" আমার তখন দশ কি এগার বছর হবে। বড় ভাই সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যা বেলায় কোথায় যেন বেরিয়ে যায়। পরে মা'র নিকট থেকে জানতে পারি গ্রামের হাটে কার যেন রেডিও আছে সেই রেডিও'র খবর শুনতে যায়। আমার যত টুকু মনে আছে তাতে বুঝতাম দেশের অবস্থা মোটেই ভালছিল না । বড় ভাই একদিন খবর দিল গ্রামে মিলিটারী ঢুকবে। আকাশে সাই সাই করে ঘন ঘন বিমান চলতেছে। চারদিক কাপিয়ে বিমান গুলো পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছে।মিলিটারী ঢোকার খবর শুনে গ্রামের হিন্দু পাড়ার মহিলারা গ্রাম ছেড়ে দল বেধে চলে যাচ্ছিল । তখন পথে প্রতি রাতে লূটতরাজ হতো।তাই হিন্দু পাড়ার মহিলারা তাদের সোনার গহনা বিশ্বস্ত মুসলিম মেয়েদের কাছে রেখে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কেউ কেউ ভারতে চলে গিয়েছিল । আর কখনও ফিরে আসে নি।যারা পাশের গ্রামে লুকিয়েছিল তারা পরে এসেছিল। পশ্চিম পাড়ার শেখ বংশের ছোট দুই ভাই একসাথে মিলিটারী দের গ্রামে ঢুকাতে সাহায্য করছে। মিলিটারীদের না জানি কেমন দেখা যায়। তাই দেখার খুব আগ্রহ নিয়ে বাড়ির সামনে বাটুল তলায় দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সাথে তোমার সাথি খালা, মিনার মা অনেকে ছিল। নদীতে দূরে একটা নৌকা দেখা গেল। বোঝাই যাচ্ছিল এটা শেখ বংশের কারোর নৌকা হবে। শেখদের নৌকা গুলো বড় এবং সাজানো, নৌকা শেখ বংশের দুই জন চালিয়ে নিয়ে আসলো ।
ছোট চাচা সবাইকে ধমক দিয়ে বাড়ির ভিতরে যেতে বলল। কেমন জানি চারদিক গুমোট এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। আমাদের পূরাতন বাড়ি ছিল তখন গ্রামের মুখে। কোন বাড়িতে ঢুকলে প্রথমে আমাদের বাড়িতেই ঢুকবে। যখন গ্রামে মিলিটারী ঢুকলো বড় ভাই তখন আমাদের বাড়ির পিছনে লুকিয়ে থাকতে বলল। বাড়ির পিছনে যাওয়ার রাস্তা পাট কাঠির বেরা দিয়ে এমন ভাবে বড় ভাই বন্দ করল যেন বোঝা না যায় ওখানে বাড়ির পিছনে যাওয়ার কোন রাস্তা আছে, মা'র যত চিন্তা ছিল আমার যুবতি বড় বুবুকে নিয়ে। বড় ভাই দুই জন আর ভাবী বাড়ির ভিতরেই ছিল। আমি তখন ছোট ছিলাম বিধায় এত কিছু বুঝতাম না। । আমি, মা, বড় বুবু, নরনী খালা, এবং চাচাতো বোন দুই জন বাড়ির পিছনে ছিলাম। তখন আমাদের বাড়ির পিছনে একটা খাল ছিল। খালের ভিতরের ছোট নৌকা দিয়ে মা'কে না জানিয়ে পিছন থেকে কেটে পরেছিলাম। মা পরে ডেকেছিল কিন্তু আমি যাই নি। আমি দেখলাম মিলিটারী মোট আট জন । সবার হাতে বন্দুক। আমি যদিও আড়াল থেকে দেখছিলাম তবুও ভয় হচ্ছিল। বড় গোঁফওলা একজন সামনে ছিল । বাটুল তলায় দাঁড়িয়ে মাটিতে পরে থাকা একটা বাটুল তুলে শেখদের কি যেন জিজ্ঞাস করল। পরে আমাদের বাড়িতে ঢুকলো। আমি খড়ের পালার আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। ঘাটে নৌকা বাধা রয়েছে। সে দিকে তাকাতেই দেখলাম দুই জন মেয়ে আর একজন ছেলে নৌকাতে হাত বাধা রয়েছে। আসার সময় হিন্দু পাল পাড়ার কোন মেয়েকে তুলে নিয়ে আসছে ওরা। দুই জন পাকিস্তানি বন্দুক তাক করে রয়েছে বন্দিদের দিকে। প্রতিদিন দুপুর বেলা প্রচুর লোক জন থাকে ঘাটে কিন্তু ঐদিন একজনও ছিল না। আমার ভাতিজা আনোয়ার তখন ভাবির কোলে । মিলিটারী আনোয়ারকে ভাবির কোল থকে কেড়ে নিয়েছিল। পরে কি যেন মনে করে আবার দিয়ে দিয়েছিল। আমাদের বাড়ির উঠানে শেখ বংশের দুই ভাই দাঁড়িয়ে মেঝো ভাই কে আশ্বস্ত করছিল যে কিছুই হবে না। কিন্তু বাড়ি ভিতর থেকে একজন ট্রাংক বের করে আনলো। এই ট্রাংকে বড় বুবুর এবং ভাবির সোনার গহনা ছিল।
ভাবি দেখতে পেল একজন পাকি ট্রাঙ্কের তালা ভেংঙ্গে গহনা গুলো পকেটে চোরের মত ঢুকিয়ে ফেলল। আমি তখন বাড়ির খড়ের পালার আড়ালে লুকিয়ে সব দেখছিলাম এবং শুনছিলাম। ভাবি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের কাছে বিষয়টা বলল। ভাই ওদের বড় গোফওলাকে বলল , গোফওলা তখন উঠানের মাঝে চেয়ার পেতে বসেছিল, বাকিরা বাড়ি ঘরের ভিতর দেখছিল কোন অস্ত্র, গোলাবারুদ আছে কি না। গোফওলা ছিল ওদের বস। উনি অনেক ক্ষন পরে পুরো বাড়ি খোজা শেষে সোনার গহনা ফেরত দেওয়ার আদেশ দিলেন।পাকি চোর গহনা ফেলে দিয়ে গেল।
শেখদের সাথে পূর্ব পাড়ার মন্ডলদের আগে থেকেই গোন্ড গোল ছিল। এই সুযোগে শেখরা মন্ডল বাড়ির মাস্টারকে মিলিটারীর হাতে তুলে দেয়। পরে বড় ভাই বলেছিল- একদিন রাতে মন্ডল বাড়ীর মাস্টারের ছেলে গোপনে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। মুক্তিফৌজ নামে কোন দল ভারতে ট্রেনিং নিয়ে পাকিস্তানের সাথে লড়বে, মাস্টারের ছেলে সেই মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছিল।
এর পর থেকে দু , তিন দিন পর পর পাকিরা আসতো। গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় কয়েকটা বাড়ি ওরা পুড়িয়ে দেয় কারন ঐ বাড়ির যুবক
ছেলেরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। দেশের এই অবস্থায় আমাদের গ্রামে এবং পাশের গ্রামে ডাকাতি হতে থাকে। মানুষ খাদ্যের অভাবে একজন আর একজনের বাড়ী থেকে গবাদি পশুসহ, ঘরের শস্যও চুরি করতে থাকে । সেবার আমাদের বাড়ীতেও ডাকাতি হয়, আমাদের দুই টা মহিষ , বড় বুবুর গহনা ডাকাতি করে নিয়ে যায়।
গ্রামে হাকিম মন্ডলের ভাই যুদ্ধে যোগ দেওয়ায় একদিন মিলিটারি হাকিম মন্ডলের যুবতি বোনকে ধরে নিয়ে যায়। হাকিম মন্ডল বাধা দেওয়ায় তাকেও ধরে নিয়ে যায়। পরে হাকিম মন্ডলের উপর নির্যাতন করে , তিন দিন পর ছেড়ে দেয়।কিন্তু তার বোনকে আর ফেরত পায় নি। যেসব মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত তারা কেউ ফিরে আসতো না । আমাদের নদীতে প্রাই লাশ ভেসে আসতো। ভাইরা পচা লাশ তুলে নদীর ধারেই মাটি চাপা দিতো। পরে নদী ভেংগে যাওয়ায় লাশের কঙ্কাল গুলো আর নেই।
গ্রামের সব খবর পাকিদের কাছে ঐ শেখ বংশের দুই রাজাকার এবং তাদের সহযোগীরা দিতো।কে যুদ্ধে গেল, কার ঘরে অস্ত্র আছে, কার ঘরে মুক্তিবাহিনী থাকে , কার ঘরে যুবতি মেয়ে আছে- সব খবর ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার মাসে পাকিস্তানিরা আমাদের থানার গুদাম ঘর গুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এক সপ্তাহ ধরে ঐ আগুন ধাও ধাও করে জ্বলছে। এই সুযোগে যে যা পারছে, আগুন নিভিয়ে গুদাম থেকে মালামাল সরিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামের লোকজন শেখ বংশের ছোট রাজাকারকে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছিল। কয়েকজন ডাকাত কেউ মেরে ফেলে লোকজন বড় শেখ রাজাকার কোন রকম পালিয়ে যায়। শেখ বংশের অন্য লোকজন একদিন কূমর বাড়ীর বড় বড় মাটির পাতিল নৌকায় সাজিয়ে রাতের বেলায় পাতিলের ভিতর শেখ বংশের বড় রাজাকারকে লুকিয়ে রেখে দূরে নিয়ে যায়। পরে লোকমুখে শুনে ছিলাম ভারতে পাচার করে দিয়েছে তাকে।''
আজও মা'র মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনি। দেশে থাকতে চাঁদনী রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে যুদ্ধের ইতিহাস শুনতে ভাল লাগতো। বিদেশে থাকি বলে মাঝে মাঝে মাকে অনুরোধ করি যুদ্ধের ইতিহাস বলতে । হায়েনাদের খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, লূটতরাজের ঘটনা শুনতে আমার কোন দলিল লাগে না , কোন বই লাগে না, কোন সাক্ষী লাগে না।আমার মা'ই যথেষ্ট ।
লেখার মত অনেক কিছু আছে কিন্তু লিখতে পারছি না শুধু সময়ের অভাবে। চাকুরীর ব্যস্ততার মাঝে ব্লগে আসার এবং রেগুলার লেখার সময় হয়ে উঠে না। তাই আশা রাখি বন্ধুরা দূরে সরে যাবেন না ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৮