somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক সিন্ধি সমরু খান

১১ ই জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এটা একটা আত্মজৈবনিক রচনার খন্ডিত গল্পাংশ

এক সিন্ধি সমরু খান

জলে কামট স্থলে স্বাপদ- কোথাও নিরাপদ নই। না- রাজশাহী, না অন্য কোনখানে। ঢাকার অবস্থাতো স্বচোখে দেখেই এলাম। কি করবো কিছু স্থির করতে পারছিনা। রাস্তা বেরিকেড দিবার দায়ে মিলিটারির খাতায় দেশদ্রোহী দন্ড-পাওয়া আসামী। রাজাকারদের মরণ তালিকায় শীর্ষস্থানে। শান্তিকমিটির চোখে অবাঞ্ছিত- দেশের শত্রু। পুলিশের নথিতে ‘ওয়ানটেড পারসন’। এতগুলি দন্ড মাথায়,-জীবনটাকে মুঠোয় নিয়ে লুকোচুরি খেলছি। এভাবে আর কতদিন ফাঁকি দিয়ে বাঁচবো। এমনই এক সন্ধ্যারাতে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার পর রেডিওটা অফ করে কয়েকজন বসে গল্প করছি। সে সময় গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা ছিল এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার- ধরা পড়লে শাস্তি অবধারিত। কিন্তু ওটা শোনার নেশা কম বেশী সবারই, যদিও সে সময় রেডিও-ট্রানজিসটার আজকের মত সবার ঘরে ঘরে ছিলনা।
যাদের ছিল তাদের ওখানে গোপনে ভীড় জমে যেত। ঠিক এমনই সময়ে এলাকার রাজাকার প্রধান মাইনুল ও তার প্রধান সহচর রশিক-উভয়ের কাঁধেই রাইফেল-যমদুতের মত একেবারে সামনে হাজির। এদের দেখেই আত্বারাম খাঁচাছাড়া।
দলবল নিয়ে জয় বাংলা শুনে খুব খোশ গল্প হচ্ছে,না? বলেই সামনে রাখা ট্রানজিস্টারটা অন করলো। ভাগ্যিস ওটা অফ করার আগে ঢাকা ধরে রেখে ছিলাম।
মিনমিন করে বললাম, এটাই শুনছিলাম এতক্ষণ। লিডার আমার কথা আমন না দিয়ে- শাসনের সুরে কড়া মেজাজে বললো-জানি এতক্ষণ কি শোনা হচ্ছিল,সব খবর রাখি; টের পাইয়ে দেব!
ওই অর্বাচীনটা ছিল এলাকার ত্রাস। কারো বাড়ি হানা দেয়া মানে তার ‘মালেকুল মওত’ প্রস্তুত। কিন্তু ওর প্রধান সহচরটি ছিল আমার নিকটজন ও বিস্বস্ত। সব সময় ওদের গোপন খবরগুলি আমাকে সরবরাহ করতো। ওর ভরসায় আমি এতদিন চলছি। তবে আমি যে লিডারের টার্গেট সে কথা ও আমাকে স্মরণ করে দিয়েছিল। আমাদের কাছ থেকে লিডারকে টেনে নিয়ে চলে গেলে মনে হলো দুজনেই নেশাগ্রস্থ। ওরা যাবার সঙ্গে সঙ্গে আলাপরত সবাই চম্পট দিল, আমিও অন্যত্র সরে পড়লাম।
ওই সময় সবাই অন্ধকারে চলাফেরা করতেই বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করতো। সন্ধ্যার পর পরই খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে বাড়ীর সমস্ত আলো নিবিয়ে দিত। কোন সাড়া শব্দ যাতে বাইরে না যায়-সেজন্য দরজা জানালাগুলি ভালভাবে আটকিয়ে ঘরের ফুটাফাটাগুলি পর্যন্ত বন্ধ করে রাখতো। ওই সময় ছোট-ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল। সন্ধ্যার পরেই নেমে আসতো ভয়াল শূন্যতা, মনে হতো মৃত্যের শহর। সেই সঙ্গে অমঙ্গলসূচক,কুকুরের দীর্ঘ করুণ কান্না। পরিবেশ আরো ভৌতিক হয়ে উঠতো। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা যে রাতে শহরের কোথাও বোমা ফাটাত সে রাতে শহরবাসী একটু নিশ্চিন্তে থাকতো, নইলে সারারাত মিলিটারির গাড়ির শব্দে এবং নারী-পুরুষের আর্ত চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠতো। সারারাত উতকন্ঠিত হয়ে জেগে কাটাতে হতো। মাঝে মধ্যে গাছের ডালে মশা-পোকামাকড়ের কামড় খেয়েও ঘাপটি মেরে থেকে পুর্ব-দিগিন্তে আলস্য-ভাঙ্গা রক্তিম সূর্যের অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো।
একাত্তরে প্রকৃতিও থাকতো ভারাক্রান্ত-সারাক্ষণই বৃস্টি হতো। আর মেঘের এমন বিকট গর্জন মনে হতো শ’য়ে-শ’য়ে রকেট ছোড়া হচ্ছে, পাক সেনারা সে সময় ভয়ে লুকিয়ে যেত।একাত্তর সালের মত ওমন গুরুগম্ভীর দীর্ঘ মেঘের গর্জন পুর্বে কোনদিন কেউ শোনেনি এখনও আর শোনা যায়না। মনে হতো আল্লাহও বোধ হয় ওদের উপর বিরুপ।
হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল পাশের এলাকার আব্দুল গফুর সাহেবের সঙ্গে, ও আমার নিকট আত্বীয় (ইনকাম ট্যাক্সের উকিল, বর্তমানে পঙ্গু) বললাম, কি ব্যাপার আপনি রাজশাহীতে ? মুখে আঙ্গুল চেপে সতর্ক করে বললো,-
সবাই জানে আমি গ্রামের বাড়ি ছিলাম, আজই ভারত থেকে এসেছি। আপনার দলের সবাই আপনার জন্য উদ্বিগ্ন। আপনার ভারতে যাবার ব্যবস্থা করার জন্য আমাকে ভার দিয়েছে। আপনি কখন যাচ্ছেন বলেন, না গেলে আপনাকে অস্ত্রের মুখে জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে।
কাপুরুষের মত ভারতে আশ্রয় নিতে চাইনা,আবারও দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলাম।
পরে আমার লোকজনদের ফরমাইশ মত আমি আর গফুর সাহেব বেশ কিছু তথ্য ও ম্যাপ সংগ্রহ করলাম-পরদিন ও ওগুলি নিয়ে ভারতে চলে গেল। যাবার সময় আমাকে বার বার সতর্ক করে গেল আমি যেন খুব সাবধানে থাকি।
বেশ ক্যদিন পর আবারও ওর সঙ্গে দেখা হলে চুপিচুপি বললো-
দুজন মুক্তি এসেছে ওদের থাকা ও নিরাপত্তা নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছি। যেখানেই রাখছি, কিভাবে যেন জানাজানি হয়ে যাচ্ছে, বুঝছিনা। আপনার বাড়িতে কি ওদের রাখা সম্ভব হবে ! বললাম, আমার তো কোন অসুবিধা নেই, তবে ওদের নিরাপত্তার ওই একই প্রশ্ন দাঁড়াবে। আমার এলাকা খুবই ঘন বসতিপূর্ন- জানাজানি হবার আশংকা শতভাগ। শেষ পর্যন্ত চিন্তা ভাবনা শেষে সব চেয়ে নিরাপদ মনে করে হাতেম খান গোরস্থানে কবরের মধ্যে ওদের রাখার ব্যবস্থা করা হলো। এরপরেও কিভাবে যে শান্তি কমিটির লোকজন গন্ধ পেয়ে গেল-বুঝলাম না। আমার এলাকার শান্তি কমিটির মেম্বার নাসির মিয়া গোপনে ডেকে নিয়ে বললো-
মুক্তি বাহিনীর লোকজন নাকি আমাদের এলাকায় আশ্রয় নিয়ে আছে।
কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম! এত গোপনীয়তার মধ্যেও জানাজানি। স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম- কই জানি না তো? কোথা থেকে খবর পেলেন?
নাসির মিয়া আমার বয়ঃজ্যেষ্ঠ, নিরীহ মানুষ, আমাকে খুব স্নেহের চোখেই দেখতেন। বললেন- ওসব ঝামেলা আর রিস্কের মধ্যে না থাকাই ভালো।
তাড়াতাড়ি গফুর সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আলাপ আলোচনার পর ওই দিনই দু’জন মুক্তিকে খুব গোপনে শহর থেকে বের করে নিরাপদে বর্ডারে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা হলো। ওইদিন অতিদ্রুত কয়েক দফা পরিকল্পনা পরিবর্তন করে নিরাপদে ওদের পাঠাতে পেরেছিলাম। ওইদিনটি ছিল আমাদের জন্য ভয়ংকর উত্তেজনাপূর্ন- স্বরণীয় দিন। ওদের পার করার কিছু সময়ের ব্যবধানে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ডি আইবি লোকজন এলাকা ঘিরে ফেলে। অল্পের জন্য সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম।
রাজশাহী শহরের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের এলাকায় অবস্থিত। এখান থেকে সারা শহরে বিদ্যুৎ বিতরন করা হতো, এর গুরুত্ব অপরসীম। পাক-সেনারা এই গুরুত্বপুর্ন কেন্দ্রটি সদা বেস্টনী দিয়ে রাখতো। রাতের বেলা ওরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে বের হতোনা বলে এলাকার লোকজনদের পালাক্রমে পাহারা দিতে হতো। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের বলে দিয়েছিলাম যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পুর্ন উড়িয়ে দিতে পারিস তবেই আসিস,নইলে অযথা এলাকার লোকজনদের দুর্ভোগ বাড়াসনে, কিন্তু হঠাৎ একদিন অন্য একটি গ্রুপ গোয়ার্তুমি করে দিনের বেলায় বোমা ফাটিয়ে চম্পট দেয়। এলাকায় হুলুস্থুল অবস্থা, মিলিটারিরা অনেক নিরীহ লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়।
এত দুর্যোগ বিপদের মধ্যেও এমন কিছু কিছু ব্যাপারে আনন্দ অনুভূতিও প্রাণে দোলা দিত। এ সময় পরিচয় হয়েছিল এক পাকিস্তানী পুলিশ অফিসার সমরু খানের সঙ্গে। বেসামরিক প্রশাসন চালু রাখতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক লকজন নিয়ে আসা হয়েছিল সে সময়। তাদেরই একজন ছিল এই সমরু খান। বাড়ি সিন্ধু প্রদেশ। অমায়িক সজ্জন ভদ্রলোক। ওর সাথে আমার গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। ভদ্রলোক আমাদের সংগ্রামের প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল। পাক-সরকার ওদের যে সমস্ত কথা বলে এদেশে নিয়ে এসেছে সবই মিথ্যে ও ধাপ্পা। পূর্ব-পাকিস্তানীরা নাকি সমস্ত বিশ্বাসঘাতক আর হিন্দু। ওর দেশে আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যে সমস্ত চিঠিপত্র লিখে পাঠাত, তাতে পাক-বাহিনীর বর্বরতা-জ্বালাও পোড়াও ও ধর্ষণের বিবরণ থাকতো। প্রতিটি লেখা চিঠি ও আমাকে পড়ে শোনাত। পাক-সরকারের হাতে এধরনের চিঠি পড়লে বিপদ হবে না ? জিজ্ঞাসা করলে বলতো-
আমাদের চিঠির কোন সেন্সর করার নিয়ম নেই। ওটা তোমাদের জন্য প্রযোজ্য।
একদিন ও বলেছিলো; তোমাদের এ শহরের প্রধান রাজাকার এর বাড়ীটা আমাকে চিনিয়ে দিও তো। আমি ওর বাড়ী অপারেশন করবো, শালা গাদ্দার। বাঙ্গালি হয়ে বাঙ্গালির দুশমন। ওর মাস্তানী টের পাইয়ে দেব। কিন্তু বেচারা ওই কাজটি করার সুযোগ আর পেলনা, হঠাৎই ওকে বদলী করা হলো ব্রাক্ষণবাড়ীয়া জেলায়। ওর বদলীকৃত জায়গাটার নাম শুনেই আমি সেদিন চমকে উঠেছিলাম, ওই সময় ব্রাক্ষণবাড়িয়া ছিল পাক-বাহিনীর মরণ ফাঁদ। ওখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।
তুমি সিন্ধি বলে পাঞ্জাবী কতৃপক্ষ জেনে শুনে তোমাকেই ওই মরণ ফাঁদে পাঠাচ্ছে। তোমার মত আরো তো পাঞ্জাবী অফিসার রয়েছে তাদের পাঠাচ্ছে না কেনো? কথাগুলি শোনার পর ওর চেহারা রক্তবর্ণ ধারন করে। আমার কাছ থেকে গিয়ে ফোনে ওর পাঞ্জাবী বস এস,পি সাহেবের সঙ্গে ভীষণ কথা কাটাকাটি শুরু করে। সমরু খান একদিন খুব আফসোস করে বলেছিলো-আজ হোক কাল হোক তোমাদের স্বাধীনতা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু এরপর পাঞ্জাবীরা আমাদের উপর স্টীম রোলার চালাবে, ওরা একচ্ছত্র মালিক হয়ে যাবে। ওদের খবরদারীর কেউ থাকবে না। সিন্ধু, বেলুচ, পাঠান সংখ্যায় কম আর তোমাদের মত মেধাসম্পন্ন বুদ্ধিমান-সচেতন তো আমরা নই, কাজেই পাঞ্জাবীদের দাপট একচেটিয়া আমাদের উপর পড়বে। তার কথাগুলি সর্বৈব সত্য, কিন্তু কোন উপায় আর ছিল না। সমরুখানের বাংলা শেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল, কিন্তু ওর সব ইচ্ছেই অপুর্ণ থেকে গেল। যাবার সময় ওর সিন্ধের বাড়ির ঠিকানা, ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার বর্তমান ঠিকানা দিয়েছিল। আমার ঠিকানাও নিয়েছিল। ওর বিদায় মুহুর্তটা আমার এখনও স্মৃতি হয়ে আছে। ওই সাত ফুট লম্বা বিরাট দেহী মানুষটার সহজ-সরলতা, চোখের পানি এখনও আমি ভুলতে পারিনা। ও কসম করে বলেছিলো, দেশে ফিরে গিয়েই চিঠি দিবে। কিন্তু আজ এত দীর্ঘ বছর পার হয়ে গেল-এখনও আমি ওর চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনছি।
সমরু খান রাজশাহী থাকা অবস্থায় আমার সাহস ও বুকের বল দুটোই খুব বেশী ছিল। কোথাও কোন বিপদ-আপদ বা অসুবিধায় পড়লে ওকে ব্যবহার করতাম, এমনকি ওর রিভালভারটা পর্যন্ত আমাকে ব্যবহার করার গোপন অনুমতি দিয়েছিলো। ও চলে যাবার পর মানষিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ি। আমার হতাশা আবারও বেড়ে যায়।
এমনই দিনে আবারও দেখা হলো- গফুর সাহেবের সঙ্গে।
ওকে বললাম, আর বোধ হয় এখানে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। রাজাকারদের হাত থেকে বুঝি আর রক্ষা নেই। আমার কথা শোনার পর গফুর সাহেব আশার বাণী শোনালেন।
বললেন, আর চিন্তার কারন নেই দেশ শীগগীরই স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। কথাটা কেমন যেন হেয়ালী মনে হলো। আবারো বললেন, ওরা এখন আরো মরণ কামড় দিবে, খুব সাবধানে থাকবেন এবং চোখ কান খোলা রাখবেন। দু’একদিনের মধ্যেই মুক্তি বাহিনীর বিমান আক্রমন শুরু হবে। ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রাখারও পরামর্শ দিলেন। তখন কথাগুলি অবিশ্বাস্য মনে হলেও দু একদিনের মধ্যে তা সত্যে পরিণত হলো, হঠাৎই একদিন বিকালে পাকসেনাদের অবস্থানে প্রচন্ড বোমা বর্ষণ করে চলে গেল মিত্র বাহিনীর বিমান। মনের মাঝে আনন্দের ঝিলিক বয়ে গেল। গফুর সাহেবের কথা সঠিক প্রমানিত হলো। পাকসেনারা ঘাবড়ে গেল। ক্রমেই ওদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যেতে লাগলো। খ্যাপা কুকুরের মত জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্বিদিক বর্বরতার মাত্রা আরো বৃদ্ধি করে চললো।
ক্রমেই মনে হতে লাগলো স্বপ্নের সেই কাঙ্খিত দিন বুঝি আগতপ্রায়। বিশাল সেনা-বাহিনী, অঢেল আস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ কামান বন্দুক থাকা সত্বেও, পৃথিবীর অন্যতম সেরা বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর পরাজয় স্বীকার করে নত মস্তকে আত্বসমর্পন করে বিশ্বের ইতিহাসে এক নজির সৃস্টি করলো। এই বুঝি বিধাতার অমোঘ বিধান। সেদিনের আনন্দ অনুভূতি মানসিক অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করা ছিল সাধ্যাতিত। মাত্র ন’মাসের এক অসম যুদ্ধে বীর বাঙালিরা পৃথিবীর বুকে এক নতুন রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো। -যা কদিন আগেও ছিল অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয়।
মিত্র বাহিনী এদেশে প্রবেশ করে পরাজিত পাক-বাহিনীর ট্যাঙ্ক, যুদ্ধাস্ত্র গোলাবারুদ, যন্ত্রপাতি সমস্ত কিছু একের পর এক বিরাট বহর-লাইন দিয়ে হাজার-হাজার গাড়ি দিন-রাত্রি আমাদের চোখের সামনে দিয়ে এদেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। বেসামরিক যানবাহন, মিলকারখানার যন্ত্রাংশও ওদের গ্রাস থেকে রক্ষা পেলনা। পাক সেনা ও বিহারীদের লুটপাট করা সোনাদানা ও মূল্যবান সামগ্রী সব মিত্রবাহিনীর দেশে চলে গেল। এদের হাবভাবে মনে হতে লাগলো এরাও নব্য দখলদার বাহিনী।
একদিন রাজশাহী লক্ষীপুর বাজার এলাকায় ওরা গরুর গোস্ত বিক্রেতার সমস্ত গোস্ত মাটিতে পুতে দিয়ে শাসিয়ে দিয়ে গেল, প্রকাশ্যে এভাবে যেন এ জিনিস আর বিক্রি করা না হয়। রাস্তা পথে বাজার হাটে ওদের চালচলন দখলদার বাহিনীর ঔধ্যত্বপূর্ণ মনে হতো। নিজের কাছেই প্রশ্ন করতাম, আমরা কি এজন্য এত লক্ষ্য লক্ষ্য জীবন বলি দিলাম! খানদের বদলে সিংদের অভ্যার্থনা জানানোর জন্য! আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলো বলেই কি এভাবে উসুল করে নিবে? এই রক্ষা কর্তাদের মনের গোপন ইচ্ছা কি এটাই ছিল! মনে হতো আমরা বুঝি ওদের আশ্রিত রাজ্যে বাস করছি।
আমার দলের সাত্তার সাহেব একদিন তার বাসভবনে এক নৈশ ভোজের দাওয়াত দিলেন; ওই অনুষ্ঠানে দু’জন ভারতীয় সেনা সদস্যও ছিলেন, মূলত ওদের জন্যই এই ব্যবস্থা। সম্ভবতঃ একজন কর্ণেল চ্যাটার্জী অপরজন ক্যাপ্টেন রায়। তারা সেদিন খাওয়া দাওয়ার পর উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন, জীবনে এধরনের ভোজ নাকি কখনও খাননি। সেদিন তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম।
একসময় ক্যাপ্টেন রায় একান্তে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,-মনে কিছু নিবেন না-আপনারা কেন মুক্তি যুদ্ধ করলেন বুঝলাম না ? রাজধানী ঢাকা থেকে এত দূরত্বে রাজশাহীতেই যেখানে এত বড় মেডিকেল কলেজ, যা পশ্চিম বঙ্গ কল্পনাও করতে পারেনা-এত বড় বিশাল একটা ইউনিভার্সিটি ভারতীদের যা চিন্তায় আসেনা- প্রতিটি বাড়ীর ছাদে টিভি এন্টেনা, এতো সস্তা বিদেশী সব ধরনের জিনিসের যা প্রাচুর্য্য। এর পরেও আপনারা যুদ্ধ করলেন! ক্যাপ্টেনের কথার কন উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে আমাদের দেশবাসীর তেমন তো ধারনা ছিলনা- আমরা তো সে সময় আকাশবাণী কলকাতার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর মায়া-ভরা দরদ-মাখা কথায় বিগলিত ছিলাম।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ সব কিছু অগোছালো, প্রশাসনিক অবকাঠামো বিধ্বস্ত। সুযোগ সন্ধানীরা এই সুযোগে লুটপাট, দখলদারী, খুন, ধর্ষণে মত্ত। এতদিন বিহারীরা যে সমস্ত বাড়ি ঘর সহায়সম্পত্তি, ব্যবসা-বানিজ্য দখল করেছিলো এখন সেই উর্দূর জায়গায় বাংলা লিখার উৎসবে ওরা ব্যস্ত। জীবন বাজি রেখে এতদিন যারা এদেশে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে গেলো তারা সবাই নাকি পাক-বাহিনীর দোসর-রাজাকার। যাদের সক্রিয় অবদানে স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হলো, তারাই কিনা আজ দালাল!
এদের কথা বার্তা ব্যবহারে মন্টা মুষড়ে গেল। হতাশায় ভরে গেল সমস্ত স্বপ্ন। প্রতিদিন বিচার প্রার্থি আর অভিযোগকারীদের ভীড়ে অতিষ্ট হয়ে উঠছিলাম। অনেক কষ্টে এরূপ প্রতিকুলতা কাটিয়ে উঠে এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। এ পরিস্থিতিতে এলাকার রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণে রাজী হলাম না। পরে আমার নামে রেশনের দোকান (লাইসেন্স, সে সময় খুব লাভজনক) বরাদ্দ করলেও প্রত্যাখান করলাম। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পর্যন্ত গ্রহণ করলাম না সবার অনুরোধ সত্ত্বেও। ন্য মাস যা কিছু করেছি দেশ মাতৃকার জন্ন-দেশকে ভালবেসে মনের তাগিদে এর জন্য সার্টিফিকেট হ্রহন করে নিজেকে ছোট করতে চাইনি। মন ও বিবেকের কাছে সাড়া মেলেনি।
ভারত থেকে ফিরে আসা দলের ছেলেদের যারা ক্যাম্পের রেশন ও আরাম আয়াশে ভ্রমন করে কাটিয়ে এল এখন তাদের দাপট ক্ষমতা, চেহারার জৌলুস বেড়ে এক একজন মহাপুরুষে পরিণত হতে শুরু করলে ক্রমেই তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলাম।
একদিন আমাদের রিলিফ চেয়ারম্যান জানতে চাইলো, আমি রিলিফের কম্বল বা অন্যকোন কিছু পেয়েছি কিনা?
উত্তরে বললাম, তোমাদের বিতরণ তালিকায় কি আমার নাম আছে? আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওটা দেখলেই তো জানতে পারতে। ও আমার মুখের দিকে চেয়ে কোন জবাব দিতে পারলোনা। ওদের সবার উদ্দেশ্যেই বললাম, শেখ সাহেব কি আর সাধেই বলেছেন-“সাড়ে সাত কোটি লোকের জন্য নয় কোটি কম্বল সাহায্য এলো,-আমার ভাগটা কোই রে চোরারা?”
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×