যারা মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন, এটা হয়তো শুধু সেই সব সাধারন মানুষরাই জানেন — আর জানেন বর্তমান বিশ্বমন্দার এই সময়ে একজন অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে কর্মরত, সৌদি আরব ফেরত জনাব আবুল হাসেম। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে পরিবার প্রিয়জন থেকে দূরে থাকার জীবন বেছে নিয়েছিলেন আবুল হাসেম। কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন, যাতে করে হাতে কিছু পয়সা জমাতে পারেন। দেশে ফেরার পর পরিবারের বর্ণময় স্বপ্নগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁতে পারেন। সুদীর্ঘ ছয় বছর পরে গত শুক্রবার আবুল হাসেম দেশে ফিরে এসেছিলেন, সাথে করে এনেছিলেন তার এতদিনের কষ্টার্জিত সঞ্চয়। প্রবাস জীবনে খাওয়া দাওয়া সহ দৈনন্দিন খরচ মিটিয়ে একজন শ্রমিকের ছয় বছরে চার লক্ষ টাকা সঞ্চয় করতে কি পরিমান কৃচ্ছতা সাধন করতে হয়? কতটা নিচে নেমে, কি পরিমান মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে!! আমাদের মধ্যে অনেকেরই হয়তো সে ধারনা নাই।
আমরা জানি না কি পরিমান টাকা খরচ করে আবুল হাসেম মধ্যপ্রাচ্যে এই চাকুরিটি যোগাড় করেছিলেন। যদি সেই টাকা ঋন করে সংগ্রহ করা হয়, তবে মাথার উপর সেই ঋনের বোঝা নিয়ে আবুল হাসেম দেশে ফিরছিলেন কিনা?
যা আমরা পরিস্কার ভাবে জানি, তা হলো এই টাকাটাই ছিলো আবুল হাসেমের সর্বস্ব।যাবতীয় সুখ ভোগ থেকে নিজকে বঞ্চিত করে, সব বিলাস আহ্লাদের গলা টিপে ধরে — তিলে তিলে জমানো একটা থোক টাকা। যা হারালে মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকাটাই তার জন্য অনিশ্চিত হয়ে যাবে। স্বপ্ন পূরন দূরে থাক, হয়তো বাকী জীবনটা কাটাতে হবে নিতান্তই নিন্মস্তরের মানুষ হিসাবে। তার সন্তানের ভবিষ্যত শুরু হবে হতভাগ্য নিঃস্ব অসহায় এক শিশু হিসাবে।
অনুমান করতে কষ্ট হয় না, আবুল হাসেমের পরিবারে সবাই গত ছয় বছর ধরে কত অধীর ভাবে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল — যখন পরিবারের এই প্রিয় মানুষটি প্রবাস থেকে ফিরে আসবে তাদের মাঝে। আমরা বুঝতে পারি তার স্ত্রী, তার সন্তান অথবা বৃদ্ধ মাতা-পিতা কি পরিমান আশা আর স্বপ্নের অনুভূতি দিয়ে এই দিনটির প্রতিটি মুহুর্তকে সাজিয়েছিল।
তাদের সব রঙীন স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, অনিশ্চয়তার কালো রং দিয়ে ধেবড়ে গেছে তাদের সুখের প্রিয় ছবিটা।
আবুল হাসেমের এই সর্বস্ব খোয়ানোর ঘটনাটি বিশাল কোন মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ছিল না, অথবা গনতন্ত্রের জন্য তা কোন হুমকি তৈরী করে নাই। সম্ভবত সে কারনেই খবরটি আজ প্রথম আলোতে তৃতীয় পৃষ্ঠায় খুব সাদামাটা ভাবে কয়েক ইঞ্চি মাপে ছাপা হয়েছে — খুব অদরকারী ভঙ্গীতে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সহোদর ভাই জি এম কাদের কে প্রায়ই দেখি টেলিভিষনের বিভিন্ন আলোচনায় আর টক শোতে। নানা ধরনের বিষয়ে বিস্তর জ্ঞানগর্ভ মতামত প্রদানকারী এই সুশীল সুবোধ ভদ্রলোকটি একজন নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিও বটে এবং তিনি বর্তমান মন্ত্রীসভায় অভ্যান্তরীন বিমান চলাচল মন্ত্রনালয়ের দ্বায়ীত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী।
বিদেশ থেকে আগত যাত্রীরা যাতে নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ঝুঁকিবিহীন পরিবহনে করে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে অক্ষত ভাবে পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করা এই মন্ত্রনালয়ের দ্বায়ীত্বের মধ্যে পড়ে। বিদেশ থেকে একজন প্রবাসী যখন বাংলাদেশে এসে নামে, তখন যাতে করে সে কোন দুবৃর্ত্ত বা অসৎ লোকের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার জন্য একটা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার রক্ষা বলয় গড়ে তোলার দ্বায়ীত্ব এই সরকারী দপ্তরটির। প্রতিনিয়ত সে নিরাপত্তার রক্ষা ব্যাবস্থাকে নিরীক্ষন করা এবং আরও নিশ্ছিদ্র করে তোলাই তাদের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, অভ্যান্তরীন বিমান চলাচল মন্ত্রনালয়ের দ্বায়ীত্বে নিয়োজিত এই মন্ত্রী মহোদয় একজন রাজনীতিবিদ, কোন বিশেষ বাহিনী থেকে উনি উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক নন। রীতিমতো নির্বাচন করে জিতে আসা লোক। গনমানুষের সাথে মেলামেশা করার অভিজ্ঞতা তার আছে, সাধারন মানুষের দুর্ভোগ দুর্দশা তিনি উপলদ্ধি করতে পারেন।
অথচ তারপরেও, আজকের খবরের কাগজে নিতান্তই হেলাফেলায় ছাপানো এই খবরটি আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের নজরে পড়েছে কিনা, আর পড়লেও তা পড়ার পর বিমানবন্দর এলাকায় নিজের কর্মব্যাবস্থার চূড়ান্ত অদক্ষতা আর তার অক্ষমতার ফুটো ফাটা নজরে পড়ে আক্ষেপে তার বুক ঠেলে দীর্ঘনিঃশ্বাস বার হয়েছিল কিনা...? আজ সারাদিন আমি সেটা নিয়েই ভাবছিলাম... খুবই বালখিল্য ধরনের চিন্তা ভাবনা সন্দেহ নাই। কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একজন দ্বায়ীত্ববান মানুষের আচরনে তো এধরনের মনোভাবটাই ফুটে ওঠে।
দেশে ফিরেই চরমভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়া আজকের এই আবুল হাসেমের খবরটা কি আমাদের মন্ত্রীমহোদয়ের নজরে এসেছিল? খবরটা পড়ে উনার মনে একটু সময়ের জন্য হলেও বিচলিত ভাব তৈরি হয়েছিলো কি??? তার অপদার্থতা আর অকর্ম্মন্যতার জন্য আবুল হাসেম আজ তার জীবনের সর্বস্ব খোয়ালো... এ জাতীয় কোন ধরনের আফসোস বোধ কি তাকে পীড়িত করেছিলো? অথচ কষ্টসাধ্য প্রবাসজীবন কাটিয়ে সারা জীবনের সম্বল হাতে নিয়ে, আবুল হাসেমরা এই সব সরকারী দ্বায়ীত্ববান লোকেদের কর্মদক্ষতা আর যোগ্যতার ওপর ঈমান ভরসা রেখেই দেশের মাটিতে পা দেয়!!
সাধারনের থেকে প্রায় সাত আসমান দূরে, আল্লার আরশের প্রায় কাছাকাছি অবস্থানরত, যাবতীয় জবাবদিহীতার উর্ধ্বে, ধরা ছোঁয়ার নাগালের বাইরে থাকা এই সব জনপ্রতিনিধি তথা মন্ত্রীকুল কি পরিমান জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে — দিনের পর দিন, মাসের পর মাস...!! এদিকে নির্বাচনের পর নির্বাচন আসে ঢেউএর মতো... কিন্তু যাদের দ্বায়ীত্ব না পালনের গাফিলতিতে আজ আবুল হাসেম তার জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় খোয়ালো, তাদের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইনসাফ চেয়ে, দেশের কোন আদালতের কাছে আবুল হাসেমরা দাঁড়াতে পারবে, একটা বিহিতের আশায়, একটু বিচারের আশায়...? কোনদিন?
জনপ্রতিনিধিদের এই ক্রমবর্ধ্মান জনবিচ্ছিন্নতা, তালেবান আর আল কায়েদার মতো চরমপন্থীদের পক্ষে যে কোন বে -ইনসাফের সমাজে টিকে থাকার শর্ত তৈরি করে দেয় — প্রয়োজনীয় এই কথাটা আমাদের ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না।
গতকালের প্রথম আলোর সেই বিশেষ খবরঃ
বিদেশ থেকে এসেই তিনি খোয়ালেন চার লাখ টাকা
বিদেশ থেকে এসে দেশের মাটিতে পা রাখার কিছুক্ষনের মধ্যেই দুর্বৃত্তদের কবলে পড়ে তিনি খুইয়েছেন সঙ্গে থাকা সব টাকা।
রাজধানীতে গতকাল শুক্রবার ভোরে সৌদি আরব প্রবাসী আবুল হাসেম (৪৫) নামের এক ব্যক্তি অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে চার লাখ টাকা খুইয়েছেন। অচেতন অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর হাসেম সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল ভোরে তিনি সৌদি আরব থেকে এসে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। ট্যাক্সিক্যাবে করে তিনি গ্রামের বাড়ী কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম যাচ্ছিলেন। খিলক্ষেত বিশ্বরোডে আসার পর চালক ট্যাক্সিক্যাবে সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে থামায়। ঠিক সেই মুহুর্তে অজ্ঞান পার্টির আরও দুইজন সদস্য জোর করে ট্যাক্সিক্যাবে উঠে পড়ে। তারা তাকে একটা তরলজাতীয় পদার্থ খাইয়ে দেয়। এর পর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁর চার লাখ টাকা খোয়া গেছে বলে তিনি দাবী করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পথচারীরা গাবতলী আন্ডারপাসের ওপর থেকে তাঁকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌছে দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৩৫