"আচ্ছা বলো তো...........।"
আমি চমকে ফিরে তাকাই। দেখি, সারাহ।
"কি ব্যপার সারাহ?"
"তোমার কাছে একটা ব্যপার জানতে চাইছিলাম। এই যে অনার কিলিং, এটার সাপোর্ট ইসলামের কোথা থেকে এসেছে?"
ওহ। সে বিরক্তিকর প্রসংগ আবারো। পশ্চিমে পা দেয়ার পর থেকেই ক্রমাগতএর মুখোমুখি হচ্ছি। মুহুর্তে মেজাজ চড়ে যায় সপ্তমে। কিন্তু সেটা তো আর প্রকাশ করা যায় না। তাই ঠান্ডা মাথায় নিজেকে শান্ত রেখে জবাব দিলাম,
"আমিও ভাল মত জানি না। শুধু পত্রিকার পাতায় পড়েছি। যা জানি তা হল পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশে এটা টিকে আছে।"
"সাপোর্ট কোথা থেকে আসে?"
"সাপোর্ট আবার কোথা থেকে আসবে? পাকিস্তানের সামন্ত তান্ত্রিক ব্যবস্থাই দায়ী। আরো শুনেছি তুরষ্ক সহ আরো কিছু দেশে রয়েছে। কই, আমাদের দেশে তো নেই।"
"সে তো বাংগালী মুসলিমেরা অনেক লিবারেল। কিন্তু তুমি বলছ সত্যিই ইসলামে এরকম কিছু নেই?"
"আমাদেরও নানা সমস্যা রয়েছে। যৌতুক, এসিড মারা - এসব। চিন্তা করে দেখ তো এসিড মারা কি রকম ভয়াবহ। বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে এভাবে সন্ত্রাস হচ্ছে। আমার কাছে তো এটা অনার কিলিং এর চেয়ে কম ভয়ংকর মনে হয় না। আমি কিন্তু এই অনার কিলিং এর নাম আমি পশ্চিমে এসে প্রথম শুনি। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশে এটা আবার কারোকারি নামে পরিচিত। কারো বলে ছেলেটিকে আর কারি বলে মেয়েটিকে। পাকিস্তানে তো অনার কিলিং এর বিরুদ্ধে আইন রয়েছে। তবে এখনও সেখানে রয়ে গেছে অনার কিলিং। " এক নিঃশ্বাসে আমি কথাগুলো শেষ করি।
সারাহ ঘটনা ব্যখা করল। কয়েকদিন আগে একটা খুন হয়েছে। পরিবার মিডল ইস্ট থেকে আসা। মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ছিলো বলে বাপ-ভাই দুজনে মিলে মেয়েটাকে খুন করেছে। স্বভাবতই ঘটনাটি মিডিয়াতে আলোড়ন তুলেছে।
"দেখ, এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক থাকলে তো সব মুসলিম দেশেই সেটা হত। কই, আমি তো আমাদের দেশে এরকম শুনিই নি। যদিও আমাদের নারী নির্যাতনের কোন মাত্রা নেই।" আমি জবাব দেই।
কাজ থাকায় সারাহর সাথে সেদিনের আলোচনা আর বেশী আগায় নি। শুধু সারাহর একার নয়, বরং এখানকার সব সাধারন মানুষের মুসলিম দেশগুলোর প্রতি একই রকম স্টেরিও টাইপড ধারনা । সাথে সাথে ইসলামের প্রতি। অনার কিলিং সহ নারীর প্রতি হাজারোটা সন্ত্রাসের লীলাভূমি হল মুসলিম দেশগুলো । এবং সেটা মুসলিমদের বিশ্বাসের সাথে জড়িত। মুসলিম দেশ, ইসলাম নিয়ে এসব নেগেটিভ ধারনা যেন তাদের মাথায় সিন্দাবাদের ভূতের মত গেথে বসে আছে।
৯/১১ এর পরে মধ্যপ্রাচ্যের এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের মানবাধিকার লংঘন, সন্ত্রাস জনিত যে কোন ঘটনা এখানকার সংবাদ মাধ্যম গুলোতে খুব সাড়া জাগানো ভাবে পরিবেশিত হয়। পশ্চিমে যে ক্রাইম কিংবা সমস্যা নেই - তা নয়। পশ্চিমে পা দেয়ার পরে আমি অনার কিলিং এর কথা যেমন প্রথম শুনতে পাই, তেমনি সাইকোপ্যাথ জাতীয় খুনের খবরও জীবনে প্রথম দেখি। টেড বান্ডি, জেফরি ঢামারদের মতন সাইকোপ্যাথদের কথা যখন টিভিতে দেখি, তখন আমি বাকরূদ্ধ হয়ে ভাবতে থাকি কি করে একজন অতি অসাধারন মেধাবী ছাত্রের পক্ষে এরকম সাইকোপ্যাথ হওয়া সম্ভব। বলাবাহুল্য, এদের প্রথম শিকার নিরীহ নারীরা। এছাড়া টিন এজ প্রেগনেন্সি, সেক্সুয়ালী টান্সমিটেড ডিসিজের সমস্যা তো আছেই। মুসলিম দেশের সামাজিক ব্যবস্থা যদি অনার কিলিং এর পরিবেশ তৈরী করে থাকে, তবে পশ্চিমের সমাজ ব্যবস্থাও কি তাদের সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী নয়? পশ্চিমের এইসব সমস্যার ভিক্টিম যে কেবল কম নয়, সেটা তো পরিসংখ্যানই বলে দেয়। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোকেই যেন টেনে আনা হয় বার বার নারীর প্রতি সন্ত্রাসের প্রকৃষ্ট উদাহরন হিসেবে।
আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, তাতে ক্ষতি কি? নারীর প্রতি বৈষম্য আর সহিংসতা যে মুসলিম দেশে প্রচুর সংখ্যায় ঘটে থাকে তাতো মিথ্যা নয়। সংবাদ মাধ্যম যদি তা ফোকাস করে তবে তো তা বরং জনসচেতনতা বাড়াবে। ফলশ্রুতিতে মুসলিমরা নিজেদের দেশের সমস্যা সমাধানে আরো বেশী মনোযোগী হবে, আরো বেশী যত্নবান হবে। সুতরাং পশ্চিমে যদি এসব নিয়ে তোলপাড় হয়, তবে সেটাকে বরং আমাদের মোবারকবাদ জানানো উচিত।
আমি এর সাথে আংশিক একমত পোষন করব। পুরোটা নয়। এসব প্রচারনার ফলে যে মুসলিমরা কিছুটা হলেও সচেতন হচ্ছে - সেটা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একতরফা প্রচারনা, কিংবা অতিরন্জ্ঞিত কথন - কোনটাই প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরে না, কিংবা সার্বিকভাবে মংগলময় হতে পারে না। মুসলিমদেশগুলো নিয়ে এত বেশী নেগেটিভ প্রচারনাতে হয়ত আমাদের সচেতনতা বাড়ছে, আমরা নিজেদের সমস্যার সমাধানে আগ্রহী হচ্ছি, কিন্তু ক্ষতি হয়ে যায় অন্যভাবে - আমরা হারাচ্ছি বিদেশীদের বিশ্বাস। চাকুরীতে, সামাজিকভাবে সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নিগৃহীত হবার কিংবা বৈষম্য সৃষ্টির অজুহাত হিসেবে দাড় করানো হয় এসব ঘটনাকে। কুর্দীদের প্রতি সাদ্দামের সীমাহীন জুলুম নির্যাতনকে যেমনি করে সামনে টেনে হয়েছিলো ইরাক আক্রমনের বৈধতা দেবার জন্যে, তেমনি করে মুসলিম দেশগুলোতে ঘটে যাওয়া এই নারী বিরোধী ঘটনা গুলো দিয়ে চলতে থাকে সাধারনের মনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বিরূপতাকে উস্কে দেয়া। ফলশ্রুতিতে টার্গেট হয়ে যায় সব ধরনের মুসলিম - হোক না যতই লিবারেল আর প্রগতিশীল।
পশ্চিমে ইসলাম বিদ্বেষের সর্বশেষ উদাহরন হিসেবে আপনারা দেখেছেন স্যাটানিক ভার্সেস আর দ্য জুয়েল অব মেদীনা জাতীয় বইগুলোতে আল্লাহর রাসুল (সা) আর উম্মুল মুমিনীনদের নিয়ে অশোভন কটাক্ষ করার অপপ্রয়াস। কাল্পনিক ঘটনা পরিবেশনের মাধ্যমে ইসলামের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের সম্মানহানির দুরভিসন্ধি স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের আহত করেছে। ইসলাম বিদ্বেষের একই রকম আরেকটি প্রয়াস ছিল "সাবমিশন" নামে একটি ম্যুভি। এই ছবিটির পরিচালক ছিলেন বি্খ্যাত চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গগের নাতি থিও ভ্যান গগ। আর স্ক্রিপ্ট রাইটার ছিলেন সোমালিয়ান মুসলিম বংশোদ্ভূত আয়ান হিসরী আলী, যিনি পরবর্তীতে ইসলাম ত্যাগ করেন এবং হল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। ছবিতে ইসলামকে দেখানো হয় পশ্চাদপদ, অনগ্রসর এবং নারীর প্রতি অবমাননাকর একটি ধর্ম হিসেবে। ইসলাম এবং ন্যুডিটির অবস্থান পরস্পর বিপরীতমূখী। অথচ এই ছবির প্রথমেই দেখা যায় স্বচ্ছ পোশাকে প্রায় বিবসনা এক নারী মুখে নেকাব এটে নামাজে দন্ডায়মান। পুরো ছবিটিতে কোরানের আয়াত বিভিন্ন ইস্যুতে সামনে টেনে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখা করা হয়। যা চরমপন্থী এবং বিষেদগারে পরিপূর্ন। অত্যন্ত উস্কানীপূর্নভাবে নির্মিত এই ম্যুভি শুধু মুসলিমদের বরং যে কোন বিবেকবান মানুষকে আহত করবে। পরবর্তীতে একজন মুসলিম যুবক কর্তৃক দুঃখজনক ভাবে থিও ভ্যান গগ নিহত হন। (যা অবশ্যই নিন্দনীয়)। হিরসীকে আত্মগোপন করে থাকতে হয় বেশ কিছু দিন। মুসলিমদের সমালোচনায় আবারো শোরগোল উঠে চারিদিকে। মিডিয়াতে সরব হয়ে উঠে অনেকে। যা প্রকারান্তরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যায়। তবে পরবর্তীতে ডাচ সরকারের আয়রন লেডী রিটা ভ্যানডর্ক তার ইমিগ্রেশন বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ায় সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয় হিরসীকে। অনেকটা তসলিমাকে নিয়ে বাংলাদেশ/ভারতে যা হয়েছে তার অনুরূপ।
এখানে উল্লেখ্য, আমি নিজেও আফ্রিকাতে নারীদের অবস্থান শোচনীয় বলে বিশ্বাস করি। অশিক্ষা, কুশিক্ষায় অনগ্রসর আফ্রিকান ক্ষমতাহীন নারীদেরকে সংবাদ মাধ্যমে যেভাবে চিত্রিত করা হয়, তা হয়ত বানোয়াট নয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা সেরকমটিই বলে। পাশের বাসার ভাবী একবার বলছিলেন কানাডায় এদের অবস্থার কথা। কানাডায় সোশাল প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে কুমারী/অবিবাহিত মাতাদের কিছু ভাতা দিয়ে থাকে। একবার সেই অফিসে এক আফ্রিকান মুসলিম নারী যান ভাতা আনতে। সেখানকার কর্মরত মহিলাও তাকে চেপে ধরেন, "দেখো, মুসলিম মেয়েরা তো বাইরের কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায় না। নিশ্চয়ই তোমার স্বামী আছে।" জেরার মুখে মেয়েটা প্রায় কেদে স্বীকার করে, "হ্যা। আমি বিবাহিত। আমার স্বামী আমাকে এখানে পাঠিয়েছে কুমারী/অবিবাহিত মাতৃত্বের ভাতার জন্য। সে আরো কয়েকটা বিয়ে করেছে।"
এই হল অবস্থা। মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকার অধিকার এদের কতটুকু আছে সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু ইসলামকে এই সমস্যার মূল হিসেবে চিত্রিত করা আদৌ গ্রহনযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে পশ্চিমেই বা কি করে এত নারী সহিংসতার মূখোমুখি হয়ে থাকে?
তবে যে বিষয়টা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার দাবী রাখে তা হল, এই পরিস্থিতিতে আমাদের করনীয় বিষয় কি? আমরাই বা কি এর প্রেক্ষিতে খুব বিবেচনা প্রসূত আচরন করছি। আমার জবাব হবে, না। আমরা তা মোটেও করছি না। এবং সে কারনেই পশ্চিমে ইসলামের এবং মুসলিমদের বিরোধীরা নিজেদের অবস্থান গেথে নিতে পেরেছে। আমাদের অবিবেচক আচরনের কারনে তসলিমা নাসরীন আর আয়ান হিরসী আলীদের অবস্থান পশ্চিমে সুদৃঢ় হয়ে থাকে। শেষ একটি উদাহরন দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানছি।
আগেই বলেছি, মুসলিম দেশের নারী বিরোধী কিছু ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে সংবাদ মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। সেরকম একটি ঘটনা ছিল মুখতার মাই সংক্রান্ত ঘটনা। মুসলিম দেশে ধর্ষনের বিচার হয় না - এই প্রপাপাগান্ডার সমর্থকরা উদাহরন হেসেবে বেছে নেন মুখতার ঘটনাকে। সেরকম প্রচারনা কি কোন ভিত পেত যদি সঠিকভাবে এই ঘটনার বিচার কার্য সম্পন্ন হত? শুধু তাই নয়, বরং প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ পর্যন্ত মুখতারের বিপক্ষে অবস্থান নেন। আমাদের মুখ লুকোবার কোন জায়গা থাকে না - ধরনী কেন দ্বিধা হয় না। এমন কি মুখতার নাকি কোন এক পর্নো প্রমোটারদের কাছ থেকে স্বীকৃতি নিয়েছিলেন - সেরকম আলোচনাও দেখেছি অন্তর্জালে। অথচ যে আলোচনাটি চলতে পারত তা হল, কেন একটি মুসলিম দেশে অধিকার হারানো এক মেয়ের প্রতি সুবিচার হতে পারে না।
যতদিন না আমরা আমাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে সচেতন হব, ততদিন পাশ্চাত্যে আমাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখোমুখি হবেই।
সবাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৭:২৮