somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম- হিন্দু মুসলমানের কাছে অপমানিত হয়ে তিনি যা করতেন-

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আইনসভার প্রার্থী হয়েছেন। ভোট চাইছেন মানুষের কাছে। গিয়ে হাজির হলেন এক মৌলভীর বাড়িতে। কবিকে দেখে আঁতকে উঠলেন মৌলভী।
এ কি! আপনি তো কাফের! কাফেরকে তো ভোট দেয়া যায় না! মৌলভীর কথায় সায় দিচ্ছেন তার সাথীরা।

কবি এমন ভয়ানক কথা শুনেও শান্ত। তিনি স্থির গলায় বললেন, মৌলভী সাহেব! কাফির বলেছেন তাতে দুঃখ নেই। এর চেয়েও কঠিন কথা আমি শুনেছি। শুনতে হয়েছে অনেক জঘন্য কথাবার্তাও। তবে আপনার বাড়িতে যখন এসেছি, আপনাকে একটি কবিতা না শুনিয়ে চলে যাই কিভাবে?

কবি নজরুল তার আবৃত্তির ডালা খুলে বসলেন। তিনি শোনাচ্ছেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘মহররম'। কবির ভরাট গলায় সে কি উচ্চারণ! এক অপার্থিব আবেগ ও হৃদয়ছোঁয়া বেদনার পরিবেশ তৈরী হলো সবার মনে। মৌলভী তমিজুদ্দীন এবং তার সাথীদের মাথা নত হয়ে এল। তার অবনত চোখে তাকিয়ে থাকলো কবির দিকে। এই কি নজরুল! কি অপূর্ব তার কবিতা। কত গভীরে এর বেদনা! আহা! এমন করে তো আর কেউ কবিতা শোনাতে পারে না। মৌলভী সাহেব এবং তার সাথীরা অভিভূত। তাদের বিস্ময়ের নীচে চাপা পড়ে গেল সব অভিমান ও সন্দেহ। তার অনুতপ্ত। কবিকে তারা বরণ করলেন পরম আদর যতেœ।


জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বন্ধুদের জন্য পাগলপ্রাণ। এক হিন্দু বন্ধুর আমন্ত্রণে তার বিয়ের আসরে গিয়ে হাজির হলেন কবি। আহারের আয়োজন। কবিও খেতে বসলেন। কন্যাপক্ষের বাড়িতে অনেক বড় আয়োজন।
বরযাত্রীদের সবাই অপেক্ষায়। কিন্তু খাবার আসছে না। খবর এসেছে, বরপক্ষের সাথে একজন মুসলমান এসেছেন কেন? অন্দরমহলের মেয়েরা খাবার পরিবেশনে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। মুসলমানকে বিদায় করতে হবে। হোক তিনি কবি নজরুল। তাতে কি?

নজরুলকে সাথে নিয়ে যাওয়া বন্ধুরা লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। তারা তো কোনদিন নজরুলের ধর্ম দেখে বন্ধু হননি। অভিমানী নজরুল বেশ কষ্ট পেলেন মনে। হিন্দুদের এমন সংকীর্ণ আচরণ আর জাতের কদর্য রূপ দেখে ব্যথিত হলেন তিনি। মনের ক্ষোভ নিয়ে লিখে ফেললেন কবিতা, তারপর সেটি সবাইকে শুনিয়ে দিলেন। কবিতার সূচনা অংশ- জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।’

মুসলমান কবি নজরুলের মুখে এমন অগ্নিজ্বালা প্রতিবাদ শুনে সবার মাথা নীচু হয়ে এল। অভিমানী নজরুল তার কবিতা শুনিয়ে চলে এলেন সেই বিয়েবাড়ী থেকে। মলিনমুখে তিনি পা বাড়ালেন বাসার উদ্দেশে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দাওয়াত করে নোয়াখালী এনেছেন একজন হেডমাস্টার। নজরুলের সভায় মানুষ আসছে দলে দলে। চলে এসেছেন মৌলভী সাহেবরাও। যতদূর চোখ যায়, শুধু সাদা টুপির সারি। মানুষে ভরে গেছে সভাস্থলের চারপাশ।

এ বিরাট জনসমুদ্রে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলেন কয়েকজন মৌলভি। তাদের সম্মিলিত কন্ঠের এক দাবি, এ সভায় নজরুলকে গান করতে দেওয়া হবে না। কোনভাবেই এ সম্ভব না।’ আশেপাশের অনেক মানুষও তাদেরকে সমর্থন জানাচ্ছেন। কয়েকজন প্রভাবশালী লোক মৌলভী সাহেবদেরকে অনুরোধ করলেন, নজরুলকে কয়েকটি গান গাইতে দেয়ার জন্য। তারা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। এলাকাবাসীর উপর মৌলভী সাহেবদের প্রভাব অনেক বেশি। তারাও মৌলভীদের পক্ষে। হেডমাস্টার সাহেব এমন পরিস্থিতিতে কেঁদে ফেললেন সবার সামনে। নিজের এলাকায় নজরুলকে নিয়ে এ অপমান তিনি মেনে নিতে পারছেন না।

কবি নজরুল ইসলাম বসে আছেন মঞ্চে। এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সুগঠিত দেহে বলিষ্ঠ চেহারা, চোখে মুখে তার ঝিলিক। তিনি সবাইকে থামালেন। নিরব হয়ে এল চারপাশ। তিনি তার ভরাট কন্ঠে সবাইকে বললেন, আমার অনুরোধ- একটি মাত্র গান গাইবো আমি। যদি তা ভালো না লাগে, যদি আমার গান আপনাদের মত ও পথের বিপরীত হয়, তবে নিজেকে তুলে দিবো আপনাদের হাতে, যা খুশি আপনারা করবেন তখন। ’
নজরুলের এমন কথায় থেমে গেল সবাই। মৌলভী সাহেবরা রাজি হলেন। একটা গান শোনা যেতে পারে। এর বেশি নয়। তারপর সভা শেষ করে ফেলতে হবে।

কবি তার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে গান ধরলেন। মনের সবটুকু আবেগ ও তেজ ঢেলে দিলেন তার কন্ঠে। তিনি গাইলেন, বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা/শির উঁচু করি মুসলমান....’। উপস্থিত শ্রোতাদের ধ্বনিতে কেঁপে উঠলো সভার আশপাশ। কবির গানের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো আকাশে বাতাসে, ঢেউ উঠলো জনসমুদ্রে। গানটির শব্দ ও কথার যাদুতে বিমুগ্ধ মৌলভী সাহেবরাও উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাদের গলা থেকে ভেসে আসছে- মারহাবা! মারহাবা!! আরে, এতো গান নয়। গজল। গজল। এ গজলের সুর মানুষের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, এ গজল নাজায়েজ হয় কিভাবে? আমরা যে আরও শুনতে চাই। কবি সাব! আরও একখানা গাইতে হবে।
কবি নজরুল তো এরই অপেক্ষায় ছিলেন। জনতার চেহারা এবং আপত্তিকারীদের মনমর্জি তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন। তিনি বললেন, আর না। আমি ক্লান্ত। বিশ্রাম নিতে হবে।

বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ভেসে আসছে আওয়াজ। অধৈর্য মৌলভী সাহেবদেরও নাছোড় দাবী- আর অন্তত একটি হলেও শোনাতে হবে। মরুভূমির পিপাসা তাদের বুকজুড়ে। মানুষের এ আবেগ আর মৌলভীদের এমন বিগলিত দাবীর কাছে হার মানলেন নজরুল।
তিনি বললেন, তবে তাই হবে। তারপর শুরু হল তার গান। সুরের তরঙ্গদোলায় ভাসছে শ্রোতারা। মাথা নেড়ে নেড়ে দুলছেন মৌলভী সাহেবরা। কবির শব্দঝংকারে উন্মাতাল হয়ে উঠলো পরিবেশ। নোয়াখালীর মানুষদের ভাবসাগরে জোয়ারের পর জোয়ার উঠেছে। গলা ছেড়ে কবি গাইছেন তার সব আবেগমাখা গান-গজল। একাধারে পাঁচ ঘন্টা কবি নজরুল গেয়ে শোনালেন তার অমর গানগুলো। হৃদয়ছোঁয়া তার সেইসব ছন্দ মোহিত করে ফেলেছে সবাইকে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত কবি যখন চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, বিমুগ্ধ শ্রোতারা সবাই মিলে দাঁড়িয়ে গেলেন কবির সম্মানে। কবি হেঁটে চললেন তার জন্য নির্ধারিত বিশ্রামখানায়। অনেক হয়েছে। আজ আর নয়।

অনেক অনেক দিন পর আবার জাতীয় কবিকে নিয়ে কিছু লিখলাম। কবির অজানা জীবন নিয়ে আমার আগের ১৩ পর্বের ঘটনাগুলো এবং এই ঘটনাগুলো একই সূত্র থেকে নেয়া। যাদের প্রয়োজন তারা সেসব পর্বে উল্লেখিত সূত্র থেকে দেখে নিতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৩:৫০
২৫টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×