বৃষ্টিস্নাত এই সন্ধ্যায় ব্লগে যদি একবার লগইন না করি তাহলে তা যেন এক অপরাধের পর্যায়েই পরবে, যেহেতু দীর্ঘদিন পর এই স্বস্তির বৃষ্টির কারণে আমার আজ সারাদিন মাটি হয়েছে তাই ভাবলাম ব্লগে এসে তার ষোলকলা পূর্ণ করি; সেই সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তবে আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় বরং আজ কথা বলবো সেই বহুল চর্বিত দুর্নীতি বিষয়ে। দুর্নীতি নিয়ে আসলে নতুন করে কিছু বলার নেই, এ বিষয়ে সমস্ত আলোচনা ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে যদিও দুর্নীতি বহাল তবিয়তেই চলমান রয়েছে, তাই দুর্নীতি বিষয়ে বেশি কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না, তবুও কিছু কথা না বললেই নয়।
-ভাবনার সূত্রপাত বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি বিষয়ক এই লেখাটি থেকে "গুলশানে এক দিনে চার ফ্ল্যাট কিনেছিল বেনজীর পরিবার" যেখানে তার যাবতীয় সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে,মিঃ বেনজীর আহমেদের সম্পদের পরিমাণ এতটাই বেশি যে আপনি হয়তো তা পড়তে পড়তে ক্লান্ত বোধ করবেন।
বেনজীর আহমেদ ১৫ এপ্রিল ২০২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ এই দুই বছর বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এর আগে ২০১৫ থেকে ২০২০ মোট পাঁচ বছর র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২+৫ এই ৭ বছর তিনি তার চাকরি জীবনের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পদ অর্জনে মত্ত ছিলেন। অবস্থা দৃষ্টে আজ ইহা পরিষ্কার যে এই ৭ বছর তিনি সম্পদ অর্জনের এক ম্যারাথন দৌড়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন, উনার সম্পদের পাহাড় দেখে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সম্পদ অর্জনের এই ম্যারাথন দৌড়ের মাঝে তিনি দায়িত্ব পালন করার মত আদৌ কোন ফুরসৎ পেয়েছিলেন কি না বা দায়িত্ব পালন করলেও আসলে কতটুকু করতে পেরেছেন?
এই দেশের প্রতিটি সেক্টরই দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ হলেও পুলিশ প্রশাসনকে দুর্নীতির আঁতুর ঘর হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, এর প্রতিটি পদেই রয়েছে দুর্নীতি করার সীমাহীন সুযোগ; যত বড় পদ, যত বড় কর্মকর্তা তত বেশি দুর্নীতি, ইহা একটি ওপেন সিক্রেট যা একটি বাচ্চা ছেলেও জানে। এখন কথা হচ্ছে-পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এই দেশে কি তাহলে বেনজীর আহমেদ একই ছিলেন? উনার আগেও তো এই দেশে পুলিশের অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ নিষ্ঠার সহিত দায়িত্ব পালন করিয়া জনগণের সেবা করিয়া গিয়াছেন উনাদের আমল নামার খবর কি? শুধু এক বেনজীর আহমেদকে নিয়ে এত হইচই কেন? প্রিয় পাঠক বৃন্দ, আমি মোটেও বেনজীর আহমেদকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছি না, আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে: বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ হয়েছে তার মানে এই নয় যে যারা পূর্বে পুলিশের উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন বা এখনও আছেন তারা কেউ দুর্নীতিবাজ নয়, নিশ্চিতভাবেই প্রশাসনের প্রতিটি কর্মকর্তাই দুর্নীতিগ্রস্ত, পার্থক্য হচ্ছে বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু অন্যান্যদের তথ্য প্রকাশ করা হয় নি।
এখন দেখি কেন বেনজীর আহমেদের এই হাল হলো: বিষয়টি নিয়ে আমার যথেষ্ট গবেষণা না থাকলেও ধারণা করতে মোটেও বেগ পেতে হয় না যে- খুব সম্ভবত তিনি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সম্পদ অর্জনের মোহে এতটাই মোহগ্রস্ত ছিলেন তা অর্জন করতে গিয়ে তিনি নিজের শক্ত কিছু প্রতিপক্ষ দাঁড় করে ফেলেছিলেন, যারা বেনজীরের চাইতেও শক্তিশালী, অথবা তিনি বড় বড় দেবতাদের তুষ্ট করতে পারেননি বা কোন কারণে দেবতাদের দেবতা তার উপর রুষ্ট হয়েছেন যা হয়তো কখনোই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হবে না। ক্ষমতায় (ডিজি, আইজিপি) থাকা কালিন সময়ে তিনি হয়তো ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন, এমনও হতে পারে তিনি পরিস্থিতির শিকার বা রাজনৈতিক বলির পাঠা, তা না হলে একজন মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার প্রায় মাসখানের মধ্যেই কিভাবে তার সমস্ত সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ আসে? বাংলাদেশের আইন, আদালত কি তাহলে এতটাই ফ্লেক্সিবল হয়ে গেলো যে অভিযোগ উঠার প্রায় সাথে সাথেই সবকিছু হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে যায়!!
বিবিধ বিষয় বিবেচনায় এটা বলা যেতেই পারে বেনজীর আহমেদ এক বা একাধিক প্রবল প্রতাপশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন যাকে বা যাদেরকে তিনি ঠিকমত ম্যানেজ করতে পারেননি, বাংলাদেশ হচ্ছে ম্যানেজের দেশ, এখানে ঠিকমত সবকিছু ম্যানেজ করতে পারলে একজন দুর্নীতিবাজ হয়ে যায় ফেরেশতা আর একজন ভাল মানুষ হয়ে যায় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ...ইত্যাদি। সব সব সম্ভবের এই দেশে সবকিছুই ম্যানেজ করে নিজের আয়ত্তে রাখা যায় আর ম্যানেজ না করতে পারলে পাশা উল্টে যায়, বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রে পাশা উল্টে গিয়েছে বা তিনি দেবতাদের সঠিক ফুলটি দিতে পারেননি যে কারণে দেবতাগণ তার উপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন।
বেনজীর আহমেদের পূর্বের কর্মকর্তাগণ কেন আজ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছেন বা তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠছে না? কারণ তারা সবকিছু ম্যানেজ করতে পেরেছেন। বেনজীর আহমেদ তো দূরের কথা, অজ পাড়াগাঁয়ের একজন থানার ওসিও কি তার সম্পদের সঠিক হিসেবে দিতে পারবেন? একজন ওসি যে বেতন পান তা দিয়ে তার ছেলে মেয়ের হাত খরচের টাকাও জুটবে না, কিন্তু হায়! স্বল্প বেতনের এসব কর্মকর্তাগণ আজ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও নিশ্চিন্তেই জীবন যাপন করছে কিন্তু মাঝ খান থেকে ফেঁসে গেলেন বেনজীর আহমেদ, বেচারা বেনজীর !
অনেকেই ধারণা করে থাকেন বসুন্ধরা গ্রুপ বেনজীর আহমেদের পিছনে লেগেছে, ধারণাটি যে একেবারে অমূল তা বলার উপায় নেই কারণ, বেনজীরের দুর্নীতির খবর প্রথম কালের কন্ঠেই প্রকাশ হয়। তাছাড়া বেনজীর যখন পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন তখন গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে সোবহান আনভীরের গার্লফ্রেন্ড মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ, বিস্তারিত: এই আত্মহত্যার (নাকি হত্যা?) বিষয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধারের ছেলে সোবহান আনভীরের পিছনে লেগেছিলো প্রশাসন এবং মিডিয়ার কিছু লোক, সে সময়ে বসুন্ধরা গ্রুপ বেশ চাপে পরে গিয়েছিলো, যে কোন মুহূর্তে আনভীর গ্রেফতার হয়ে যায় এমন একটা অবস্থা কিন্তু শেষ পর্যন্ত বসুন্ধরা সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেছিলো, উক্ত মেয়ের আত্মহত্যা বিষয়ে এখন আর কেউ কথা বলে না প্রশাসন, মিডিয়া সবাই এখন একদম চুপ, এ বিষয়টি নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের সাথে বেনজীর আহমেদের কোন দ্বন্দ্ব থাকলে থাকতেও পারে। বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয় এটি নিয়ে খুব বেশি কথা বলা ঠিক হবে না। ঘটনা যা-ই হোক বেনজীর আহমেদ ফেঁসে গিয়েছেন এটাই হচ্ছে আসল কথা আর তার প্রতিপক্ষও অনেক শক্তিশালী এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
আবার বিষয়টা যদি অন্যভাবে দেখি- ধরি বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন, তাহলে এখানে শুধু এক বেনজীর আহমেদ কেন? দেশে কি তাহলে শুধু একজন বেনজীর আহমেদই আছে? আরও হাজারো বেনজীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশের আনাচে কানাচে তাদেরকে পাকড়াও করা হচ্ছে না কেন? আর চাইলেই কি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে পারে? This is quite impossible সরকার চাইলেও সবকিছু করতে পারে না, সরকারকেও কারো কারো উপর নির্ভর করতে হয়, সরকারও একক ক্ষমতার অধিকারী বা স্বয়ং সস্পূর্ণ নয়। বিশ্বায়নের এই যুগে একক ক্ষমতা বলতে কিছু নেই সবাই করো না কারো উপর নির্ভরশীল।
সে যা-ই হোক দুর্নীতিকে আমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করি না বরং দুর্নীতিকে আমাদের একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখি, দুর্নীতি নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না শুধু এতটুকু বলতে চাই- ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই দেশের প্রতিটি ব্যক্তিই দুর্নীতি পরায়ণ, দুর্নীতিকে অঘোষিত একটি যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয় আমাদের সমাজে, দুর্নীতি করার সুযোগ থাকা সত্যেও যদি কেউ দুর্নীতি না করে তাহলে তাকে- বোকা, প্রতিবন্ধী, জীবনে কিছু করতে পারবে না, ইত্যাদি বলে ভর্ৎসনা করা হয়, অপরদিকে যে ব্যক্তি দুর্নীতিতে পারঙ্গম তার পিঠ চাপড়ে দেয়া হয় যাতে সে বিপুল উৎসাহে দুর্নীতি করিয়া বেড়ায়। যারা এই কাজ করে তারা কেউই রাজনীতিবিদ নয় তারা আমার আপনার আশেপাশেরই সাধারণ ছাপোষা জনগণ। এই দেশে জন্ম থেকেই একটি শিশু বড় হয় দুর্নীতি বিষয়ে বীরত্বের গপ্প শুনে শুনে আর এভাবে শিশু অবস্থা থেকেই একটি শিশুর হ্রদয়ে দুর্নীতির বীজ বপন করা হয় যে কারণে দুর্নীতিকে আমি একটি সামাজিক ব্যধি হিসেবে বিবেচনা করি এবং অবশ্যই এটি একটি জাতীয় সমস্যা, আর এর মূলে রয়েছে- অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দারিদ্রতা, অশিক্ষা, অদক্ষ জনবল এবং ইনফর্মেশনের অভাব। সাহসাই দুর্নীতি থেকে উত্তরণের কোন পথ আমি দেখছি না, তাই জয় দুর্নীতি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৭