিল্লার বেসরকারি সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তিনি হন চেয়ারম্যান। নারায়ণগঞ্জে হায়দরি টেক্সটাইল মিলস ও গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তার তিন ভাই সাদেক, হারুন ও সরোয়ার।
১৯৯১ সালেই তিনি চৌদ্দগ্রামের আসনটি করায়ত্ত করতে প্রতি্টন্ি্টতা শুরু করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগের মুজিবুল হকের কাছে হেরে যান। এরপরই শুরু করেন সন্ত্রাসী লালন। তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে খুন হন আলকরা ইউনিয়নের কুলাসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা জসীম (২৫), একই ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের যুবলীগ কর্মী আনোয়ার (৩০), ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর (২২), সোনাইছা গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল (৪০) ও কুলাসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা বাদল (২৫)। কুপিয়ে হত্যা করা হয় গুণবতী ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাজী আবদুল মালেককে (৬০)। সম্প্রতি জোট সরকারের ক্ষমতার শেষ সময়ে চিওড়া ইউনিয়নের শাকতলা গ্রামের যুবলীগ নেতা হেদায়েত উল্লাহকে (৩৪) অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটা জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের কাজ বলেই অভিযোগ করা হয়েছে।
তাহেরের সন্ত্রাসে পঙ্গু হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। বোমার আঘাতে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লক্ষ্মীপুরের যুবলীগ কর্মী হেলানের (২৮) ডান পা ও একই গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ আলীর পা। কুলসার গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী জানু (৩০) এখন অন্দ। তাহেরের বাহিনীর বীভৎসতার ইতিহাস ও সংখ্যা বেশ দীর্ঘ।
২০০১-এর নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন তাহের। তাই কৌশল হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ সহস্রাধিক ক্যাডারকে আনা হয় চৌদ্দগ্রামে। রাখা হয় সমর্থকদের বাড়িতে। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো পরিণত হয় ওইসব ক্যাডারের আস্তানায়। গ্রামবাসীকে বলে দেওয়া হয় ওরা সবাই 'মেহমান'। ভোটারদের জানিয়ে দেওয়া হয় ভোটকেন্দ্রে না যেতে। কারণ এবার ভোট দেবে মেহমানরা। নির্বাচনে জয়লাভের পর এলাকাবাসী বলতে শুরু করেন 'মেহমানের এমপি'।
নবম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একই কায়দায় জিততে এবারো মেহমানদের আনা হয়েছিল। কিন্তু দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরদিন দ্রুত পালিয়ে যায় মেহমানরা।
২০০১-এর নির্বাচনে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরে নির্বাচনী কাজে অংশ নিয়েছিল ওইসব ক্যাডার। সে সময় কাশীনগরে সেনা পোশাক পরা এক ক্যাডার আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে বোমাসহ ধরা পড়ে। উত্তেজিত জনতা তাকে পুলিশে তুলে দিলেও ক'দিন পরই সে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়।
২০০১-এর নির্বাচনে জয়লাভ তাহেরকে অপ্রতি্দ্বন্দী করে তোলে। শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিধন ও বিএনপি তাড়াও অভিযান, টেন্ডার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জমি দখল। তার ছোট ভাই সৈয়দ একরামুল হক হারুন চৌদ্দগ্রামের 'ছোট সাহেবে' পরিণত হন। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা হয় ক্যাডার বাহিনী। এ চত্রেক্রর অপর দুই সদস্য ছিলেন মেশকাতউদ্দিন সেলিম ও উপজেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহজাহান। তাদের নেতৃত্বে প্রতিটি ইউনিয়নে ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনীর অন্যরা হলেন বাচ্চু মেম্বার, হামিদা চোরা, রাসেল, রিপন, মমিন, মামুন, অলি আহম্মদ, আবু সায়েদ, আঃ আজিজ, বেলাল, জামাল, মহিন ডাইক, মোবারক, মিঠু ওরফে মিঠাইয়া চোরা, হানিফ, বাহার প্রমুখ।
উপজেলার কালুজুড়ি খালের ৩০ হেক্টর এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের লিজ পেয়েছিলেন মেসার্স এমআর এন্টারপ্রাইজের মিজানুর রহমান। তাহেরের ক্যাডার গাজী আবু বকর, ইকবাল হোসেন কাজল, জাফর ইকবাল লিটন, খোকন ও জহির ঠিকাদারকে মারধর করে থানায় সোপর্দ করে এবং বালুমহালটি দখল করে রাখে। তার নিদরাউশে উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপুর মৌজার দীঘিটি ২০০১ সালের ১১ অক্টোবর অবৈধভাবে দখল করে নেয় জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। ওই দখল অভিযানে নেতৃত্ব দেয় জামায়াত ক্যাডার শাহাবউদ্দিন ও নূর ইসলাম। দীঘিটি জবরদখলের পর কুমিল্লা সার্কিট হাউসে এক সভায় সাবেক সাংসদ তাহের বলেছিলেন, 'এখন থেকে আমি না বললে চৌদ্দগ্রামে কোনো পাতা নড়বে না।'
উপজেলার বাতিসা গ্রামের অসহায় মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন ১৫ বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোবিন্দমানিক্য দীঘি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে আসছিলেন। পরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা লিজ নিয়ে একটি অস্থায়ী খাবার হোটেল খোলেন। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই দীঘিটি দখল নিয়ে নেয় তাহেরের ক্যাডাররা। হোটেলটি দখল করার পর উল্লাসে মেতে রান্না করা খাবার রাস্তায় ছিটিয়ে আনন্দ করেছিল ক্যাডার বাহিনী।
শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালের দীঘির চন্দ্র নাগের দান করা বিদ্যালয়ের ৮ শতক জায়গাও জবরদখল করেন এ সাবেক সাংসদ। দখল করা জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন 'ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ সংস্থা'। চৌদ্দগ্রামের ঐতিহাসিক জগন্নাথ দীঘিও জবরদখল করে ভোগ করেন ওই সাবেক সাংসদ ও তার ক্যাডার বাহিনী।
২০০৩-এর ২৯ অক্টোবর জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা পল্লী বিদু্যতের ডিজিএমকে প্রকাশ্যে মারধর করে। এলাকার ডাকাত ও সড়ক ডাকাতরাও জোট সরকার আমলে জামায়াত-শিবির করেছে। চোরাকারবারিরাও তার দলে নাম লিখিয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লালবাগ থেকে মোহাম্মদ আলী বাজার পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সীমান্তর্বতী মহাসড়কে চোরাকারবারি ও সড়ক ডাকাতির মূল নেতা তাহেরের ছোট ভাই হারুন ওরফে ছোট সাহেব।
সাতকানিয়ার সম্রাট :
কালো নেকাব আর বোরকা ছাড়া সাতকানিয়ায় কোনো নারী ঘর থেকে বের হতে পারেন না। 'বেপর্দা চলাফেরার' ওপর অলিখিতভাবে এ 'আইন' চালু করেছিলেন চট্টগ্রামের জামায়াতি গডফাদার ও সাতকানিয়া আসনের সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী। এ আ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:০৯