ডুব(No Bed Of Roses) অথবা "বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা সৃষ্টি"
a film by "Mostofa Sarwar Farooki"
দেখুন "মিস্টার শেক্সপিয়ার" একটা কথা বলেছেন "মানুষ মারত্মক ক্ষমতাধর একটি প্রানী...সারা বিশ্বে এর ক্ষমতার প্রভাব ছড়িয়ে আছে...মানুষ শুধুমাত্র এক জাগাতেই তার ক্ষমতার প্রভাব ফেলতে পারেনা...সেটা কি? সেটা মানুষের মন...মানব-মন তার আপন গতিতে চলে..."
"ডুব" অথবা "No Bed Of Roses" এই বছরের বেশির ভাগ সময় ধরেই আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছিলো..যার প্রমান দুইদিন ঘুরেও টিকিট না পাওয়া.. তো কেন এই উন্মাদনা?? প্রথমতো কন্ট্রোভারসি..এরপরে ফারুকী স্যার এর ছবি এবং সেখানে ইরফান খান আছেন..
গতরাত থেকেই আমি অস্থির..হঠাত ভোর চার টায় উঠে হিসেব করছি "দুপুর একটা হইতে আর কত দেরি পাঞ্জেরী?" তো যাহা হোক অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো..
এটা কী বায়োপিক?
এর উত্তর দেয়ার আগে পপকরন এর রিভিউ টা দেই...খুবি ভালো..লবন পরিমান মতো ছিলো...
আচ্ছা ফাজলামো বাদ.. প্রথমতো এটা বায়োপিক না কারন পরিচালক বলে দিয়েছেন "ইটস নট আ বায়োপিক"... দ্বিতীয়ত এটা বায়োপিক না কারন এটা আসলেই বায়োপিক না..তবে হ্যা ছবির কাহিনীর শিকড় যে হুমায়ুন স্যার এর জীবন গল্প থেকেই মাটি পেয়েছে তা ফারুকী স্যার মেনে নিতে বাধ্য...গল্প বাস্তব জীবন থেকেই ইন্সপায়ার হবে সেটাই স্বাভাবিক...গল্প আর যাই হোক #ওহী নয়..
সিনেমা শুরু..অসাধারন সিনেমাটোগ্রাফি শুরুতেই আপনাকে বুঝিয়ে দিবে বসে থাকা সাবেরী এবং নিতুর মধ্যকার দুরত্ব কে ব্যাখা করতেই করতেই এগিয়ে যাবে সিনেমা...
যদি আপনার উদ্দেশ্য থাকে আপনি "শাটার আইসল্যান্ড" এর মতো কাহিনী দেখতে যাচ্ছেন...অথবা হুমায়ুন স্যার এর বায়োপিক দেখতে যাচ্ছেন...অথবা ড্রামাটিক কোন টুইস্ট দেখতে যাচ্ছেন...অথবা চোখ বড় বড় করা ভিএফএক্স দেখতে যাচ্ছেন...তাহলে হ্যা আপনি হতাশ হতে বাধ্য...এটা এক কাপ চায়ে শেষ করা সুন্দর একটি বিকেলবেলার মতো ছবি...যেখানে কিছু সুন্দর অথবা কমপ্লিকেটেড মুহূর্ত থাকবে যা আপনাকে ভাবাবে..সে ভাবনা টা আপনাকে এনে দিতে পারে কিছুটা সুখানুভূতি অথবা কয়েক ফোটা চোখের জল...যেটাই হোক না কেন সবই আপনার জীবনের অংশ...
ডুব একটি এক্সপ্রেশন নির্ভর সিনেমা...এখানে প্রচুর খালিঘর রয়েছে...পরিচালক সেই খালিঘর পূরনের দায়িত্ব দর্শকের হাতে দিয়েছেন...একটা স্ট্রাকচার ক্রিয়েট করে দিয়ে গেছেন যেখানে মানুষ তার নিজ অনুভূতি গুলো বিল্ড আপ করবে সিনেমার সাথে...!!
ভাবুক কবি সন্ধ্যেবেলায় ভাবের কবিতা লিখেন...সেই ভাবের কবিতা আমাদের ভাবায়...ভাবতে ভাবতে সেই ভাবের প্রভাবে আমরা ভাবিত হই...এভাবেই সৃষ্টি হয় ভবের খেলা...একটা ঘোর...!!
একই সুত্র মেনে পরিচালক ফারুকী এখানে প্রচুর ভাবনার জায়গা রেখেছেন......কেউ সেখানে নিজেকে জাভেদের মাঝে খুজে পাবে...কেউ নিজকে খুজে পাবে সাবেরীর মাঝে অথবা নিতু কিংবা মায়া তে নিজের ছায়া দেখবেন...এবং সেই ভাবে নিজেকে প্রতিটা সিনের সাথে এক্সপ্রেস করবেন...এখানে কোন ভিলেন নেই...কিন্তু যে সাবেরী অথবা মায়ার পক্ষ নিয়েছে সে নিতু কে ভিলেন ভাববে...কিন্তু নিতু অথবা নিতু-দের কাছে নিতু নির্দোষ..সে প্রেমে পড়েছিলো ব্যক্তি জাভেদ এর সাথে...বান্ধবীর বাবা জাভেদের সাথে নয়...!!
আমি আবারো বলছি এই ছবির প্রধান অস্ত্র "এক্সপ্রেশন "...এই অস্ত্র আপনার চোখে আঘাত করে নোনা জল বের করতে চাইবে...এই অস্ত্র আপনার হার্টে আঘাত হেনে হার্ট বিট বাড়িয়ে দিবে...সুতরাং হলে আসুন..সিনেমা দেখুন এবং আঘাতে জর্জরিত হোন...!!
অভিনয় কেমন লেগেছে?
ইরফান খান এর অভিনয় নিয়ে কথা বলার সাহস আমার নেই...তিনি আবারো তার ক্ষমতার প্রদর্শন ঘটিয়েছেন...কিন্তু বাঙ্গালী হিসেবে তার বাংলাকে জাজ করার যোগ্যতা আমার আছে...তার বাংলায় হিন্দী টান বোঝা যাচ্ছিল...ইট ওয়াস ওকে...বাট দুটো ডাইলগ কানে লেগেছিল...ডাবিং এ এডিট করা দরকার ছিলো..আর ইংলিশের ব্যবহার এবং পরিমান ঠিক ছিলো...কিন্তু ফারুকী স্যার একটা বিষয় মিস করে গেছেন যেটা আমার মতো নগন্য ২১ বছরের যুবক ধরতে পেরেছে...সেটা হচ্ছে ইরফান খানের ইংরেজীতে ইন্ডিয়ান এসেন্ট ছিলো...এটা আমার কানে লেগেছে...
তিশার অভিনয় দুর্দান্ত...
রোকেয়া প্রাচী তার কাজ ঠিক মতো করেছেন...
কিন্তু আমি হতাশ "পার্নো মিত্র" এর মতো অভিনেত্রীকে অপচয় হতে দেখে...তিনি তার ক্ষমতা প্রকাশের সুযোগ পান নি...আমি ব্যক্তিগত ভাবে তার অভিনয়ের ফ্যান...সেই "রঞ্জনা আমি আর আসবোনা" থেকে...বাট তিনি যখন ই পর্দায় এসেছেন তিনি তার ক্ষমতার প্রদর্শন করেছেন...তার চরিত্র টা আরো স্ট্রংলি প্রকাশ করা যেতো...
কেনো এই সিনেমা ৯০% মানুষ পছন্দ করছেন না?
দেখুন প্রত্যেকের ই তাদের নিজ নিজ অপিনিয়ন আছে..You have to respect that...কেউ বলে "মামা চায়ে চিনি কম কেনো?" আবার কেউ বলে "এই মামা কি ব্যাপার তুমি চায়ে চিনি দিয়েছো কেনো?"
কেউ বলে "এই তরকারী তে এতো ঝাল কেন?" আবার কেউ বলে "তরকারী তে ঝাল দাও নি কেনো?"...
"Unexpected virtue of ignorance" সিনেমা কে অনেক নামকরা সমালোচক সমালোচনা করেছেন...বলেছেন এটা "ইনারিতু"র একটি বাজে ক্রিয়েশন...রিগ্যান নামের এক ডিপ্রেসড অ্যাক্টর এর কাহিনী বলে একটা ব্ল্যাক কমেডি সৃষ্টির অহেতুক চেষ্টা.. অথচ এটাই ২০১৪ সালে অস্কার জিতে নেয়!
এক্সপ্রেশন নির্ভর সিনেমা দেখতে অনেকেই অভ্যস্ত নয়...বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের অডিয়েন্স...তারা সকল কিছু তেই উদ্দেশ্য খুজতে চান...সকল কিছু নিউটনের সূত্র মেনে চলে না.. উদ্দেশ্যহীন ভাবে তুলির আচর দিতে দিতেই #ভিঞ্চি মোনালিসার হাসি টা ক্রিয়েট করতে পেরেছিলো...যা মানুষ কে আজো ভাবায়...ওটা কিসের হাসি ছিলো যেটার রহস্য থেকে যাবে...এই সিনেমা ও সেরকম ই একটি আর্ট ছিলো...যেখানে কোন সলিউশন বা কোন কিছু প্রুভ করার চেষ্টা করা হয় নি...মানুষ তার জীবনের সাথে কম্পায়ার করে যা ভাবতে পারে ভাবুক...এটাই ছিলো পরিচালকের ইচ্ছা...এবং তিনি সফল...আমি যেভাবে রিলেট করেছি বাবার প্রতি অভিমানী সাবেরীর সাথে যখন সে ডেডবডির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো...এই যে ক্যারেক্টারের সাথে অডিয়েন্সের রিলেশন বিল্ড আপ করাই ছিলো সিনেমার স্বার্থকতা!!
এখন আসি টেকনিক্যাল ব্যাপার গুলো তে...
সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফারের এটা প্রথম কাজ ছিলো...আমি মনে করি তিনি ভয়ংকর ভালো কাজ করেছেন...অনেকে বলেছেন " এতো লতা পাতা চেয়ার...টেবিল গ্লাসের পানি ...ছবির ফ্রেম এর দৃশ্য কেনো?" হা হা হা হা...আমার পাশে বসা ভদ্রলোক তার ওয়াইফ কে বলছেন এগুলা কি দেখায়? নায়িকা কই? ....ফারুকী স্যারের সিনেমায় ভিজুয়াল অনেক ডিটেইলস এ থাকে...এতে করে সিনের অভিব্যক্তি আরো ভালভাবে প্রকাশ পায়..কিছু কিছু লং শট দেখার মতো ছিলো...বাট দুইটা সিন এ ক্যামেরা মুভমেন্ট ঠিক ছিলো না...আমার চোখে লেগেছে...আর আউট ডোর এর কালার গ্রেডিং আরো ভালো হতে পারতো...
সিনেমায় তিন টা ভুল ছিলো...একটা ভাত খাওয়ার সিন ছিলো...সেখানে পরিচালক তার অভিনেতা কে বলতে ভুলে গেছেন তার পাঞ্জাবীর হাতা ভাতে লেগে যাচ্ছিল...বিলিভ মি পরিচালক এটা চান নি যে হাতা ভাতের সাথে লাগবে...
সেকেন্ড টা ঠিক ভুল না...কিন্তু আমার চোখে লেগেছে.. জাভেদের মৃত্যু সংবাদ মায়ার কাছে পৌঁছানো...জাভেদ মারা গিয়েছে...সকাল পেরিয়ে গেছে...কুরআন খতম হচ্ছে...ব্রেকিং নিউজ...সাংবাদিক রা ছুটোছুটি করছে...আর সকাল পেরিয়ে যাওয়ার পর মায়া মৃত্য সংবাদ পেলো ব্যাপারটা একটু হলেও কেমন যেন লাগে...বাট পরিচালক কাজ টা ইচ্ছে করেই করেছেন...তিনি প্রথমত একটা ট্রান্সিশন দেখিয়েছেন...এন্ড দ্বিতীয়ত তিনি মায়া এবং সাবেরীর রিয়্যাকশনের মাঝে কোন কাট শট চাচ্ছিলেন না...!!
তৃতীয়ত একটা ডাবিং মিসটেক ছিলো...
তো এখন?
এখন সব মিলিয়ে সিনেমা টা দেখার অবশ্যই দেখার মতো...এটা ভেতরে ভেতরে ফুপিয়ে ওঠার সিনেমা...এর আরেক নাম দেয়া যেতে পারে "The Sound Of Silence"
অবশেষে আমি বলবো...
আমাকে ভাবায় জাভেদ এর সাথে নিতুর সিগারেট শেয়ারিং এর দৃশ্য...কোন কথা ছিলো না কিন্তু এর পেছনে মারাত্মক প্রেম লুকিয়ে ছিলো...
আমাকে ভাবায় জাভেদ এর অসাহায়ত্ব...আপনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন "এই কুত্তার বাচ্চা তুই তোর মেয়ের বয়সী মেয়ের সাথে প্রেম করলি কেন? বিয়ে করলি কেন?"
জাভেদ উত্তর দিতে পারবেনা সে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থকবে...সেই অসহায়ত্ব আপনাকে ফিল করতে হবে...
আমাকে ভাবায় জাভেদ এর মৃত্যু সংবাদ শুনে স্নান ফেরত মায়া ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে যখন আপন মনে বলে ওঠে "জানো আমি তোমার মৃত্যু সংবাদ শুনে খুশি হয়েছি..অনেক খুশি হয়েছি...কারন তুমি এখন আর কারো অধিকার নও"
আমাকে ভাবায় বাথ টাবে বসে থাকা সাবেরী...যার অস্রু কে সিড়ি গড়িয়ে পড়া পানির মাধ্যমে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে...
আমাকে ভাবায় খাবার টেবিলে মায়ের কাছে বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে যখন সাবেরী বলে "মা প্রতিদিন ডিম পোচ ভালো লাগে না...কাল থেকে পিয়াজ মরিচ দিও"
আমাকে ভাবায় যখন জাভেদ এর চোখ কথা বলে...
এ এক ভাষা...নীরাবতার ভাষা!!
আমাকে ভাবায়...আপনাকেও ভাবাবে...পাহাড় নামের নদীর পাশে খানিক টা সময় বসে থেকে জীবনের জন্য কিছু এক্সপেরিন্স নিয়ে আসুন...হোক না সেটা বিষাদের অথবা চাপা কান্নার...এটাই তো জীবন...আহারে জীবন...আহা!!
বিঃদ্রঃ আমাদের দেশের সিনেমা এগোচ্ছে...আরো আগাবে আমাদের সাপোর্ট পেলে..আসুন আমরা নিজের দেশের সিনেমা কে সাপোর্ট করি...সেগুলো হলে যেয়ে দেখি...এবং ভালো মন্দ আলোচনা করি...ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪০