গ্রামোফোন কোম্পানীতে কাজী নজরুল তখন খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন। চারিদিকে তখন শিল্পীদের ভীড়। তিনি লিখে চলেছেন অবিরাম, সুর করে শিখিয়ে দিচ্ছেন বিরামহীনভাবে। রিহার্সাল ঘরে তুমুল হৈ হুল্লোড়ে বসে কবি সবার সাথে মিসে যেতেন আনন্দে। হঠাৎ দেখা যেত, কবি চুপ হয়ে আছেন। যেন ভাবান্তর ঘটেছে তার মনে। আনন্দে ব্যস্ত রুমভর্তি মানুষদের কেউ তার এ আচমকা নীরবতা টের পেলনা। এত গোলমাল আর হট্টগোলের মধ্যে তিনি মুখভর্তি পান চিবোতে চিবোতে আধ ঘন্টার কম সময়ে লিখে ফেলতেন দশ বারোটি গান। তারপর হাতে হাতে তা বিলি করে দিতেন। যেন মাথায় তৈরী করা ছিল, শুধু কাগজে তুলে দিলেন।
একদিন এলেন শিল্পী আব্বাস উদ্দীন। এসে কবিকে বললেন, এই যে কাজীদা, দেখুন, পাশের রুমে পিয়ারু কাওয়াল উর্দু কাওয়ালী গানের রিহার্সাল দিচ্ছে। বাজারে সেসব গান খুব চলছে। আপনি বাংলায় এমন কিছু ইসলামী গান লিখে দেন না কেন?’ কবি নজরুল তাকে বললেন, তুমি কোম্পানীর কর্তার অনুমতি নাও। আমি লিখে দিব।’ শিল্পী আব্বাসউদ্দীন গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্তাকে এ প্রস্তাব দেওয়া মাত্র তিনি রেগে গেলেন। বলে উঠলেন, না না, ওসব চলবে না বাজারে।’
এভাবে চলে গেল প্রায় এক বছর। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। তারপর একসময় কী ভেবে কর্তা ভগবতী বাবু রাজী হলেন। আব্বাসউদ্দীন ছুটে গিয়ে কবিকে বললেন, কাজীদা, কর্তা রাজী হয়েছেন।
এ খবর শুনে নজরুল তখনই একটি আলাদা রুমে গিয়ে ঢুকলেন। আব্বাসকে বললেন, এক ঠোঙ্গা পান আর চা আনো। অফিসের কর্মচারী দশরথ পান আর চা নিয়ে এলেন। কবি নজরুল তখন বললেন, দরজাটা বন্ধ করে এবার চুপচাপ বসে থাক।
পনেরো থেকে বিশ মিনিট। কবি মাথা নীচু করে লিখে চলেছেন। লেখা শেষ হল। এবার তিনি মাথা তুলে আব্বাসউদ্দীনকে ডাকলেন, এই যে এসো, নাও, ধরো, সুর শিখে নাও। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন অবাক। এই ক মিনিটে তার কাজীদা লিখে ফেলেছেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো...।’ শুধু লিখেই নয়, সুরও ধরিয়ে দিলেন সাথে সাথে। আর বললেন, কাল এসো আবার। রেকর্ডের অপর পৃষ্ঠার জন্য আরেকটি গজল লিখে দিব। কবি নজরুল ইসলামের চোখে মুখে এক অন্যরকম আনন্দ খেলা করছে।
পরদিন তিনি এলেন এবং কবি তার জন্য লিখে দিলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর ’। চারদিন পর গজল দুটো রেকর্ড হল এবং বাজার মাত হয়ে গেল। এভাবে শুরু হল তার গজল লেখা। কোম্পানীও দেদারসে মুনাফা করল এসব বিক্রি করে। মুসলমানদের ঘরে ঘরে এসব গজল বাজতে থাকল। এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এল বাংলার মুসলমানদের মনে মনে।
অবাক হওয়ার মত তথ্য হল, ইসলামী গান-গজলের ব্যাপক চাহিদা এবং জনপ্রিয়তায় গ্রামোফোন কোম্পানী বিস্মিত এবং মুগ্ধ। বাজারের চাহিদা সামাল দিতে তখন কয়েকজন হিন্দু শিল্পীও মুসলমানী নাম ধারণ করে গজল গাইতে শুরু করলেন। ধীরেন দাস গাইলেন গনি মিঞা নামে, চিত্তরায়ের নাম হল দেলোয়ার হোসেন, আশ্চর্যময়ীর নাম সকিনা বেগম, আরেক নারী শিল্পী হরিমতির নাম রাখা হল আমেনা বেগম, গিরিশ চক্রবর্তী হয়ে গেলেন সোনা মিঞা। এভাবেই কাজী নজরুল ইসলামের হাতে সূচনা হল বাংলা ভাষায় ইসলামী গজলের স্বর্ণযুগের।
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গজলের সংখ্যা শতাধিক। তিনি আল্লাহ পাকের প্রশংসায় হামদ লিখেছেন। প্রিয়তম নবীকে নিয়ে নাত লিখেছেন। মহানবী সা. এর জীবন ও তার রূপ সৌন্দর্য বোঝাতে গিয়ে তিনি যে উপমা ও বর্ণনার ভাবভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তার সুরের ঔদার্য ও শব্দের অলংকারে যে ব্যাকুলতা ছড়িয়ে দিয়েছেন, এর উপমা আজো বিরল।
তিনি ঘুমন্ত মুসলিম জাতির মোহনিদ্রা ভাঙানো এবং পারস্পরিক হানাহানি বন্ধের জন্য রাসূলের জীবন ও আদর্শ নিয়ে যেসব লিখেছেন, তার প্রতিটি শব্দে তার মায়া ও হৃদয়ের উত্তাপ অনুভূত হয়। এর সামান্য কয়েকটি নমুনা-
নবীর জন্ম নিয়ে তিনি আনন্দের সুরে লিখেছেন- ‘‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়’’, ‘‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’’, ‘‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’’, মরু সাহারা আজি মাতোয়ারা’’। আরও লিখেছেন, আমিনার কোলে নাচে হেলে দুলে, শিশুনবী আহমদ রূপের লহর তুলে।’ চাঁদের সৌন্দর্যকে তুচ্ছ করে তিনি গেয়ে চলেছেন, ওরে- ও চাঁদ উদয় হলি কোন জোছনা দিতে, দেয়- অনেক বেশি আলো আমার নবীর পেশানিতে।’ আবার সেই প্রিয়তম নবীর ইন্তেকালে তিনি বেদনার সুরে কেঁদেছেন- অসীম বেদনায় কাঁপে মদিনাবাসী, নিভিয়া গেল চাঁদের মুখের হাসি।’ অন্যত্র লিখেছেন, বহে শোকের পাথর আজি সাহারায়, ‘নবীজী নাই’- উঠলো মাতম মদিনায়’’, ‘‘কেন তুমি কাঁদাও মোরে, হে মদিনাওয়ালা’’।
গান গজলের জন্য শুধু গলার সুমিষ্ট সুর যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত ভালোবাসা ও বোধ। তখনই কেবল তা শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। জাতীয় কবির লেখা গজলগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তার ব্যবহৃত উপমা ও ফার্সী-আরবী শব্দের কৌশলী সংমিশ্রণ তাতে মোহময় আবহ তৈরী করে রেখেছে।