এক
হুড়মুড় করে একটা গাড়ি এসে থামল ক্যানসাস, ইউএসএ-র একটা অখ্যাত হাসপাতালে। গাড়ি থেকে আহত এক লোক নেমে এল। শরীরের যত্রতত্র রক্ত দেখা যাচ্ছে তার। মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। ভয়াবহ বিকৃত হয়ে গেছে তার মুখমণ্ডল। মনে হচ্ছে যেন ওখান থেকে কোন কসাই বেছে বেছে মাংস কেটে নিয়েছে। লোকটা এখনও সজ্ঞান এ আছে কিভাবে সেটাই রিসিপশনের কমবয়সী যুবতী বুঝতে পারছে না। অবশ্য সে তখন ভয়েই নির্বাক হয়ে গেছে। লোকটাকে বিকৃত গলায় রীতিমতো চিৎকার করতে হল ওর মাথায় কথাটা ঢোকাতে।
-মিস! আই নিড ইমারজেন্সি মেডিক্যাল এটেনশন, প্লিজ...
রাশভারি কণ্ঠে যেন ঝাঁকি খেয়ে বাস্তবে ফিরল রিসিপ্সনিস্ট বেকি। হাত বাড়িয়ে ইমারজেন্সির সাথে ইন্টারকমে যোগাযোগ করল। আর একজন মেল নার্সকে স্ট্রেচার নিয়ে আসতে বলল। আহত লোকটাকে ভীত চোখে দেখতে লাগল বেকি। একহারা গড়নের শরীর। চেহারা বোঝার তো কোন উপায়ই নেই। কাল একটা জ্যাকেট, রয়াল ব্লু শার্ট আর কালো প্যান্ট, শ্যু লোকটার পরনে। নিচ থেকে মুখে নজর ফিরে আসতেই থমকে গেল। যেখানে মুখ দেখা যাচ্ছে, যা অবশিষ্ট আছে আর কি... লোকটা কি...
ভাবনা শেষ করতে পারল না বেকি। স্ট্রেচার নিয়ে নার্স পৌঁছে গেছে। লোকটা শুয়ে পড়ল তাতে। বেকি নামটা জানার জন্যে ডাকল,
-মিস্টার, আপনার নামটা?
কোন সাড়াশব্দ এল না। নার্স পরিক্ষা করে দেখল জ্ঞান হারিয়েছে এতক্ষণে অজ্ঞাতনামা। দ্রুত ইমারজেন্সির দিকে স্ট্রেচার ঠেলল সে। বুঝা গেল না এতক্ষন কি অসুর বলে লোকটা সজ্ঞানে ছিল। পেছন থেকে চলে যাওয়া দেখল বেকি। অসমাপ্ত ভাবনাটা আবার মাথায় আসল। আনমনেই বলে উঠল,
-লোকটা কি হাসছিল?
ইমারজেন্সির ডিউটিতে ছিল ডক্টর রবার্টস। সদ্য আসা রোগীকে একনজর দেখল সে শরীরের কাপড় সরিয়ে। দ্রুত একটা ওটি রেডি করে রোগীকে নিয়ে যেতে বলল। এই রোগী বাঁচানো যাবে কিনা কে জানে! রোগীর শরীরে টর্চার, গুলির আঘাতের চিহ্ন। ডিউটি নার্সকে পুলিশে খবর দিতে বলে নিজে অপারেশনের জন্যে তৈরি হতে চলল।
ওটি টেবিলে রোগীর পুরো শরীরে নজর দিতে পারল ঠিকমত ড. রবার্টস। আঁতকে উঠলেও প্রকাশ করল না। টানা চার ঘণ্টা ধরে ঝুজল সে ক্ষতগুলো নিস্ক্রিয় করতে। এর মধ্যে একবার রোগী ভিফিভ এও চলে গিয়েছিল। শক দিয়ে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। চার ঘণ্টা পর বেরিয়ে এল সে ওটি থেকে। ওর যা করার করেছে। এখন এ রোগীর সেরে ওঠা তার নিজের উপর। সেরে উঠলেও চেহারার জন্যে প্লাস্টিক সার্জন লাগবে তার নিশ্চিত। কিছু বিস্মৃত ঘটনা চোখের সামনে ভেসে আসছিল তার। জোর করে মাথা থেকে দূর করল। ব্যান্ডেজে মোড়া চেহারারটা মনে ভেসে আসল। শেইম... খুব সুদর্শন একজন পুরুষ ছিল পেশেন্ট। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাওয়ারে এসে ঢুকল ড. রবার্টস।
দুই
নিজের চেম্বারে বসে কাজ করছিল রবার্টস। হঠাৎ দরজায় নকের শব্দ হল,
-কাম ইন।
দরজা ঠেলে ঢুকল একজন সিনিয়র নার্স। তাকে দেখে বলল রবার্টস,
-পুলিশে ইনফর্ম করা হয়েছে?
-সে ব্যাপারেই বলতে এসেছি ম্যাম।
ভ্রু কোঁচকাল রবার্টস,
-সে ব্যাপারে বলার কি থাকতে পারে? পেশেন্টের শরীরে বুলেটের আঘাত পাওয়া গেছে। তোমাকে আমি পুলিশে জানাতে বলেছি। ফোন তুলে ৯১১ ডায়াল করবে, ব্যাস!
-আসলে ম্যাম আমাদের ফোন লাইন ডেড।
-কখন থেকে?
-ঘণ্টা পাঁচেক হবে।
-মোবাইল?
-নেটওয়ার্ক ও কাজ করছে না।
-আই সি! ওকে তুমি যাও।
-ইয়েস ম্যাম।
বেরিয়ে যেতে ঘুরল নার্স। পেছন থেকে বলল রবার্টস,
-ঐ পেশেন্ট এর পজেশনগুলো আমার অফিসে পাঠিয়ে দিও তো এখনই।
অবাক হলেও বলল নার্স,
-ইয়েস ম্যাম, রাইট এওয়ে।
বেরিয়ে গেল নার্স।
কিছুক্ষন পর অজ্ঞাত পেশেন্টের সাথে থাকা জিনিস্পত্র, কাপড়চোপড় সব দিয়ে গেল আরেকজন নার্স। রবার্টস হাতের কাজ সরিয়ে রেখে তাতে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষন পর কপালে চিন্তার রেখা পড়ল রবার্টস এর। এরপর চেহারায় কাঠিন্য এল ধিরেধিরে। শেষে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। পেশেন্টের জ্যাকেটের পকেটে পাওয়া একটা যন্ত্র নিয়ে সে বেরিয়ে এল চেম্বার ছেড়ে।
তিন
জ্ঞান ফিরেছে লোকটার। চোখ খোলার আগে মনে করে নিল কোথায় আছে সে। আশেপাশের পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাইল অন্য ইন্দ্রিয়গুলো ব্যাবহার করে। যাতে আশেপাশে কেউ থাকলেও বুঝতে না পারে যে ও জ্ঞান ফিরে পেয়েছে, সেভাবে। অনুকূল অবস্থা মনে করে চোখ মেলল ও। একটা হসপিটাল কেবিনে রয়েছে ও। জানালা দিয়ে পড়ন্ত দিনের সূর্যের কোমল আলো এসে পরেছে গায়ে। কয়েকটা মুহূর্ত তা উপভোগ করে নিজের শরীরের প্রতি মনোযোগ দিল ও। ক্ষতগুলো পর্যবেক্ষণ করে সন্তুষ্ট হল। যে ডাক্তার এসবের উপর কাজ করেছে, সে ভাল কাজ দেখিয়েছে। তবে শরীরে স্বাভাবিক শক্তি, নিয়ন্ত্রন কোনটাই পাচ্ছে না এখন। বুঝতে পারল সময় লাগবে আরো। চোখ মুদতে যাচ্ছিল আবার। চমকে উঠল হঠাৎ। কেউ একজন আছে এই রুমে। ওকে ফাকি দিয়ে এতক্ষণ কিভাবে থাকল সেটাই বুঝতে পারল না লোকটা।
ঘরের অন্ধকার দিকটা থেকে আওয়াজ এল,
-এখন কেমন বোধ করছেন?
-নট ব্যাড। তবে মনে হচ্ছে আমার প্রয়োজনের চেয়ে পেইনকিলার কমই দেয়া হচ্ছে।
-সরি এবাউট দ্যাট। বিয়ার উইথ মি। হ্যাড টু ওয়েক ইউ আপ।
অপরিচিতার মুখে সূর্যের আলো এসে পড়ছে, তাই এবার দেখতে পেল চেহারাটা লোকটা। সুগঠিত শরীরে একটা প্যান্ট, শার্ট আর তার উপর এপ্রন পরা। বুকে হাসপাতালের আইডি কার্ডে নাম লেখা ড. রবার্টস। চেহারাটায় কাঠিন্য ৪০ ভাগ, মায়াবী ৪০ ভাগ। আর বাকি বিশভাগ রহস্য।
-কি ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি বলুন।
-আপনি কে?
-সেটা বেশ জটিল প্রশ্ন। আরও স্পেসিফিক কোন কিছু জানতে চাইবেন?
এপ্রনের পকেট থেকে একটা কি-যেন বের করে ছুড়ে দিল রবার্টস। বিছানায় পড়ার আগেই বাম হাতে শূন্যে লুফে নিল লোকটা। চেষ্টা করেও গোঙ্গানিটা লুকোতে পারল না। ভাবলেশহীন ডাক্তারের চেহারা। হাতের জিনিসটার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা। উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল ডাক্তার রবার্টস এর দিকে।
-এখানে কি চাই আপনার?
-ধারণা করছি আপনিই আমার ডাক্তার।
নড করল রবার্টস।
-তাহলে আপনার জানার কথা আমার ফিজিক্যাল কন্ডিশন।
-কিভাবে হল আপনার এ অবস্থা? সিআইএ?
-ইয়েস। আই প্রিজুম আপনিও তাদেরই ছিলেন একসময়?
অবাক হওয়ার কোন ছাপ দেখা গেল না ডাক্তারের মুখে।
-কাইন্ড অফ।
আনমনে মাথা দোলাল লোকটা। তারপর বলল,
-আমার পেছনে ওরা আসছে এখনও। আমি আজকের দিনটা আপনার এখানে কাটাতে চাই। আগামীকাল আমি নিজের রাস্তা মেপে নেব।
এন্ড ইয়েস, আই এস্যুর ইউ, আই এম নট হেয়ার টু কজ এনি হার্ম টু ইউ অর এনিওয়ান এলস।
হাতের জিনিসটা দেখিয়ে বলল,
-আমি শুধু নিজের দিকে বিপদ আরও এগিয়ে না আসে তার জন্যে এই সিগন্যাল জ্যামারটা ব্যবহার করছি। আপনি চাইলে এটা ডিএকটিভ করতে পারেন, শুধু অথরিটির সাথে কন্ট্যাক্ট না করাটা আমাদের দুজনের জন্যেই ভাল মনে হচ্ছে। তাই নয় কি?
ছুঁড়ে ফেরত দিল সে সিগন্যাল জ্যামার।
এতক্ষনে এপ্রনের অন্য পকেট থেকে হাতটা বের করে আনল রবার্টস। কমব্যাট নাইফটা অদৃশ্য হল তার বুটের ভেতর।
চার
ওকলাহোমা তে রাস্তার পাশে তিনটে গাড়ির কনভয় দাঁড়িয়ে। দলপতি টাইপের একজন নিষ্পাপ চেহারার গম্ভীর লোক মাঝের গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। লস এঞ্জেলেস থেকে পালানোর পর বন্দীর পিছু ছুটেছে এরা। মাঝে কয়েকবার ধোঁকা দিয়ে নাকের ডগা থেকে পালিয়েছে সে। এবার আবার সেরকম হল। লম্বা পথের ক্লান্তির ছায়া দেখা যাচ্ছে দলপতির মুখে। বড় স্যাভয় থেকে ছুটে এল একজন টেকনিশিয়ান।
-স্যার, উইচিটায় দেখা গেছে গাড়িটা হাইওয়ে ক্যামেরায়। এম্পরি এর দিকে যাচ্ছে।
-লেটস গো।
গাড়িতে উঠতে যেয়ে থামল একবার দলপতি। টেকনিশিয়ানকে ডেকে বলল,
-উইচিটা থেকে ৩০০ মাইলের মধ্যে যতগুলো হাসপাতাল, অপারেটিং ফ্যাসিলিটি সহ ক্লিনিক আছে লিস্ট বের করে ইনভেস্টিগেট করো।
-ইয়েস স্যার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করল কনভয়।
পাঁচ
-হোয়াট হ্যাপেন্ড?
-হোয়াট ইউজুয়ালি হ্যাপেন্স। এমন একটা কিছু শুরু করেছিলাম যা শেষটা ঠিকমতো করা যায়নি।
-কেমন?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল লোকটা,
-পৃথিবীর সমস্যা কি জানেন? মানুষ। যত সব সমস্যা তার উৎপত্তি এই একটা জাতিতে। এদের মধ্যে পৃথিবীকে সুস্থ করতে যায় কিছু মানুষ, বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগ তখন থাকে নির্লিপ্ত, অজ্ঞান। আর কিছু সৃষ্টি করে বাধা, যাদের স্বার্থেই করে চলেছে তারা একের পর এক অন্যায়, ষড়যন্ত্র।
-ফিলসফি?
-না, বাস্তব। আমার আঙ্গিকে আয়না।
-তো, আপনিও কি পৃথিবী সাড়াতে নেমেছেন?
মুচকি হেসে জবাব দিল লোকটা,
-হ্যা, তার ফলাফল তো দেখতেই পারছেন... দ্যা ওয়ার্ল্ড জাস্ত কান্ট বি সেভড। পৃথিবী নিজের পথে এগিয়ে যাবে, যখন সইতে পারবেনা তখন শুন্য মরুভূমি অথবা অসীম সাগর।
-আপনার গল্পটা কি বলবেন?
জানতে চাইল কিছু শুন্য নীরবতার পর লোকটা।
-আপনার মত পুরো পৃথিবী সাড়াতে যাইনি। একটা স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। ট্রাইড টু হ্যাভ ফেইথ ইন দ্যা কাউন্ট্রি। সার্ভড এন্ড গট বিট্রেইড যখন আর নিতে পারছিলাম না। এখন সেই সময়টা ভুলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। চেষ্টা করছি নিজের সেরাটা দিয়ে মানুষদের সারিয়ে তুলতে।
-আই থিঙ্ক ইউ আর নট ডুইং ইওর বেস্ট, ইউ কান্ট হোয়েন ইউ হাইড সামথিং সো ফার আওয়ে, সামথিং ইউ আর গুড অ্যাট।
-আরন্ট উই অল?
ছয়
দলপতির ওয়াকি খড়খড় করে উঠল,
-স্যার, প্রায় সব লোকেশনই যোগাযোগ করেছি, নো লাক।
-প্রায়?
-একটা নাম্বার ইনভ্যালিড মনে হচ্ছে, ক্যানসাস এ। কল কানেক্ট হচ্ছে না।
-হি ইজ দেয়ার ড্যাম ইট! সেট ডেসটিনেশন, প্রিপেয়ার টু অ্যাসল্ট।
সাত
আরেকবার ড্রেসিং পাল্টে দিল ড. রবার্টস। লোকটার রক্তাক্ত পোশাক আর ব্যবহার উপযোগী নেই। কোথা থেকে যেন একটা শার্ট, প্যান্ট আর জ্যাকেট যোগাড় করে দিল সে। তাই বিছানা ছেড়ে পরে নিল লোকটা। নিজেকে ওয়াশরুমের আয়নায় দেখে হাসার চেষ্টা করল। রীতিমতো মিশরীয় মমির মত লাগছে নিজেকে। জ্যাকেটের হুডটা তুলে দিয়ে বেঢপ সাইজের একটা সানগ্লাস তুলে নিল চোখে। হাসপাতালের মানুষের নজর এড়িয়ে কোনরকমে বের হতে পারবে এখন। রুমে ঢুকে দেখল দাঁড়িয়ে আছে রবার্টস।
-আপনাকে ধন্যবাদ। এই সাহায্যের কথা আমার মনে থাকবে। আর প্রতিদানের বেলায় আমি কখনও কার্পণ্য করিনা।
একটু হেসে ওর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল রবার্টস,
-এতে কিছু ওষুধ আছে, এক্সট্রা ড্রেসিং এর জিনিসপত্রও আছে। প্রয়োজনে বদলে নেবেন।
কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল লোকটা।
-উপকারের প্রতিদান দিতে চাইলে একটা জিনিসই চাইব আমি।
-বলুন।
-নেভার গিভ আপ অন দ্যা ওয়ার্ল্ড। পৃথিবীটা এত সহজ না ভাল রাখার। ট্রাই বেবি স্টেপস... প্রথমে একটা ফুলকে বাঁচাতে লড়াই করুন, তারপর নাহয় এক সময় সম্ভব হলে পুরো পৃথিবীকে?
থমকে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল লোকটা রবার্টস এর দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে। তারপর জানতে চাইল,
-ধন্যবাদ। যদি খুব সমস্যা না হয় তাহলে আপনার আসল নামটা জানতে পারি?
-ইটস রায়হান, রিনিস।
-আই এম গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
নিচে নেমে রিসিপশনের সামনে দিয়ে বের হবার পথ। মোড়টা ঘুরেই থমকে দাঁড়াল লোকটা। কয়েকজন মানুষ কথা বলছিল রিসিপশনিস্ট বেকির সাথে। মোড় ঘুরতেই চোখাচোখি হল তাদের সাথে। ব্যান্ডেজে মোরা চেহারাটা না চিনলেও চোখজোড়া চিনতে ভুল করলনা দলপতি। চেঁচিয়ে উঠে হোলস্টারে হাত বাড়াল, তার আগেই ফিরতি পথে ছুটতে শুরু করেছে তার শিকার। সাথে দুজনকে পিছু নিতে বলে বেড়িয়ে এল সে বাকিদের দিয়ে পালানোর সব পথ বন্ধ করতে।
লোকটাকে বিদেয় দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল রিনিস। হঠাৎ পেছনে আওয়াজ পেয়ে থামল। লোকটাকে ছুটে আসতে দেখে আর পেছনে উদ্যত অস্ত্র হাতে দুজনকে দেখে ঘটনা বুঝে নিল। বিদ্যুতের গতিতে যেন ওর হাত দুটো এপ্রনের ভেতর দিয়ে পিঠের কাছে পৌঁছে গেল। তারপর ঝিলিক দেখল লোকটা তার দুপাশে। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারল দুই শিকারির পরিণতি। লোকটার দিকে চেয়ে চেঁচাল রিনিস,
-ফায়ার এস্কেপ। আই উইল ফাইন্ড ইউ।
ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ির দিকে ছুটল লোকটা। দরজা ঠেলে সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ নেমে নীচে ভারি জুতোর আওয়াজ পেল। নিজের স্বভাবজাত শিকারি ইন্সটিঙ্কট জেগে উঠলেও শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে তা সামলে নিল। উপরের দিকে উঠে গেল সিরি বেয়ে যত দ্রুত পারল, দৌরের কারণে শরীরের কোথাও সেলাই খুলে রক্ত বের হচ্ছে বুঝতে পারল ভেজা অনুভূতিতে।
নিজের অফিসে দৌরে এসে ঢুকল রিনিস। এপ্রনটা ছুঁড়ে ফেলে আলমারির গোপন কম্পারটমেন্ট খুলল। সেখানে সাজিয়ে রাখা নিজের অস্ত্রাগার। নিজের পেশেন্ট লোকটার শারীরিক অবস্থা ভালই জানে সে। তার একার পক্ষে এদের সামলানো সম্ভব না। লোকটার বলা কথাটা মাথায় বাজছে রিনিসের, “ইউ আর নট ডুইং ইওর বেস্ট, ইউ কান্ট হোয়েন ইউ হাইড সামথিং সো ফার আওয়ে, সামথিং ইউ আর গুড অ্যাট।”
মনস্থির করে প্রয়োজনীয় অস্ত্রাদি তুলে নিয়ে ছুটল রিনিস। “আই উইল ডু মাই বেস্ট দিস টাইম। নো মোর হাইডিং”
আট
ছাদের সিঁড়িঘরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে লোকটা। সিআইএ এর টর্চার সেলের স্মৃতিগুলো না চাইতেও চখের সামনে ভেসে ভেসে আসছে যেন। শিউড়ে উঠছে। প্রতিশোধ নিতে চাইছে মন সব ভুলে। নিচে থেকে বিছিন্ন গুলির শব্দ আসছে। বুঝতে পারল অভিজ্ঞ লোকটা রিনিস একশনে নেমেছে। আর কোন উত্তর হতে পারেনা এই গুলির সিকোয়েন্স এর। কিছুক্ষন হল থেমে গেছে গুলির আওয়াজ। হয়তো শত্রুরা সবাই মারা পড়েছে। রিনিসের চোখের সেই গোপন সব রহস্য যেন ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে, মনে হচ্ছে লোকটার। এই ক্ষণিকের পরিচয়েই চিনে নিয়েছে যেন যোগ্য সঙ্গী। নয়তো মেয়েটা মারা পড়েছে। না, মন বলছে মেয়েটা মরেনি।
তবুও... সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছে লোকটা। ভারী বুটের আওয়াজ। অনেক পরিচিত এই আওয়াজটা। অনেক গুলো অন্ধকার সময়ে কানে শুনেছে এই আওয়াজ নিজের চারপাশে চক্কর দিচ্ছে। তারমানে মেয়েটা পারেনি...
নিজের ভিতরের শিকারি আর কোন বাধা মানল না। আড়াল থেকে বেড়িয়ে এল। দু’হাত শক্ত মুষ্টিতে বন্ধ। শরীরে যে সেলাই খুলে রক্তের বন্যা নামছে কয়েক জায়গায় তাতে কোন লক্ষ্য নেই। কোন ব্যাথার বিকার নেই। মনে রয়েছে শুধু সেই বাঙ্গালী মেয়েটার জন্যে ভীষণ, অব্যক্ত কষ্ট।
সিঁড়িঘরের দরজাটা খুলে যাচ্ছে, ঝাপিয়ে পরার জন্যে প্রস্তুত হল লোকটা। বরফের মত শীতল চোখগুলো এখন আগুনের মত জ্বলজ্বল করছে।
খুলে গেল দরজা পুরোপুরি। লোকটা ঝাপ দিল দলপতির উদ্যেশে। কিন্তু জানে সে জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। সিআইএ এর দলপতির আঙ্গুল ট্রিগারে চাপ দিয়েছে লোকটা শুন্যে থাকতেই। বুলেটের ধাক্কায় পিছিয়ে মাটিতে পড়ল লোকটা। মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দলপতি। হার মানতে নারাজ অদম্য লোকটা উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিল, তা দেখে হাসছিল দলপতি। হঠাৎ মুখভঙ্গি বদলে গেল তার, গলার ঠিক মাঝ দিয়ে একটা ছুরির ফলা দেখা গেল... রক্তের ধারা বইছে তার দুঃপাশ থেকে। ঢলে পড়ল দলপতি। রিনিসের মুখটা দেখতে পেল এরপর লোকটা। ওর মাথার কাছে বসেছে। নরম কিছুতে মাথাটা তুলে নিতেই জ্ঞান হারাল মানুষটা।
নয়
জ্ঞান ফিরে পেয়ে নিজেকে বিছানায় আবিস্কার করল লোকটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল দেড় ঘণ্টা তার জ্ঞান ছিল না। পাশে বসা রিনিসের দিকে চাইল চোখ তুলে, কিন্তু কেউ কিছুই বলল না। এরকম কিছু সময় নীরবতা বহু কথার চেয়েও অনেক বেশি কিছু বলে।
হাসপাতালের সবাই প্রায় পালিয়েছে। রিনিস এর মধ্যেই ডাক্তারি যা চালানোর চালিয়ে নিয়েছে ওর উপর। লিফটে করে রিনিসের সাহায্য নিয়ে নিচের পারকিং বেজমেন্টে নেমে এল লোকটা। নিজের গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল।
বেড়িয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে গাড়ির পাশে দাঁড়ানো রিনিসের দিকে চেয়ে বলল,
-তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও?
হাসল রিনিস। বলল,
-আই উইল ফাইন্ড মাই ওন ওয়ে।
গাড়ি স্টার্ট দিল লোকটা,
-আবার দেখা হবে, মিস রায়হান। বিদায়।
খাটি বাংলায় কথাটা শুনে ভীষণভাবে চমকে গেল রিনিস। কিন্তু ততক্ষণে বেড়িয়ে পড়েছে লোকটা গাড়ি নিয়ে। আফসোস লাগলো রিনিসের। যে দেশকে নিজের পিতৃভূমি হওয়া সত্ত্বেও প্রায় কখনও জানা হয়নি, দেখা হয়নি, সে দেশের কি অদ্ভুত এক অপরিচিতের সাথে সময়টা কাটালো সে... অথচ কিছুই জানা হলনা দেশটাকে নিয়ে। সময় বড়ই নিষ্ঠুর।
দশ
অনেকগুলো বছর পরের কথা। মালিবুতে নিজের বাড়ির বারান্দায় রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রায়ান। গায়ে একটা পাতলা শার্ট, দুপ্রান্ত হাওয়ায় উড়ছে। হাতে এক মগ কফি।
ওর পেছনে একটা ডিভানে আধ শোয়া হয়ে আছে রিনিস। রায়ানের শার্টটা বাতাসে পিঠ ছাড়িয়ে আরও উপরে উড়ছে... বেশ কিছু পুরোনো ক্ষতের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে রিনিসের অভিজ্ঞ চোখ। কোন এক দিনের স্মৃতি মনে আসতে চাইছে যেন। কোন এক বাঙ্গালী জিবকের স্মৃতি।
হঠাৎ উঠে এসে রায়ানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ও। জানতে চাইল,
-আচ্ছা সৌরভ, একটা কথা বলবে?
-ইয়েস মাই প্রিন্সেস।
উদাস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রিনিস,
-তুমি কেন লড়াই করে যাও?
রায়ানের ঠোটের কোণে একটা হাসি খেলে উঠল। খানিকক্ষণ নীরবতা ভাসল ওদের মাঝে। তারপর যেন বাতাসে ভেসে আসল রিনিসের কানে রায়ানের উত্তর,
-আমি একটি ফুলকে বাঁচাতে যুদ্ধ করি.....
একটা অবর্ণনীয় সুখের ছোঁয়া ছেয়ে গেল রিনিসের মনে।। ঢেউয়েরা যেন সেই সুখের স্পর্শে নিচের তীরে আছড়ে পড়ছে গর্জন করে.....
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:২৯