মেয়ে হিলদিতা'কে লেখা...
ফেব্রুয়ারী ১৫, ১৯৬৬
প্রিয় মামণি হিলদিতা,
এই চিঠিটা আমি যখন লিখছি তখন তুমি অনেক ছোট হলেও যখন তুমি এটা পড়বে তদ্দিনে তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো। কিন্তু আমি চাই যে আমি যে তোমার কথা ভাবছি তুমি এটা জানতে পাও... এবং চমৎকার একটা জন্মদিন হোক তোমার। এখন তুমি আর ছোট্টটি নও, পরিপূর্ণ একজন মানুষ এবং আমি এখন আর চাইলেও তোমাকে সেই ছোট্টবেলার মত করে সেইসব অর্থহীন ছেলেভোলানো মজার মজার কথা আর লিখতে পারি না।
তুমি নিশ্চয়ই জানো যে এখন আমি অনেক দূরে, এবং এভাবেই আমাকে আরও বহুদূর যেতে হবে, শত্রুর বিরূদ্ধে লড়াই করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন তা করতে হবে। আমি বলবো না যে আমি খুব বিশাল কোনও কাজ করছি, কিন্তু এমন কিছু করছি যার কারণে তুমি চিরকাল তোমার বাবার জন্য গর্ববোধ করবে, ঠিক যেমন তুমি আমার সন্তান বলে আমি তোমার জন্য গর্ববোধ করি।
মনে মনে রাখবে, বিপ্লবের পথে আমাদের সামনে এখনও অনেক দীর্ঘ সময় পড়ে আছে, এবং যদিও তুমি একটি মেয়ে, তবু তোমাকে বিপ্লবের প্রতি তোমার কর্তব্য করে যেতে হবে। এর জন্য সময়ের সাথে সাথে তোমাকে নিজেকে আরও প্রস্তুত করতে হবে, বিপ্লবী হতে হবে--- যেটা তোমার বয়সে হয়তো অনেক বড় একটা ব্যাপার, অনেক শেখার ব্যাপার... কিন্তু সবসময় যেকোনও ন্যায্য দাবীর পাশে থেকো, তাকে সমর্থন কোরো। তোমার মায়ের কথা সবসময় মেনে চোলো, আর মনে রেখো যে আমি যা কিছু শেখার বা কাজে লাগানোর কথা বললাম তা খুব অল্প সময়ে শেখা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে তুমি সবই শিখে যাবে।
স্কুলে শ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন হওয়ার লড়াইয়ে আমি তোমাকে শামিল দেখতে চাই। শ্রেষ্ঠ বলতে সব দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ, আর তুমি নিশ্চয়ই জানো যে সব দিক দিয়ে বলতে কি বোঝায়; লেখাপড়া, বৈপ্লবিক চিন্তা--- অর্থাৎ সুন্দর ব্যবহার, মনোযোগ, একাগ্রতা, বিপ্লবের প্রতি ভালোবাসা, নেতৃত্ব... সবকিছু!
তোমার বয়সে হয়তো আমি এমন ছিলাম না, কিন্তু আমি এমন একটা সমাজে বড় হয়েছি যেখানে মানুষ ছিলো মানুষের শত্রু। এখন তোমার সুযোগ হয়েছে অন্যরকম একটা সময়ে জন্ম নেয়ার, এখন আর সেই দিন নেই, এবং এখন যে দিন এসেছে তোমাকে নিশ্চয়ই তার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।
ঘরের অন্য শিশুদের যত্ন নিও, তাদেরকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হতে এবং ভালো ব্যবহার করতে শিখিও। বিশেষ করে আলিদিতা'র দিকে খেয়াল রেখো, কারণ বড়বোন হিসেবে সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে এবং তোমার খেয়াল রাখে।
আজ এটুকুই থাক, বুড়ি। আবারও সুন্দর একটা জন্মদিনের শুভকামনা রইলো। তোমার মাকে এবং জিনাকে আমার আদর জানিও, আর তুমি নিজেও একটু নিও, অনেক সুন্দর আর অনেক জোরালো একটা আদর যার রেশ ততদিন পর্যন্ত থাকবে যতদিন না আমার ছোট্ট মামণিটার সাথে আমার আবার দেখা হবে।
ইতি---
বাবা।
****************************
ফিদেল কাস্ত্রো'কে লেখা...
হাভানা, ১৯৬৬
এই মুহূর্তে আমার একসাথে অনেকগুলো কথা মনে পড়ছে। সেই যখন তোমার সাথে মারিয়া আন্তোনিয়ার বাসায় দেখা হলো, যখন তুমি একসাথে পথ চলার কথা বলেছিলে, কিংবা সেই যে অনেক দুশ্চিন্তা জড়িয়ে ছিলো সেই প্রস্তুতির মাঝে। একদিন তারা এলো এবং আমাদের জিজ্ঞেস করলো, যদি আমাদের মৃত্যু হয় তবে সবার আগে কাকে খবর দিতে হবে? ঘটনার সম্ভাব্যতা চিন্তা করে আমরা সত্যিই হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। 'যুদ্ধে একপক্ষ জেতে আর অপরপক্ষ মরে, যদি যুদ্ধটা সত্যিকারের যুদ্ধ হয়ে থাকে'--- পরে একসময় আমরা জেনেছিলাম যে কথাটা আসলেই সত্যি। অনেক কমরেডই বিজয়ের পথে এটা অনুধাবন করেছিলেন।
এখন সবকিছুই আগের চেয়ে অনেক কম নাটকীয় কারণ আমরা এখন অনেক প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়েছি, কিন্তু এখনও পুরনো ঘটনাগুলোরই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আমি মনে করি, কিউবান টেরিটোরির মধ্যে যে কিউবান বিপ্লব ঘটেছিলো এবং সেখানে আমার যেটুকু কাজ ছিলো যেটুকু দায়িত্ব ছিলো, যে দায়িত্বটুকুর প্রতি আমি আবদ্ধ ছিলাম তা আমি পুরোপুরি পালন করেছি। এখন আমি বিদায় জানাতে চাই--- তোমাকে, আমাদের সহযোদ্ধাদেরকে এবং তোমার অনুসারীদের যারা এখন আমার।
আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবেপদত্যাগ করছি--- আমার পার্টির নেতৃত্বপদ থেকে, মন্ত্রীত্ব থেকে, কমান্ডার র্যাঙ্ক থেকে, এবং কিউবান নাগরিকত্ব থেকে। এখন থেকে আর কিউবার সাথে আমার কোনও বৈধ এবং কাগুজে সম্পর্ক থাকলো না। যে বন্ধনটুকু বাকী রইলো সেটা অন্য জিনিস, চাইলেও সেটাকে কোনও পদমর্যাদা দিয়ে আটকে রাখা সম্ভব না।
নিজের অতীত জীবনের কথা চিন্তা করলে যা মনে হয় তা হলো--- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি যথেষ্ট একাগ্রতা এবং নিষ্ঠার সাথে আমার দায়িত্ব পালন করেছি, বিপ্লবে জয়ের সূচনা করার জন্য যা করণীয় তা করেছি। আমি কেবল একটাই খুব বড় ভূল করেছিলাম, আর সেটা হলো সেই সিয়েরা মায়েস্ত্রা'য় তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর, সেই সময়টায় আমি তোমার ওপরে আস্থা রাখতে পারিনি, এবং একজন বিপ্লবী ও একজন নেতা হিসেবে তোমার যে অন্তর্গত গুণ তা চট করে ধরতে পারিনি।
আমি খুব চমৎকার কিছু সময় কাটিয়েছি, এবং তোমার পাশে থেকে সেই যুগপৎ আনন্দময় এবং দুঃখময় ক্যারিবিয়ান সংকটের দিনগুলোতে আমি আমাদের দেশের মানুষদের একজন হওয়ার যে তীব্র গর্ব তা অনুভব করেছি। এই মাটির সন্তান হিসেবে তুমি যে অসাধারণ কাজ করেছো তা খুব কম মানুষই করতে পেরেছে। আমার ভাবতে গর্ব হয় যে তোমার চিন্তাভাবনাগুলো আবিষ্কার করে এবং বিপদের সময়ে তোমার নীতির প্রতি অবিচলতা দেখে আমি কোনও দ্বিধা বা কোনও সংকোচ ছাড়াই তোমাকে অনুসরণ করেছি।
পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠিগুলো আমার সহযোগিতার বিনম্র চেষ্টাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। কিউবার নেতা হিসেবে যা তোমার দায়িত্বের পরিপন্থী আমি তা করতে পারি, এবং সেখানেই আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে।
তুমি তো জানোই যে আমি আনন্দ আর কষ্টের এক মিশ্র অনুভূতি নিয়েই তা করবো। এই জাতির একজন নির্মাণকারী হিসেবে আমি আমার সবচেয়ে বিশুদ্ধ আশাগুলো এবং সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্নগুলোই রেখে যেতে চাই। আমি এখানে সেই মানুষগুলোকেই রেখে যাচ্ছি যারা আমাকে তাদের নিজ সন্তানের মত করে গ্রহণ করেছিলো, আর এটাই আমার অনুভূতিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করছে। তোমার কাছ থেকে পাওয়া যে বিশ্বাসের শিক্ষা, এদেশের মানুষের যে বিপ্লবী বোধ, আমার পবিত্রতম দায়িত্বগুলো পালনের প্রতি যে একাগ্রতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে একজন মানুষের লড়াইয়ের যে আদর্শ- তা সে যেখানেই থাকুক না কেন, তা-ই আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। এটাই আমার শক্তির উৎস, আর এটাই আমার অন্তরের গভীরতম ক্ষতও সারিয়ে তোলার তোলার স্পৃহা জাগায়।
আমি আবারও উচ্চারণ করতে চাই যে আমি কিউবাকে আমার প্রতি সকল প্রকার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিচ্ছি। আমার অন্তিম মুহূর্ত যদি আমাকে অন্য কোনো ভূখন্ডে অন্য কোনও আকাশের নীচে কাটাতে হয়, তবুও সেখানে আমার সর্বশেষ চিন্তায় কেবল এদেশের মানুষ, কেবল তোমার চিন্তা জুড়ে থাকবে। তোমার দেয়া শিক্ষা এবং তোমার স্থাপন করা উদাহরণগুলোর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো, এবং আমার কৃতকর্মের সর্বশেষ ফলাফল পর্যন্ত আমি তাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো।
আমি সবময় আমাদের বিপ্লবের পররাষ্ট্র নীতির সাথে খুব গভীরভাবে জড়িত থেকেছি, এবং আগামীতেও থাকবো। আমি যেখানেই থাকি না কেন, একজন কিউবান বিপ্লবী হিসেবে আমার যে দায়িত্ব তা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে পালন করবো এবং সেভাবেই আচরণ করবো। আমি যে আমার স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য বস্তুগত কিছু রেখে যেতে পারিনি তার জন্য আমার কোনও অনুশোচনা নেই, কোনও দুঃখবোধও নেই। আমি তাদের জন্য কিছু চাইবো না, কারণ এই রাষ্ট্রই তাদের জীবন ও জীবীকার জন্য যে খাদ্য ও শিক্ষা প্রয়োজন তার সংস্থান করবে।
তোমাকে এবং এদেশের মানুষকে আমার আরও অনেক কিছু বলার ছিলো, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার আর প্রয়োজন নেই। আমি যেভাবে যা বলতে চাই শব্দগুলো সেভাবে সবসময় বয়ান করতে পারে না... কাজেই এলোমেলো কথায় পাতার পর পাতা ভরিয়ে আর কি লাভ বলো?
বিজয়ের পথে আজীবন!
হয় মৃত্যু নয় স্বদেশ!
তোমাদের প্রতি আমার সকল বিপ্লবী চিন্তার আলিঙ্গন।
চে।
----------------------------------
এতবড় একজন মানুষের লেখা চিঠি অনুবাদ করা, তাও তাঁর সম্পর্কে এত সামান্য জ্ঞান থেকে, সত্যিই বড় ধৃষ্টতা হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও খুব ভালোভাবে দাঁড়া করাতে পারিনি অনুবাদ্গুলো। ব্লগার ফাহাদ চৌধুরীকে ধন্যবাদ, সে এভাবে ইনস্পায়ার না করলে এভাবে চে'র চিঠি অনুবাদ করার কথা মাথায়ই আসতো না। সাহসও পেতাম না। আমি তো আসলে কেবল তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চেয়েছিলাম।
শুভ জন্মদিন, হে বিপ্লবী!
শুভ জন্মদিন, হে চিরসবুজ প্রাণ!
শুভ জন্মদিন, হে প্রিয় মানুষ!