somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এবং তার গজলশিল্পীরা

১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গ্রামোফোন কোম্পানীতে কাজী নজরুল তখন খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন। চারিদিকে তখন শিল্পীদের ভীড়। তিনি লিখে চলেছেন অবিরাম, সুর করে শিখিয়ে দিচ্ছেন বিরামহীনভাবে। রিহার্সাল ঘরে তুমুল হৈ হুল্লোড়ে বসে কবি সবার সাথে মিসে যেতেন আনন্দে। হঠাৎ দেখা যেত, কবি চুপ হয়ে আছেন। যেন ভাবান্তর ঘটেছে তার মনে। আনন্দে ব্যস্ত রুমভর্তি মানুষদের কেউ তার এ আচমকা নীরবতা টের পেলনা। এত গোলমাল আর হট্টগোলের মধ্যে তিনি মুখভর্তি পান চিবোতে চিবোতে আধ ঘন্টার কম সময়ে লিখে ফেলতেন দশ বারোটি গান। তারপর হাতে হাতে তা বিলি করে দিতেন। যেন মাথায় তৈরী করা ছিল, শুধু কাগজে তুলে দিলেন।

একদিন এলেন শিল্পী আব্বাস উদ্দীন। এসে কবিকে বললেন, এই যে কাজীদা, দেখুন, পাশের রুমে পিয়ারু কাওয়াল উর্দু কাওয়ালী গানের রিহার্সাল দিচ্ছে। বাজারে সেসব গান খুব চলছে। আপনি বাংলায় এমন কিছু ইসলামী গান লিখে দেন না কেন?’ কবি নজরুল তাকে বললেন, তুমি কোম্পানীর কর্তার অনুমতি নাও। আমি লিখে দিব।’ শিল্পী আব্বাসউদ্দীন গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্তাকে এ প্রস্তাব দেওয়া মাত্র তিনি রেগে গেলেন। বলে উঠলেন, না না, ওসব চলবে না বাজারে।’

এভাবে চলে গেল প্রায় এক বছর। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। তারপর একসময় কী ভেবে কর্তা ভগবতী বাবু রাজী হলেন। আব্বাসউদ্দীন ছুটে গিয়ে কবিকে বললেন, কাজীদা, কর্তা রাজী হয়েছেন।

এ খবর শুনে নজরুল তখনই একটি আলাদা রুমে গিয়ে ঢুকলেন। আব্বাসকে বললেন, এক ঠোঙ্গা পান আর চা আনো। অফিসের কর্মচারী দশরথ পান আর চা নিয়ে এলেন। কবি নজরুল তখন বললেন, দরজাটা বন্ধ করে এবার চুপচাপ বসে থাক।

পনেরো থেকে বিশ মিনিট। কবি মাথা নীচু করে লিখে চলেছেন। লেখা শেষ হল। এবার তিনি মাথা তুলে আব্বাসউদ্দীনকে ডাকলেন, এই যে এসো, নাও, ধরো, সুর শিখে নাও। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন অবাক। এই ক মিনিটে তার কাজীদা লিখে ফেলেছেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো...।’ শুধু লিখেই নয়, সুরও ধরিয়ে দিলেন সাথে সাথে। আর বললেন, কাল এসো আবার। রেকর্ডের অপর পৃষ্ঠার জন্য আরেকটি গজল লিখে দিব। কবি নজরুল ইসলামের চোখে মুখে এক অন্যরকম আনন্দ খেলা করছে।
পরদিন তিনি এলেন এবং কবি তার জন্য লিখে দিলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর ’। চারদিন পর গজল দুটো রেকর্ড হল এবং বাজার মাত হয়ে গেল। এভাবে শুরু হল তার গজল লেখা। কোম্পানীও দেদারসে মুনাফা করল এসব বিক্রি করে। মুসলমানদের ঘরে ঘরে এসব গজল বাজতে থাকল। এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এল বাংলার মুসলমানদের মনে মনে।

অবাক হওয়ার মত তথ্য হল, ইসলামী গান-গজলের ব্যাপক চাহিদা এবং জনপ্রিয়তায় গ্রামোফোন কোম্পানী বিস্মিত এবং মুগ্ধ। বাজারের চাহিদা সামাল দিতে তখন কয়েকজন হিন্দু শিল্পীও মুসলমানী নাম ধারণ করে গজল গাইতে শুরু করলেন। ধীরেন দাস গাইলেন গনি মিঞা নামে, চিত্তরায়ের নাম হল দেলোয়ার হোসেন, আশ্চর্যময়ীর নাম সকিনা বেগম, আরেক নারী শিল্পী হরিমতির নাম রাখা হল আমেনা বেগম, গিরিশ চক্রবর্তী হয়ে গেলেন সোনা মিঞা। এভাবেই কাজী নজরুল ইসলামের হাতে সূচনা হল বাংলা ভাষায় ইসলামী গজলের স্বর্ণযুগের।

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গজলের সংখ্যা শতাধিক। তিনি আল্লাহ পাকের প্রশংসায় হামদ লিখেছেন। প্রিয়তম নবীকে নিয়ে নাত লিখেছেন। মহানবী সা. এর জীবন ও তার রূপ সৌন্দর্য বোঝাতে গিয়ে তিনি যে উপমা ও বর্ণনার ভাবভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তার সুরের ঔদার্য ও শব্দের অলংকারে যে ব্যাকুলতা ছড়িয়ে দিয়েছেন, এর উপমা আজো বিরল।

তিনি ঘুমন্ত মুসলিম জাতির মোহনিদ্রা ভাঙানো এবং পারস্পরিক হানাহানি বন্ধের জন্য রাসূলের জীবন ও আদর্শ নিয়ে যেসব লিখেছেন, তার প্রতিটি শব্দে তার মায়া ও হৃদয়ের উত্তাপ অনুভূত হয়। এর সামান্য কয়েকটি নমুনা-
নবীর জন্ম নিয়ে তিনি আনন্দের সুরে লিখেছেন- ‘‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়’’, ‘‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’’, ‘‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’’, মরু সাহারা আজি মাতোয়ারা’’। আরও লিখেছেন, আমিনার কোলে নাচে হেলে দুলে, শিশুনবী আহমদ রূপের লহর তুলে।’ চাঁদের সৌন্দর্যকে তুচ্ছ করে তিনি গেয়ে চলেছেন, ওরে- ও চাঁদ উদয় হলি কোন জোছনা দিতে, দেয়- অনেক বেশি আলো আমার নবীর পেশানিতে।’ আবার সেই প্রিয়তম নবীর ইন্তেকালে তিনি বেদনার সুরে কেঁদেছেন- অসীম বেদনায় কাঁপে মদিনাবাসী, নিভিয়া গেল চাঁদের মুখের হাসি।’ অন্যত্র লিখেছেন, বহে শোকের পাথর আজি সাহারায়, ‘নবীজী নাই’- উঠলো মাতম মদিনায়’’, ‘‘কেন তুমি কাঁদাও মোরে, হে মদিনাওয়ালা’’।

গান গজলের জন্য শুধু গলার সুমিষ্ট সুর যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত ভালোবাসা ও বোধ। তখনই কেবল তা শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। জাতীয় কবির লেখা গজলগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তার ব্যবহৃত উপমা ও ফার্সী-আরবী শব্দের কৌশলী সংমিশ্রণ তাতে মোহময় আবহ তৈরী করে রেখেছে।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×