সমকাল (৮/১২/১১)
রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সংগঠক এটিএম আজহার
আবু সালেহ রনি/ইকবাল হোসেন
রংপুরে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) জেলা কমিটির সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বেই কারমাইকেল কলেজের ৬ শিক্ষক এবং এক শিক্ষকপত্নীকে হত্যা করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধারা জানান, নিহত শিক্ষকদের বীভৎস লাশ যারা দেখেছেন তাদের কাছে আজহারুল মানুষরূপী এক নরপিশাচ হিসেবে চিহ্নিত।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছেন একাত্তরের ঘাতক এটিএম আজহারুল ইসলাম। গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাকরাইল, পল্টন, মৎস্য ভবন, আরামবাগ ও দৈনিক বাংলার মোড় সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাংচুর, অগি্নসংযোগসহ কয়েকটি মামলায় তাকে আটক করা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও এ পর্যন্ত তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো রংপুরের ক্ষতিগ্রস্তরা আশা করছেন, শিগগিরই ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুলের বিচার শুরু হবে।
রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা গেছে, রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা এটিএম আজহারুল ইসলাম। রংপুরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এ আজহারুল। তিনি ১৯৭১ সালের ৩০ মে কারমাইকেল কলেজের ৬ শিক্ষকসহ ৭ জনকে হত্যায় নেতৃত্ব দিয়ে পুরো রংপুরকে এক আতঙ্কিত জনপদে রূপ দিয়েছিলেন। আজহারুল বাহিনীর ভয়ে রংপুর শহরসহ আশপাশ এলাকার বাঙালিরা থাকতেন চরম আতঙ্কে।
রংপুর জেলা জাসদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত রাঙ্গা বলেন, '১৯৭১ সালে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়ার অপরাধে কুখ্যাত ঘাতক এটিএম আজহারুল আমাকে টাউন হলের টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড মারধর করেন। তখন আমি ছিলাম অস্টম শ্রেণীর ছাত্র।' একই কথা বলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল হাসান। তিনি বলেন, একাত্তরে তাকেও ধরে নিয়ে যান এটিএম আজহারুল ইসলাম। দু'দিন টাউন হলের টর্চার সেলে রেখে তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। মৃত্যু ভেবে তাকে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও এ পর্যন্ত তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি।
বাঙালি নিধনের শপথ : ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর জামায়াত সৃষ্ট সশস্ত্র সংগঠন আলবদরকে মিলিশিয়া বাহিনীর স্বীকৃতি দেয়। এ উপলক্ষে ওইদিন আলবদর বাহিনী দেশের বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশের আয়োজন করে। এরই অংশ হিসেবে রংপুর সদরে আয়োজিত আলবদর বাহিনীর সভায় সভাপতিত্ব করেন এটিএম আজহারুল ইসলাম (সূত্র দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ আগস্ট, ১৯৭১)। সভায় আজহারুল ইসলাম এবং তার সহযোগীরা বাঙালির রক্তপানের শপথ নেন বলে সভাস্থলে উপস্থি্থত একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্ন সময় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ছয় শিক্ষক হত্যা : ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে আলবদর কমান্ডার আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত এক অভিযানে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজের ৬ শিক্ষক এবং এক শিক্ষকপত্নীকে তুলে আনা হয়। তারা হলেন রসায়ন বিভাগের প্রভাষক কালাচাঁদ রায়, গণিতের প্রভাষক চিত্তরঞ্জন রায়, দর্শনের প্রভাষক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, বাংলার প্রভাষক রামকৃষ্ণ অধিকারী, উর্দু বিভাগের শাহ সোলায়মান আলী ও রসায়নের আবদুর রহমান এবং কালাচাঁদ রায়ের স্ত্রী (নাম জানা যায়নি)। ওই সময়কার ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম ও তার ভাই সাখাওয়াত রাঙ্গা (বর্তমানে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক) এবং রংপুরের অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য মতে, আজহারুলের উপস্থিতিতে ও নির্দেশে তার সহযোগী আলবদর সদস্যরা রংপুরের সর্বমহলে সমাদৃত ওই ৭ জনকে কলেজের পার্শ্ববর্তী দমদমা এলাকায় নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর ব্রাশফায়ারে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ ঘটনায় আতঙ্কে শিউরে ওঠে রংপুরবাসী।
মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্য মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আজহারুল ইসলাম ৭০ জনের একটি সশস্ত্র আলবদর স্কোয়াডের নেতৃত্ব দিতেন। সেই স্কোয়াডের ঘাঁটি ছিল রংপুরের টাউন হল এলাকায়। আজহারুল এবং তার সহযোগীরা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ভয়-ভীতি দেখিয়ে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়, এমনকি অপেক্ষাকৃত নিরীহ মুসলিম পরিবারের সুন্দরী তরুণী এবং গৃহবধূদের ধরে এনে সরবরাহ করতেন।
ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ : ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দিকে বাঙালির বিজয় নিশ্চিত হতে থাকলে আজহারুল ইসলাম রংপুর ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। এরপর মেতে ওঠেন ইতিহাসের আরেক নৃশংস ও জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞে। আজহারুল, নিজামী ও মুজাহিদ গংয়ের নেতৃত্বে দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের ধরে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে স্থাপিত টর্চার সেলে নিয়ে চালানো হতো অকথ্য নির্যাতন। সেখান থেকে তাদের নিয়ে হত্যা করা হতো রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন নরঘাতক আজহার তার অন্য কয়েক সহযোগীর সঙ্গে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। সেখান থেকে পাড়ি জমান সৌদি আরব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-পরবর্তী অনুকূল পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসেন আজহারুল। ১৯৭৭ সাল থেকে আবারও প্রকাশ্যে সক্রিয় হন জামায়াতের রাজনীতিতে।
আজহারুলের রাজনীতি : একাত্তরের ঘাতক এটিএম আজহারুল ইসলাম বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হলেও নিজ এলাকায় এ পর্যন্ত ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারিয়েছেন তিনি। এলাকায় ভোট চাইতে গেলে জনগণ তাকে একাত্তরের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেয়। রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ ড. দীপকেন্দ্র নাথ দাস বলেন, শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষ মনে করে, হত্যাকারী রাজাকার, আলবদর কখনোই জনগণের সেবক হতে পারে না। এ জন্য রংপুরের জনগণ বারবার তাকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুলের বিচার হবে_ এটিই রংপুরবাসীর প্রত্যাশা।
পুলিশের কাজে বাধা দেওয়াসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে কয়েকটি মামলায় এটিএম আজহারুল বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছেন। এ জন্য তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।