বলা হয়ে থাকে ভারত সম্রাট মহামতি আকবর বঙ্গাব্দের প্রচলন করেছেন। সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। তখন ভারতে শকাব্দ, বিক্রম সম্বত, গুপ্তাব্দ, লক্ষন সন, হিজরী ও খ্রীষ্টাব্দ সহ বহু সনের প্রচলন ছিল। তবে রাজ দরবারে চন্দ্র মাসের হিজরী সনের হিসাবেই রাজকার্য ও উৎসব অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা হতো। অব্যশই আকবরের আমলে পান্ঞ্জাব, দাক্ষিণাত্য, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, দিল্লী ও তামিল নাড়ুতে শকাব্দ এবং কেরালাতে কোলবর্ষম ও বাংলায় লক্ষন সন, মগীসন, গুপ্তাব্দ সন নামক বহু সনের প্রচলন ছিল। বৎসরের একটি নির্দিষ্ট দিনে সারা ভারতে সম্রাট তার প্রজা সাধারনের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে যেন সমর্থ হন এবং ঐ দিন যেন ভারত উৎসবের দিনে পরিণত হয় সেজন্য হিজরী সনের পরিবর্তন জরুরী হয়ে পড়ে। কারণ হিজরী সন যেহেতু প্রতি বৎসর ১০/১১ দিন এগিয়ে যায়। ফলে খাজনা বা পূণ্যাবর দিন প্রতি বৎসরই পরিবর্তন হয়। এই দূর্ভোগ থেকে বাচার জন্য সম্রাট একটি নতুন সন প্রচলন করেন। তার নাম 'ফসলী সন'।
এই ভারতীয় সন প্রচলনে মহামতি আকবর স্বতন্ত্র কিছু না করে তৎকালীন হিজরী সনকেই সৌর সনে পরিবর্তন করেছেন। এটি আকবরের কোন মৌল সৃষ্টি নয়। বরং শকাব্দ, বিক্রম সম্বত, গুপ্তাব্দ ও তামিল সনের কার্বন কপি মাত্র। কারন তৎকালে শকাব্দ ও বিক্রম সম্বত ইত্যাদি সৌর সনে ব্যবহারকৃত মাসের নাম যেমন ছিলঃ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রাহায়ন, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এবং সপ্তাহের সাত দিনে নাম ছিল শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার ঠিক তেমনি অবিকৃতভাবে ঐ সব মাস এবং দিন গুলিকেই আকবর তার সনে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ মুসলমানের হিজরী সন এবং দ্রাবিড়, আর্যদেও মাস ও বার। হিজরী চন্দ্র মাসের এবং শকাব্দ ও বিক্রম সম্বত ইত্যাদি মাস ও দিনগুলো সৌর সনের। এগুলোর মিশ্রনই হলো আকবরের সন। যা প্রর্বতনে আমির ফতেই উল্যাহ সিরাজির প্রভাব অবদান প্রচুর। আকবর তার সনের নাম দিলেন 'ফসলী সন'। ফসল কাটার সময় খাজনা উসুল করার সুবিদার জন্যই এই সনের প্রচলন। আকবর যখন তার 'ফসলী সন' প্রবর্তন করেন তখন হিজরী ছিল ৯৬৩ সন। আকবরের ফসলী সনের জন্মকালও ৯৬৩। এখানে একটি কথা প্রাণিধানযোগ্য তা হলো প্রত্যেক সনই জন্মলগ্ন থেকে ১ সংখ্যা দিয়ে শুরু হয়েছে। খ্রীষ্টের জন্ম সনের সাথে সঙ্গতি রেখে খ্রীষ্টাব্দ। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মক্কা থেকে হিজরতের সময় কাল থেকে প্রথম হিজরী গণনা করা হয়। তেমনি শকাব্দ, শুপাব্দ, কোলাবর্ষম, বিক্রম সম্বত সহ প্রত্যেক সনই প্রবক্তাদের জন্মকাল বা ঘটনা কালের সূচনা থেকেই গণনা করা হয়। শুধুমাত্র আকবরের 'ফসলী সন' এর ব্যতিক্রম। জন্মকালেই এই সনের বয়স ৯৬৩ বৎসর। অর্থাৎ হিজরীও ফসলী সনে কোন প্রভেদ নাই। সৌর ও চন্দ্র মাসের গণনায় শুধু প্রভেদ। যার ফলে হিজরী সন প্রতি বৎসর বাংলা সন থেকে দশ এগারো দিন করে কম পড়ে যায়। বাংলাদেশে লক্ষন মঘি মনের শকাব্দের মতো ভারতে সৌর সনে প্রচলন থাকা স্বত্তেও আকবরের এই অমৌলিক সনটাকেই বাংলাদেশের তাত্ত্বিক বুদ্বিজীবি ও পন্ডিতেরা 'বঙ্গাব্দ' নামে অভিহিত করেছেন। পন্ডিতেরা প্রায় সবাই এক বাক্যে বলেন যে সম্রাট আকবর 'বঙ্গাব্দ' বা বাংলা সনের প্রচলন করেছেন। অথচ ভারতের ইতিহাসে 'বঙ্গাব্দ' নামে কোন সন সম্রাট আকবর প্রচলন করেছেন বলে উল্লেখ নাই।
আসমুদ্র হিমাচল তথা কাবুল থেকে বার্মা, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত উপমহাদেশের কোথাও 'বঙ্গাব্দ' নামক কোন সনের প্রচলন নেই। এর একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ বা তৎকালিন পূর্ব বঙ্গ। পশ্চিম বঙ্গেও শকাব্দ সনই প্রচলিত রয়েছে। যা বর্তমান ভারতের রাজসন। স্বভাবতঃই আজ প্রশ্ন জাগে দিল্লীশ্বর পুরো ভারতকে বণ্ঞ্চিত করে শুধুমাত্র বঙ্গ দেশের জন্য বঙ্গাব্দ' বা বাংলা সনের প্রচলন কেন করেছেন ?
(চলবে)
১ম পর্বের সমাপ্তি
(চার পর্ব)
ছবি গুলো ইন্টারনেট হতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৫:৪৫