মাতৃভাষা হচ্ছে মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির পরিচয় পত্র। সন্তানের জন্যে মায়ের অস্তিত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের সুস্থভাবে প্রকাশিত হওয়ার জন্যে, বিকশিত হওয়ার জন্যে মাতৃভাষারও তেমনি বিকল্প নেই। বিশ্বজুড়ে সকল মাতৃভাষাই শ্রদ্ধার, ভালবাসার এবং সম্মানের। বাঙালীর জীবনে মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠায় যে অনন্য গৌরবময় ইতিহাস জড়িয়ে আছে, যে মূল্যবান আত্নত্যাগ মিশে আছে তা বোধ করি বিশ্বে আর কোথাও নেই। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালীর সর্বোচ্চ আত্নত্যাগ একদিকে যেমন আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তেমনি পরবর্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা, অসীম শক্তি ও সাহসের সুচনা করে দিয়েছে, বাঙালিকে আত্নবিশ্বাসী, দৃঢ় আর সুসংবদ্ধ হতে উজ্জীবিত করেছে। মাতৃভাষার জন্যে এমন গৌরবমন্ডিত আন্দোলন এবং অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বরে জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্পর্কিত বিষয়ে শ্রদ্ধা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিনটি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আমাদের এই পাওয়া বড় মর্যাদাময় আত্নত্যাগের ফসল। আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য মাতৃভাষা বাংলাকে যোগ্য মর্যাদার সাথে ব্যাপক চর্চা, সুষ্ঠু পরিচর্যা ও ঘরে-বাইরে সর্বত্র প্রচলন নিশ্চিত করা।
শিশুর মুখে বোল ফোটে মায়ের কোলে, মায়ের ভাষাতেই। তাই যত্নের সাথে মাতৃভাষাটি শিশুর মনে এবং মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়ার প্রথম দায়িত্বটি মায়েরই। মা -বাবা এবং পরিবারের অন্যান্যদের সচেতনতায় একটি শিশু মাতৃভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠে, নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং সঠিক ইতিহাস বিষয়ে সম্যক ধারণা পায়। সত্যিকারের ব্যক্তিত্ব বিকাশ, দেশপ্রেম ও স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধতা শিখে বেড়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এখন অনেক মা-বাবাই সন্তানের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্নে মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজী শিক্ষাকেই প্রাধান্য দেন এমন কি সঠিকভাবে বাংলা বলতে, পড়তে এবং লিখতে না পারা বা ইংরেজী বাংলার মিশ্রণে ইংরেজী কায়দায় কথা বলায় গৌরব বোধ করে উৎসাহিত করেন। ফলে দু'টি ভাষার কোনটিই পরিপূর্ণভাবে শেখা হয়ে ওঠে না। এতে যে বড় ক্ষতিটা হয় তা হলো নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অনিহা এবং মাতৃভাষার স্থলে আরোপিত এক বিচিত্র মিশ্র ভাষার চর্চার আগ্রাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভাষা বিশ্বময় যোগাযোগের সেতু। মাতৃভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজী বা ভিন্ন ভিন্ন ভাষা শিক্ষা এবং পারদর্শিতা হাজারো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। বিশ্বের সাথে যোগাযোগের পথ প্রসারিত হয়, মানুষ আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। তবে ভাষার ভিতটি হচ্ছে মাতৃভাষা। মানুষ তখনই ভিন্ন একটি ভাষায় পারদর্শিতা আনতে বিশেভাবে সক্ষম হয় যখন সে তার মাতৃভাষাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে, মর্যাদার সাথে রপ্ত করে, চর্চা করে এবং পরিচর্যা করে।
পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা হলো আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরাসহ বিশ্বজুড়ে পঁচিশ কোটিরও কিছু বেশী মানুষ বাংলায় কথা বলে। এর মধ্যে বাইশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও বাকী তিন কোটি মানুষ কেবল ভালবেসে শিখে নিয়েই বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে চর্চা করে। সেখানে বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা হওয়া সত্বেও এমন অবজ্ঞা কেন! অবহেলা কেন! পাঁচ পাঁচটি যুগ পেরিয়ে যাবার পরেও আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে সেই যোগ্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি! এ বড় পরিতাপের বিষয়।
আমাদের সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বানিজ্য সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত হওয়া উচিত। বাংলাভাষা বিজ্ঞানের ভাষা, জীবিকার ভাষা হওয়া উচিত। পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্টীয় জোরালো উদ্যোগে আমাদের সেই ১৯৫২'র আবেগ, দেশপ্রেম, আত্নমর্যাদাবোধ আর শহীদের রক্তে রাঙা ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব।
গৌরবমন্ডিত মাতৃভাষা বাংলার জন্যে ভাষা শহীদ এবং ভাষা সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:১৫