রাস্তার পাশের ময়লার ড্রেনে বৃষ্টির ফোটার আঘাতে ছিন্নভিন্ন একটা লাল গোলাপ পড়েছিল। গোমরানো এবং ছিন্ন পাপড়িগুলোর দিকে তাকালে সহসা মনে হয় গোলাপটির মন খারাপ। কিন্তু তা নয় ,একটু ভাল করে যদি তাকালেই দেখা যাবে। এক অবর্ণনীয় কষ্টগাথা নিয়ে মুখ থুবরে পড়েছে লাল গোলাপটা।
ড্রেনের জমানো পানির উত্কট গন্ধে পেট ফুলে উঠছিল তার।
উপরে কারেন্টের তারে এসে কোথ্থেকে যেন উড়ে এসে বসেছিল একটা কাক।
গোলাপটা আকুতি ভরে বলেছিল , ভাই ঠোটে করে তুলে দাওনা আমায়!
কাকটা নেমেও এসেছিলো। ধীরধীর পায়ে কাকটার পায়ে পায়ে এগিয়ে আসার মৃদু শব্দে মুক্তির স্বাদ যেন পাচ্ছিল সে।
কিন্তু কাকটা তাকে মুক্তি দেয়নি শেষ পর্যন্ত। গোলাপটা পাশে পড়ে থাকা একটা পচা মরা ইদুর ছো মেরে নিয়ে উড়ে গেল।
কেউ একজন যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে ,কি মনে করে সে হঠাত্ করে তাকালো গোলাপটির দিকে। লাল গোলাপটি ভাবল এবার নিশ্চয় তাকে তুলে নেবে।
হয়তো ধোয়ে তার প্রিয়তমাকে উপহার দেবে। তখন তার প্রিয়তমা গোলাপটিকে আদর করে পরিস্কার তকতকে একটা ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখবে। পরিস্কার পানি দেবে। প্রতিনিয়ত একরাশ ভালবাসা ভরা চোখে তাকিয়ে দেখবে গোলাপটাকে।
লোকটা দাড়িয়ে খানিকটা তাকিয়ে থুথু ফেলে চলে গেল। একদলা থুথুতে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ল লাল গোলাপটা। কান্নায় চোখ ফেটে পানি চলে এল তার।
চমত্কার একটা বাগানে জন্মেছিল সে। এইযে ময়লা ড্রেন ,ব্যস্ত শহর ,ধুমধাম করে ছোটে চলা গাড়ি তার থেকেও অনেক দূরে।
আহা কি চমত্কার ছিলো সেদিনগুলো।
সে যখন কেবল একটা কলি। টুপটাপ বৃষ্টির ফুটো বেশ নাচছিলো। হঠাত্ করেই একটা পরীর মত মেয়ে এসে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। আহা! কি সুন্দরই না মেয়েটা দেখতে ছিল। এখনও ওর মুখটা চোখে ভেসে উঠে। কোমল মিষ্টি অমন মুখটায় একজোড়া কালো চোখ আর অমন গোলাপী ঠোট দেখে প্রথমবার হিংসেই হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা যখন আলতো করে ছুলো ,গোলাপী ঠোটে চুমো খেল তখন ভারি আনন্দ হল।
তারপর প্রতিদিন আসত মেয়েটা।
লাল গোলাপটার সাথে কত কথা বলত সে। আর মিষ্টি করে হাসত।
একদিন ভারি মুখ গোমরা করে এলো মেয়েটা। লাল গোলাপ তো আর মানুষের মত কথা বলতে পারেনা। তাও ও দখিনা বাতাসে খানিকটা দোল খেয়ে ,পাপড়িগুলো একবার তীরতীর করে কাপিয়ে জানতে চাইল মুখ গোমরা কেন ?
মেয়েটা কথা বললনা। একটু হাসলওনা। যাবার সময় যখন ছুয়ে চুমুও খেলনা ভারি কষ্ট পেয়েছিল সেদিন লাল গোলাপটা।
সেদিন ও অনেক ভেবেছিল। কি এমন কষ্ট মেয়েটার! তার যদি এমন ক্ষমতা হত মেয়েটার সব কষ্ট মুখে দিতে পারত। কিন্তু কিভাবে। সেতো নিছক একটা ফুল । একটা লাল গোলাপ।
ভাবতে ভাবতেই সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। ঘুম ভাঙল তীব্র ঝাকুনিতে। শিশির ফোটা এলো নাকি ? কিন্তু শিশির তো অমন করে ঝাকি দেয়না।
তারপরে ভাল করে তাকিয়ে দেখল সে আর নিরিবিলি বাগানটাতে নেই। চারদিকে উচু উচু সব দেয়াল ঘর। রাস্তায় হুস হুস করে ছুটছে কত গাড়ি। সেই পরী মেয়েটা তাকে আলতো করে ধরে তাকিয়ে আছে।
ও চোখ মেলে তাকাতেই মিষ্টি করে হেসে চুমু খেল। তারপর বলল , জান লাল গোলাপ! আজকে আমি যাকে ভালবাসি তার কাছে তোমাকে দিয়ে দেব। সেও আমার মত তোমায় ভালবাসবে।পরিস্কার একটা তকতকে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখবে তোমায়। প্রতিদিন আদর করে চুমু দেবে। সে একটু পরেই আসছে।
গোলাপটি অবাক হয়ে শুনছিল। আনন্দও হচ্ছিল তার অনেক। গাছ মায়ের কাছে শুনেছিল, গোলাপের জন্মই নাকি প্রিয়তমের হাত ছুঁয়ে তার প্রিয়জনের ফুলদানী ঠাঁই পাওয়া।
আজ তাহলে তার জন্ম সার্থক হতে চলেছে।
বেলা যখন গড়িয়ে দুপুর ঠিক তখন একটা লাল গাড়িতে করে এলো একটা ছেলে। নানা একজন নয়। আরও কয়েকজন তার পেছনে। কেমন বিদঘুটে চোখে তাকাচ্ছে ওরা। উদ্ভুট একটা হাসি ঠোটে লেপটে ওদের। এসেই পরী মেয়েটার হাত পাকরে ধরল। একটা পাপড়ি কুচকে যাওয়ায় ব্যাথায় কাতরে উঠল গোলাপটা।
এরপর একটা দমকা টানে গোলাপটা ছিটকে পড়ল ময়লা ড্রেনটায়। ঝাপসা চোখে একবার তাকাল ওদিকে গোলাপটা।দেখল অমন পরীমেয়েটাকে কেমন টেনে হিচরে গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেগুলো।
পরী মেয়েটার না জানি এখন কি হয়েছে।
সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে।
মিইয়ে আসছে লাল গোলাপটাও। পাপড়িগুলোতে মনে হয় কোন পোকায় ধরেছে। তুলতুলে পাপড়িগুলো ছিদ্রে ছিদ্রে বিদঘুটে করে তুলল ওরা।
গোলাপটা শেষবারের মত একবার আকাশে তাকাল। ডুবু ডুবু সূর্যের তাকিয়ে কি যেন একটা ভাবল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেবল।