ব্রিটিশদের দুইশ বছরব্যাপী শোষণ, কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তি ও সাহিত্য, বঙ্গভঙ্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কমিউনিজমের ঢেউ, পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী অভিঘাতে এ অঞ্চলে মুসলমানদের ঐতিহাসিক আত্মপরিচয়ের শিকড় যে অনেকাংশেই কর্তন হয়ে গেছে, তা আমাদের সামনে স্পষ্ট। সেই কাটা শিকড় জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছে লেখক ফাহমিদ উর রহমান। আমার কাছে মনে হইছে প্রত্যেকটা বাঙালির বইটা পড়া উচিত। মিথ্যা ইতিহাস শুনতে শুনতে সত্য আজ আমাদের কাছে মিথ্যা মনে হয়। সেই মিথ্যা ইতিহাসকে নাড়া দিতে লেখকের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।
ইতিহাসের খোলস সম্পূর্ণ বদলে ফেলে ইতিহাসের যে নতুন চর্চা শুরু হয়, সেখানে মৌলিক প্রশ্ন ওঠে, বাঙ্গালী ও মুসলমানিত্ব কি সাংঘর্ষিক? রাজনীতির প্রয়োজনে কখনো কখনো। মিথকে ইতিহাসে পরিণত করা হয় শব্দ হিসেবে বঙ্গ, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী হয়তো অনেকদিন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু একটি ভৌগোলিক এলাকা বা এলাকার অধিবাসীদের পরিচয় জ্ঞাপক হয়ে উঠতে তা দীর্ঘ। বিবর্তন ও প্রক্রিয়াকরণের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
প্রাচীন কালে আজকে যে ভৌগোলিক এলাকাকে আমরা বঙ্গ বা বাংলা বলে থাকি তা কোনো নির্দিষ্ট নামে পরিচিত ছিলো না মুসলমানরা আসার আগে তখন এই ভিন্ন ভিন্ন এলাকা এক অখণ্ড বঙ্গভূমিতে পরিণত হয়নি। সুতরাং সেই যুগে যারা বাস করতেন তারা কখনোই বাঙ্গালী নামে পরিচিত ছিলেন না। অন্যদিকে যে বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে বাঙ্গালী বা বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে তার জন্মকালটাও হিসাবের মধ্যে নেয়া জরুরী। বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো নমুনা হিসেবে যে চর্যাপদের কথা বলা হয়ে থাকে তার বয়স পুরো এক হাজার বছর হয়েছে কিনা তা নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতান্তর আছে। তবে পণ্ডিতরা মনে করেন চর্যাপদকে ঠিক বাংলা ভাষা বলা যায় না। এর মধ্যে অন্য ভাষার উপাদানও আছে। এটি লেখা হয়েছিলো নেওয়ারী অক্ষরে বাংলা অক্ষরে লেখা প্রথম সাহিত্য কীর্তি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন ও শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইছুফ-জুলেখা।
আবার বাঙ্গালী শব্দটার কোনো অখণ্ড রূপ নাই। এর মধ্যে ভাঙ্গনের একটি দিকও আছে। পুরো বাংলাভাষী অঞ্চল বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে দুই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাভাষী মানুষেরা প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বী। এই দুই ধর্মাবলম্বীদের ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে তফাৎ আছে। সংস্কৃতিরও আছে আলাদা রূপ। বাঙ্গালীত্বের সংজ্ঞা নিয়েও মতান্তর। আছে প্রচুর।
ব্রাহ্মণরা প্রাচীন কাল থেকেই আজকের বাংলাদেশের মানুষকে বাঙ্গাল বলতো। এটি তারা বাঙ্গালী অর্থে বলতো না, বলতো পাণ্ডব বর্জিত দেশের ম্লেচ্ছ যবন অর্থে।
সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২- ১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) শুধু বাংলার বিভিন্ন অংশকে ঐক্যবদ্ধ করেননি, তিনি এই ঐক্যবদ্ধ রাজ্যকে বাঙ্গালা হিসাবে নামকরণ করেছিলেন।
মরক্কোর বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্তে বাঙ্গালা নামের উল্লেখ আছে। তখন বাংলার রাজধানী ছিলো সোনারগাঁও। শাসনকর্তা ছিলেন সুলতান ফখরুদ্দিন। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন। সে সময়ে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ বঙ্গাল বা বাঙ্গালা নামে পরিচিত ছিলো এবং এ অঞ্চলের অধিবাসীরা বাঙ্গালী নামে অভিহিত হতো।
দেশ অর্থে বাঙ্গালী হয়ে উঠবার ইতিহাসের বিপরীতে বাংলা ভাষা অর্থে বাঙ্গালী হয়ে উঠবার ইতিহাস খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা। বাংলার ভৌগোলিক সত্তাটা যত পুরনো, বাংলা ভাষা ততটা নয়। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হচ্ছে চর্যাপদ। এই চর্যাপদের জন্ম সূত্র ধরেই হাজার বছরের বাঙ্গালী শব্দটার ব্যবহার হয়। কিন্তু চর্যাপদে বাংলা ভাষার কিছু উপকরণ আছে। তাই বলে এটি বাংলা ভাষা নয়। এর মধ্যে অন্য ভাষার উপকরণও আছে। অহমীয়া, উড়িয়া মৈথিলী ও হিন্দিভাষীরাও এটাকে তাদের ভাষার আদি নিদর্শন বলে দাবি করে। কারণ এসব ভাষার মূল এক অর্থাৎ অপভ্রংশ। এর আগের স্তরের নাম হচ্ছে প্রাকৃত। উপরোক্ত সবগুলো ভাষার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ শব্দগত ও ব্যাকরণগত কিছু কিছু মিল চর্যাপদে দেখা যায়।
বাংলা অক্ষরে বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে মুসলমান আমলে। কিন্তু সেই কালেও বাংলা ভাষার নাম বাংলা হয়নি। একে তখন বলা হতো দেশি ভাষা। (মুসলমান আমলে বাংলা ভাষা নিয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি গর্ব করেছেন তার নাম আবদুল হাকিম। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেও যারা বাংলা ভাষাকে। পছন্দ করে না তিনি তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আবদুল হাকিমও তখন বাংলা ভাষাকে বলেছেন দেশি ভাষা-
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ না যায়।
ভাষাকে ভিত্তি করে বাঙ্গালী পরিচয় ঔপনিবেশিক নির্মাণ। প্রথমে পর্তুগীজ পাদ্রী আস সুন্নসাঁও, পরে ইংরেজ নাথানিয়েল হ্যালহেড বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লিখে বাংলা অর্থে বাঙ্গালীর ধারণাটা প্রচার করেন। পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে যখন বাংলা বই লেখা হতে থাকে অথবা শ্রীরামপুর প্রেস থেকে বই বের হতে থাকে তখনই ভাষা বুঝাতে বাঙ্গালা এবং ভাষা অর্থে বাঙ্গালী শব্দটা একটা বিশেষ অর্থ নিতে থাকে।
উনিশ শতকে কলকাতাকে কেন্দ্র করে, ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রশ্রয়ে যে বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক জগৎ গড়ে ওঠে সেখানে বাঙ্গালী শব্দটা কিন্তু সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি।
যদি বাঙ্গালা কাব্যে ইসলামী ভাবের প্রাধান্য হইলেই তাহাকে 'মুসলমানী বাঙ্গলা' বলিয়া উল্লেখ করিতে হয়, তবে বাঙ্গলার বৈষ্ণব-রচিত পদাবলী সাহিত্যকে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির গৌরবের বস্তু বলিয়া নির্দেশ না করিয়া তাহার গায়ে মুসলমানী বাঙ্গালার ছাপ মারিয়া সে গৌরবটুকু বাঙ্গলার মুসলমানকেই দেওয়া উচিত; কেননা পদাবলী সাহিত্যটির আগাগোড়া মুসলমানদের সুফী-সাহিত্যের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত এবং ভাব-সামঞ্জস্যের প্রাচুর্যে পরিপূরিত। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদের কোনো বাঙ্গালী (অবশ্য বাঙ্গালার মুসলমানকে বাদ দিয়া) তাহা করিতে স্বীকৃত আছেন বলিয়া মনে হয় না। এই হিসাব ধরিতে গেলে, কবি নজরুল ইসলামের 'হাফেজের অনুবাদ' এবং নরেন দেবের, 'ওমর খৈয়াম' সমভাবে' মুসলমানী বাঙ্গালা'। কিন্তু, হিন্দুগণ কান্তিঘোষ কি নরেন দেবকে 'মুসলমানী বাঙ্গালা'র লেখক বলিয়া এক ঘরে করিয়াছেন?
আসল কথা হচ্ছে, ফোর্ট উইলিয়ামের পথ ধরে বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে যে জাতীয়তাবাদ তৈরি হলো তার হিন্দুয়ানী কাঠামোটাই প্রধান। অবস্থা এমন দাঁড়ালো রাজনৈতিক ক্ষমতার সূত্রে বাঙ্গালী-হিন্দুরা বাঙ্গালী শব্দটাই আত্মসাৎ করলো এবং বাঙ্গালী মানেই হিন্দু এই সমীকরণ তৈরি করলো। মুসলমানরাও যে বাংলাভাষী এটা তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় স্থান পেলো না (প্রগতিশীল লেখক এস ওয়াজেদ আলী, যিনি মুসলিম লীগের স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতিকে সমর্থন করেননি, বিভাগ পূর্বকালে হিন্দু-মুসলিম যৌথ জাতীয়তাবাদের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তার চোখেও এ জিনিসটা গভীরভাবে ধরা পড়েছিলো। তিনি লিখেছেন- বিশ্ব মানবতার বড় সমর্থক হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্ব মানবতার বিষয় নিয়ে যত লিখেছেন, আর কেউ বোধ হয় তত লেখেননি। তাঁরই লেখা পড়ে এবং বক্তৃতা শুনে একদল দেশপ্রেমিক আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছেন। আর তারা ইসলামী সভ্যতাকে বাঙ্গালা দেশ থেকে তাড়াবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন এবং হিন্দু ও মোসলেম সভ্যতার সমন্বয় করে নতুন একটা কিছু গড়বার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা এসব করেছেন। তিনি অশেষ কষ্ট করে ভারতবর্ষ থেকে বড় বড় পণ্ডিত সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদ্র বালী দ্বীপে যাচ্ছেন হিন্দু কালচারের পুনরুত্থানের জন্য; পটরাজের পালা লিখেছেন, বাঙ্গালী ছেলেদের হিন্দু পৌত্তলিকতার আধ্যাত্মিকতা শেখাবার জন্য বেদমন্ত্র পাঠে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি উৎসব সম্পন্ন হচ্ছে প্রাচীন হিন্দু আদর্শকে জাগিয়ে রাখবার জন্য। যে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ লিখলে দশবার তাতে উপনিষদের উল্লেখ করতে ছাড়েন না, তাঁরই নির্দেশিত পথের অনুসরণ করে আমাদের সমাজের কতিপয় সাহিত্যিক ইসলামিক কালচারের শত্রুতা সাধনে আত্মনিয়োগ করেছেন। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস।
এই সেই দিন মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণশীল ভারতে, মিশনারীদের তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করতে দেবেন না। কারণ, তাঁদের নিজস্ব ধর্মবাদই ভারতবাসীর পক্ষে যথেষ্ট। হিন্দুরা তাঁদের জাতীয় কালচারের প্রয়োজন কতটা অনুভব করেন, রবীন্দ্রনাথের এবং মহাত্মা গান্ধীর সাধনা ও উক্তি থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। হিন্দু সভ্যতা এবং স্বাধীনতার পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বঙ্কিমচন্দ্র দেখেছিলেন। সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য আজ সমস্ত হিন্দু সমাজ উঠে পড়ে লেগেছেন। হিন্দু যে ভবিষ্যৎ ভারতীয় কালচারের স্বপ্ন দেখেন, তা লুপ্ত হিন্দু সভ্যতার দ্বিতীয় সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নহে।
এইভাবে হোসেন শাহের বাংলা যেভাবে বাংলাভাষীদের একত্রিত করার চেষ্টা করেছিল, ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলা তার উল্টো দিকে হাঁটলো এবং বাংলাভাষীদের বিচ্ছিন্ন করে দিলো।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার প্রবন্ধে স্বীকার করেছেন বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে এক অপূর্ব মুসলমানী ভাষা তৈরি হয়। এটা মুসলমানী আমলের ভাষার ধারাবাহিকতার মাত্র। এই ভাষাই পুঁথি সাহিত্য। একে দোভাষীও বলা হয়ে থাকে। কারণ এতে আরবী- ফারসী শব্দের মিশাল আছে। হিন্দু সাহিত্যিকরা এটিকে বটতলার পুঁথি হিসেবে ব্যঙ্গ করেছেন। কিন্তু এটি ছিলো সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানের ভাষা। এর ভিতর দিয়েই সেদিন তারা তাদের কল্পনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও জীবন ভাবনাকে প্রকাশ করতে চেয়েছে। যেহেতু ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলা তাদের কাছে অপরিচিত ও অবজ্ঞাত ঠেকেছে, তাই তারা এই ভাষার আশ্রয় নিয়েছে। এই ভাষাকে জেমস লং বলেছেন মুসলমানী বাংলা, হ্যালহেড বলেছেন debased Bengali আর সুকুমার সেন বলেছেন ইসলামী বাংলা। অথচ এই বাংলা আধুনিক সময়েও প্যারীচাদ মিত্র কৃত আলালের ঘরের দুলাল-এর মতো সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। যে | বাংলা বঙ্কিম নেননি কিন্তু কিছুটা প্রশংসা করেছিলেন
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:২৪