দ্বিতীয় পর্ব প্রথম পর্ব
সম্রাট আকবর হিজরী সনের সাথে সৌর মাসের সঙ্গতি রেখে ফসলী সনের প্রবর্তন করেছিলেন ভারতে। আর এই ফসলী সন ও বালায় উদয় খাঁনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রচলিত হতে পারেনি। বঙ্গাব্দ বা বাংলা নামের কোন মৌলিক বা নিজস্ব সম্পদ নয়। ইংরেজী ও হিজরীর মতো বিদেশী সন। ফসলী সনের সঙ্গিয় কারন মাত্র। সম্রাট আকবর তার ফসলী সনে নিজ সৃষ্ট কোন মাস বা বার সংযোগ করতে পারেননি। তিনি তার সনে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে চৈত্র পর্যন্ত সব মাস ও শনি বার থেকে শুরু করে শুক্রবার দিনগুলির তৎকালে প্রচলিত 'শকাব্দ' ও 'বিক্রম সম্বত' সন থেকে গ্রহন করেছেন। এসব মাস ও বারের নাম থাকে গ্রহন করেছেন। যেমন বিশাখা, জ্যৈষ্ঠ, পূর্বাষাঢ়া, শ্রাবণী, পূর্বাভাদ্র পদ, আশ্বিনী, কুত্তিকা, মৃগশিয়া, পূষ্যা, মাঘ, পূর্ব ফালগুনী চিত্রা নক্ষত্রের নাম থাকে বার মাসের নাম এবং শুক্র, শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহঃস্পতি নাম থেকে বারের নাম নেয়া হয়েছে। এই সব নাম দ্রাবিডিয়ান ও আর্যদের দেওয়া। পরে তা শকাব্দ, বিক্রম সম্বত, গুপ্তাব্দ ও লক্ষণ সন ইত্যাদি সন বর্তমান রুপে ব্যবহার করা হয়। আকবর ঐ মাস ও বারকেই তার সনে ব্যবহার করেন।
খৃষ্ট জন্মের ৩০০০ বা ৫০০০ বছর পূর্ব হতে তামিল সনে আজও বার মাসের নামগুলি নিম্নরুপ চিত্তিরাই ৩১, বৈগাছি ৩২, আডি ৩১, আভানা ৩১, পরাননি ৩০, ইপাছি ৩০, কীর্তিগাই ৩০, গামারী ৩০, থাই ২৯, মাচি ৩০, ফানগুনী ৩০।
খৃষ্ট জন্মের ৫৮ বছর পূর্ব থেকে যে বিক্রম সম্বত সন এবং ৭৮ বছর পরে যে শকাব্দ বা শাকাবর্ষ ও ৩১৯ বৎসর পর যে গুপ্তাব্দ সনের জন্ম হয় এদের মাস গুলি নিম্নরুপ: বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবন, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ন, পৌষ, মাঘ, ফালগুন, চৈত্র।
ভারতবর্ষে একমাত্র কেরালাতে ভারতীয় কোন সন ব্যবহার হয় না। তারা কোলাবর্ষম নামে নিজেদের সন ব্যবহার করে থাকেন যা মৌলিক। তাদের মাসের নাম গুলি হলো: সিংগাম ৩০, কন্নি ৩০, ধনুকম ৩০, সরকম ৩১, তুলুম ৩০, কুম্ভম ৩০, মিনম ৩১, মেডম ৩১, ইটাওম ৩২, মিথুনম ৩১, কর্কটম ৩১ । ভারতবর্ষের তথা বাংলার রাশির নামগুলি কোলাবর্ষম থেকে নেয়া। আর তাই শকাব্দ, বিক্রম সম্বত, গুপ্তাব্দ, কোলাবর্ষম ইত্যাদি থেকে ধার করা মাস ও দিন সম্বলিত কোন সনই বাঙ্গালীর নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী নয়। বাঙ্গালীর কৃষ্টি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সামস্যহীন অবাঙ্গাল সম্রাট আকভর প্রচলিত 'ফসলী সন' কোনক্রমেই বাঙ্গালীর নিজস্ব সম্পদ নয়। কোনক্রমে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনও হতে পারে না ।
পহেলা বৈশাখ কি বাঙ্গালীর উৎসবের দিন ? এটা কি বাঙ্গালীর নিজস্ব ঐতিহ্য ও কৃষ্টির ধারক-বাহক? দ্রাবিডিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত তামিলেরা (তামিল নাড়ুর অধিবাসী) খ্রীষ্ট জন্মের তিন হাজার বৎসর পূর্ব থেকেই 'বৈগাচি' নামের একই মাসের প্রথম দিনকে তাদের উৎসবের দিন হিসাবে পালন করে আসছে।মালায়ালাম বাসী কেরালার রোকদের কোলাবর্ষম ক্যালেন্ডারেও আমাদের পহেলা বৈশাখ ১৪ই এপ্রিল তাদের সংক্রান্তির দিন। শকাব্দ, বিক্রম সম্বত, গুপ্তাব্দ সনেও ১লা বৈশাখ থেকেই বৎসর গননা শুরু হয়। পাকিস্তানের পান্ঞ্জাব, ভারতীয় পান্ঞ্জাব, দিল্লী, রাজস্হান, মহারাষ্ঠ্র, ভারতের উত্তর ও মধ্য প্রায় খ্রীষ্ট জন্মের পূর্ব থেকেই ১লা বৈশাখ উৎসবের দিন হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। সুতরাং পহেলা বৈশাখ পালনে বাঙ্গালীর স্বতন্ত্রতা কোথায়।
একথা সত্য যে, আকবরের ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রচলিত ফসলী সনকে তৎকালীন বাংলায় ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের পর সন গণনার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। সম্ভবত মীর জুমলার আমলেই বাংলায় আকবরের সনকে চালু করা হয়। মীর জুমলার ত্রিপূরা জয় করেছিলেন। ফলে বাংলা ও ত্রিপূরায় একই সময়ে এই সন চালু হয়। তখন থেকেই বোধ হয় আকবরের ভারতীয় 'ফসলী সন' বাংলায় বঙ্গাব্দ ও ত্রিপূরায় ত্রিপূরাব্দ হিসাবে প্রচলিত। বঙ্গাব্দ ও ত্রিপূরাব্দের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৪১৫ বঙ্গাব্দ আর ত্রিপূরায়ও ১৪১৫ বঙ্গাব্দ।
ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রমাণিত যে, সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে যে সর্বভারতীয় সন প্রচলন করেছিলেন তার নাম 'ফসলী সন' তা কোনমতে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন নয়। মোঘল ইতিহাস বা দলীল দস্তাবেজে কোথাও উল্লেখ নেই যে, বাংলার লোকদের জন্য নির্দিষ্ট কোন বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন চালু করেছিলেন। সত্য কথা এই যে, বঙ্গাব্দ বা বেংলা সনের উৎপত্তির তথ্যভিত্তিক কিন ইতিহাস নেই। বাংলাদেশের তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবিরা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের জন্মের সাথে সম্রাট আকবরের নাম জুড়ে দিয়েছেন। ইতিহাসে বঙ্গাব্দ নামের কোন সন নেই। এই বঙ্গাব্দ ভারতীয় ফসলী সনের বঙ্গীয় রুপান্তর মাত্র। সমগ্র ভারতবর্ষকে উপেক্ষা করে সম্রাট আকবর শুধুমাত্র বাংলার জন্য কেন বাংলা সন প্রচলন করলেন তার তথ্যভিত্তিক ইতিহাস কি ? তাছাড়া বাংলাদেশে শকাব্দ, লক্ষণ সন, গুপ্তাব্দ সনের মতো সৌর সনের প্রচলন থাকা সত্ত্বেও আকবরের সর্বভারতীয় ফসলীসনকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন হিসাবে কেন গ্রহন করা হলো ?
বিঃ দ্রঃ-
( মূল লেখক আমি নই। লেখাটি পেয়েছি একটি বৈশাখী স্বরনিকা থেকে। স্বরনিকাতে লেখক হিসাবে যার নাম উল্লেখ আছে তা হলো এ, বি, এম, ফয়েজ উল্লাহ। লেখাটির শেষে লেখা আছে " লেখকঃ কলামিষ্ট, নজরুল গবেষক ও জাগরন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ।"
লেখাটি আমার ভালো লেগেছে তাই এখানে তুলে দিলাম। লেখার পুরো কৃতিত্ত্ব মূল লেখকের।)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৩:০৪