আমার তিনবছরের মেয়েটা সফেদা খেতে খুব পছন্দ করে। এক্কেবারে মায়ের বেটি। ল্যাবএইড থেকে বেরোবার ঠিক আগে আগে আম্মা জোর করে তাই হাতে গুঁজে দিলেন সফেদার একটা থলে, তার নানুভাইয়ের জন্যে। অরণীটার মাথায় তার মায়ের মতোই ক্যারাব্যারা আছে, দুষ্টের শিরোমণি। এই বয়েসেই এমন সব কথা বলে বসে মাঝে মাঝে, মাহফুজ আর আমি হা করে তাকিয়ে ছাড়া কিছু করতে পারি না!
ইসলামপুরের ছোট্ট বাসাটার মতোই আমাদের সংসারটাও নতুন। মাত্র চার বছর হলো মাহফুজের সাথে বিয়ের, এখনও প্রেমের মৃত্যু হয় নাই। মাঝে মাঝেই সন্ধ্যায় পরিটাকে সাজিয়েগুজিয়ে দুজনে রিক্সা নিয়ে ঘুরে বেড়াই জাবি ক্যাম্পাসে, খোকন মামার চটপটি চেটেপুটে খাই! অরণীটার সব বিরক্তির প্রকাশ এক শব্দে, "উফফ"! চটপটির ডাল মুখে দিলে গরম হোক বা ঠাণ্ডা চোখ মুখ কুঁচকে একবার উফফ বলবেই দুষ্টটা!
অফিসের বেলী আপার ছেলে অরিত্রর সাথে মিল দিয়ে দুজনে বুদ্ধি করে মেয়েটার নাম রেখেছি অরণী। এরা দুইটা বড় হয়ে প্রেম করবে আমার আর মাহফুজের মতো। এই ভবিষ্যৎ ভাবনায় বেলী আপার সে কী হাসি! মাহফুজ আমাকে আস্তে করে বকে দেয়, বলে পাগল। আমি হাসি, দেখাদেখি পুচ্চি মেয়েটাও হাসে। ছোট্ট গোলগাল নরম চুলে ভরা মাথাটাকে বুকে টেনে নিয়ে মেয়েকে শুধাই, "কিরে বেটি, প্রেম করবি না অরিত্রর সাথে?" অরণী সংক্ষেপে বলে, "কব্বো!"
বেশ কিছুদিন ধরেই মা অসুস্থ! ল্যাবএইডে নিয়ে গেলাম আজকে থরো চেকআপ এর জন্য। অফিস ছুটি নিতে হলো। অবশ্য বেলী আপা আর কণিকাদি আছে, সামলে নিতে পারবে। শ্যামলীতে মাকে নামিয়ে দিয়ে বাসে উঠলাম। সবসময়ের মতো বাস আজও টইটুম্বুর! ঢাকায় আসতে ইচ্ছা করে না এই কারণে। ভাগ্যটা অবশ্য দেখা গেলো আজ বেশি খারাপ না! টেকনিক্যাল পৌঁছাতেই একটা সিট পেয়ে গেলাম। হেডফোনের ভলিউম ঠিক করে চোখ বন্ধ করে আকাশ-পাতালের চিন্তার খেরোখাতা খুলে বসলাম। একনাম্বারে ভাবতে হবে অফিস যাবো নাকি সোজা বাসা! অফিস পৌঁছাতে পৌঁছাতে অবশ্য লাঞ্চ আওয়ার হয়ে যাবে। ঠিক করলাম বাসাতেই যাবো। দুই নাম্বারে আছে, বাসায় গিয়ে দুপুর পার হলে মেয়েটাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে মনোয়ারা আপার সাথে দেখা করতে হবে। কলতান-এ দিবো ভাবছি অরণীকে এই ডিসেম্বর থেকে। বাচ্চারা কতো জলদি বড় হয়! এইতো ক'দিন আগেই জন্মালো, আর এখনই স্কুলে পড়ার বয়েস হয়ে গেছে! এরপরে হর্টাসে যেতে হবে পাতাবাহারের একটা গাছ আনতে, স্যান্ডেল সারাতে দিবো, অরণীর একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি তুলতে হবে আর আমারটার কয়েকটা প্রিন্ট দরকার। মুরগি কেনা লাগবে, আর কিছু সবজি। ওহহো! ফ্রিজে কী একটা যেন গোলমাল হচ্ছে, পানি পড়েই যাচ্ছে কদিন ধরে, মেকানিক ডাকতে হবে। ঈদ সামনে তার জন্যেও কিছু প্রস্তুতি দরকার। মোট সাতখানা কাজ, আমার লাকি নাম্বার! বেশ ক'বার লিস্টিটা আউড়ে নিয়ে চোখ বুজলাম। অফিস ছুটিটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাই আজ!
বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, তীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাংলো! কান থেকে হেডফোন, হাত থেকে ব্যাগ ছিটকে কই গেলো কে জানে। বাসের সিট থেকে সেই সাথে আমিও। প্রচণ্ড শব্দ, জানালার কাচ ভাঙা, মানুষের চিৎকার, একগাদা পাগলপ্রায় শরীরের সাথে বাড়ি খেতে খেতেও বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে! খুব শখ ছিলো নাসায় গিয়ে জিরো গ্র্যাভিটি অনুভব করার, সেরকম কেমন নিরালম্ব ভাব হলো যেন। হাত পা ভারহীন, শরীরটা পালকের মতো। ভয়াবহ শব্দের সাথে বাসটা গড়িয়ে যেতে লাগলো নিচে। বাসটা উলটে যাচ্ছিলো, ভিতরের যাত্রীরা তালগোল পাকাচ্ছিলো জীবন্ত ময়দার দলার মতো, দুমদাম বাক্স-প্যাটরার বাড়ি খেতে খেতেও একটা বাচ্চা হঠাৎ কোথা থেকে যেন ছিটকে এসে আমার বুকে ধাক্কা খেলো। অরণীর বয়েসি! ঐ সাংঘাতিক অবস্থাতেও বাচ্চাটার জন্যে হাত বাড়িয়েছিলাম! পানিতে পরার আগে এক মহিলার তীব্র চিৎকার শুনেছিলাম মনে হয়, মনে হচ্ছিলো চিৎকারটা বেজে চলছে একনাগাড়ে, আমার মস্তিষ্কের ভিতরে। নিউরনে অনুরণন চলছে টানা!
মৃত্যুর ঠিক আগে আগে নাকি মানুষের পুরো জন্মের স্মৃতিচারণ হয়ে যায়? আমি তো অরণীকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছি না! অজানা সেই ছোট্ট মা-টাকে বুকে চেপে ধরে ভাবছি আমার মেয়েটার কথা। মা আমার, তোকে কি আর বুকে নিতে পারবো?
এনাম মেডিক্যালের বারান্দায় সার বাধা লাশের মাঝে মাঝ কুড়ির একটা মেয়ের লাশ। শাড়ি পরা, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে সুতা দিয়ে বাঁধা ছোট্ট একটা ট্যাগ, তাতে লেখা, নাম্বার সেভেন, লাকি নাম্বার!
-------------------------------------------------------------------------
কিছুদিন আগে জাতীয় দৈনিকগুলোতে একটা খবর এসেছিলো বড় করে। সেদিন গুলিটা বলা যায় আমার কানের একেবারে পাশ ঘেঁষে গিয়েছে। ক্লাস ছিলো সেইদিন, অন্যদিনের মতো সেদিনও বৈশাখীতেই সাভার পর্যন্ত গিয়ে লোকালে চেপে জাবি যেতাম। মাত্র মিনিট খানেকের জন্যে বাসটা মিস করি। সামনে দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলো তখন মেজাজ ছিলো তুঙ্গে, ক্লাসে লেট হবো ভেবে। আমিন বাজার পার হবার সময় পরে বুঝি যে যে আমি ডি-লিঙ্ক-এ চড়ে এখন যাচ্ছি তার এটা বোনাস লাইফ!