আমি নিন্মমধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। একমাত্র সন্তান বিধায় আর দশটা সাধারন মানুষের মত আমার বাবা-মায়েরও আজন্ম লালিত স্বপ্ন; আমিই তাদের সমস্ত দায়ভার গ্রহন করবো। এই মর্মে তারা আমার শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থা করলেন।
স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল; উপরে দোচালা টিন, নিচে সিমেন্টের বদলে মাটি দিয়ে গাঁথা ইটের দেয়াল। পাড়ার অন্যান্য ছেলে মেয়েরা যখন খেলাধুলা করতো আমি তখন মাসিক পঞ্চাশ টাকা ফি দিয়ে গ্রামের নিন্মবিত্ত ঘরের দশম শ্রেণী পড়ুয়া শিক্ষকের কাছে অংক শিখতাম । তাই ঘুড়ি উড়ানো, মাঠে দৌড়ানো, গাছে উঠা আর হয়ে উঠে নি। ফলে পড়াশোনা ছাড়া অন্যান্য দিক দিয়ে সমবয়সী সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকতাম।
মার্চ মাসে যখন স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় সবাই কমবেশি পুরষ্কার পায় সেসময় প্রতিযোগীতায় নাম লেখানোরও সাহস হয়নি কখনও। এতকিছুর পরও সবার সুদৃষ্টিতে থাকতাম প্রত্যেক শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার সুবাদে।
দিনে দিনে দিন ফুরোতে লাগল; প্রাইমারী ছেড়ে হাইস্কুলে উঠলাম। মনে মনে ভাবলাম অনেক বড় হয়ে গেছি। একটা ঘটনা মনে আছে; ক্লাস সিক্সের প্রথম উদ্বোধনী ক্লাশে ইংরেজীর স্যার জিজ্ঞেস করলেন: "আমি ছাগল চরাই" এই বাক্যটা ইংরেজীতে কি হবে কে বলতে পারবে? জানা থাকা স্বত্তেও সবাই যখন আধো লজ্ঝা-আধো ভয়ে বসে আছি; এমন সময় একজন সটান দাঁড়িয়ে বলল; " স্যার I am a goat"
অট্রহাসিতে স্যার সহ পুরো ক্লাস ফেটে পড়লো। তখন বুঝিনি সেদিনই হয়তো ছাগল হওয়ার বীজমন্ত্র গেঁথে গিয়েছিল। আর স্যারও বুঝেন নি যে তিনি আসলেই ছাগল চরান।



সুবোধ মেধাবী বালক হিসেবে সুখে-দুঃখে দিন কেটে যেতে লাগল। ১ম স্থান অধিকার করে ক্লাস নাইনে উঠলাম। মনের পালে লাগল রঙ্গীন হাওয়া। সমবয়সী মেয়েদের দেখে ভাল লাগতে শুরু করল। কারো চুল ভালো লাগে-কারো মুখ ভালো লাগে, কারো বা চরিত্রের গঠ্ন।
এদিকে দেখি ক্লাসের কমবেশী সবাই প্রথম উড়াল দেওয়া শুরু করেছে। খেলাধুলার মত এ সাবজেক্টেও পেছনের সারিতে পড়ে গেলাম। ক্লাসের এক মেয়ে এবং এক ছেলে সবসময় চুপচাপ থাকতো। ইতি উতি তাকানো, ঠোটের কোণে মৃদু হাসি কোনটাই তাদের মধ্যে দেখা যেত না। সবাই বলাবলি করতো এরা ভাল রেজাল্ট ছা্ড়া কিছুই করতে পারেনা। বিভিন্ন ধরনের ব্যঙ্-বিদ্রুপ করতেও ছাড়তো না। মনের মধ্যে সব সময় যাতনা বোধ করতাম। সবাই যখন কল্পিত প্রেমে বিভোর

এরই ধারাবাহিকতায় একদিন এক বন্ধু বলে ফেলল, যারা প্রেমে সফল হয়না তাদের জীবনে কিছুই হয়না।
জানতাম যে কথাটা সে আমাকে উত্তেজিত করার জন্যই বলেছে। কিন্তু কান আর কতদিন শুনতে চায় তাছাড়া মনও তো একটু একটু সায় দিচ্ছে। "ঠিক আছে প্রেম করেই তোকে দেখাব। কিন্তু কি বাজি ধরবি বল?" বললাম তাকে । "এককেজি মিষ্টি আর সময় ১৫দিন" বন্ধু উত্তর দিল। সবাই তো মোটামুটি এনগেজড; কাকে টার্গেট করা যায়? বিপদে পড়ে গেলাম। হেরে গেলে এক কেজি মিষ্টি + প্রেষ্টিজ আরো বেশী পাংচার।
উদ্ধার করলো সেই বন্ধূটিই; সেই দেখিয়ে দিলে সেই মেয়েটিকে যে ভদ্র আর লাজুক হিসেবে সবার সমীহ আর শ্রদ্ধা আদায় করে চুপচাপ বসে থাকতো। সবাই বলাবলি করত ওর সাথে রিলেশন করা অসম্ভব কারণ দু একজন সে চেষ্টায় বিফল মনোরথ হয়ে পুরো ক্লাসে তাকে ইনএ্যাকটিভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ।
সূর্যালোকে ঘোর আমাবস্যা দেখা শুরু করলাম। একে তো ছিলাম অন্তর্মুখী বোকা সোকা টাইপের তার উপর আবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটাই আমার ঘাড়ে।চ্যালেঞ্জে আমায় জিততেই হবে।পর্যবেক্ষণ শুরু করলাম মেয়েটির কথাবার্তা হাটাচলা সমস্ত কিছুর উপর। যতই দেখি ততই মুগ্ধ হতে থাকি । ৭ দিন চলে গেল; তার লাজুকতা আর ভদ্রতায় মন আমার চ্যালেঞ্জ জেতার চেয়ে প্রেমে পড়ার উপক্রম শুরু করল। এভাবেই আরো ৩টা দিন কেটে গেল। কি করি কি করি টেনশনে বাঁচিনা...........
আর মাত্র ৪ দিন..............
ক্লাসের এক উপকারী মেয়ের হাতে দিলাম ছোট্র এক চিরকুট: "তুমি কি আমার সারা জীবনের একমাত্র বন্ধু হবে?"
পৌছিয়ে দিতে বললাম তার কাছে।
সেদিন গেল । কোন ভাবান্তর দেখলাম না তার মাঝে। মনের মাঝে অনেক দুঃচিন্তা। যতটা না হারার ভয় তার চেয়ে বেশী যদি মেয়েটি না করে? তার সামনে দাঁড়াবো কি ভাবে।
পরের দিনও গেল............
নো রিএ্যাকশন

আর মাত্র একদিন বাঁকী............ ফেব্রুয়ারী,১৪ ২০০০।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,

"বন্ধূ কখনও ভুলোনা আমায়।" চারটি শব্দের ছোট্র একটুকরো কাগজ যখন হাতে এসে পৌছালো মনে হতে থাকলো আমি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সেদিনের সেই চারটি শব্দের একটুকরো কাগজ যে প্রশান্তি আর আনন্দ এনে দিয়েছিল আজ পর্যন্ত কত জায়গায় ঘুরেছি, কত মানুষের সাথে পরিচয়, কত হাসি ঠাট্রা, কিন্তু সেই সুখ আর কোন দিন পাইনি।
বন্ধূকে চিরকুট দেখালাম । অতি মনোকষ্ট নিয়ে সে মিষ্টি খা্ওয়ালো।আমারও শুরু হয়ে গেল চোখাচোখি ইতিউতি তাকানোর জীবন।এতক্ষন তো অনেক বার "মেয়েটি" বলে সম্মোধন করলাম। এবার একটি নাম দেওয়া যাক। কি নাম দেওয়া যায়? আচ্ছা নাম দিলাম "অপরাজিতা"। এনামেই তাকে আমি চিঠিতে সম্বোধন করতাম। গ্রামের এলাকায় তো আর টেলিফোন থাকেনা আর সেল ফোন তখন কল্পনার বস্তু।
চিঠিতেই জীবনের সব প্লান পাশ হতো। কতটুকু ঘুমাব কখন উঠবো। সন্ধা কয়টায় বাসায় ফিরবো । সবকিছুই সে চিঠিতে ঠিক করে দিত। অনেকটা এমন যে, আমার উপর তার পুরো অধিকার জন্ম নিয়েছে। দুজনে সিদ্ধান্ত নিলাম লেখাপড়া শেষ করে তারপর সবাইকে জানাবো। কিন্তু আমরা না চাইলেই কি হবে । আস্তে আস্তে পুরো ক্লাসের সবাই জেনে ফেলল আমার সেই চ্যালেঞ্জার বন্ধূটির কল্যাণে । এমনকি শিক্ষকেরাও বাদ গেলেন না।
স্কুলে ছেলে-মেয়েদের আলাদা ভাবে কথা বলার উপর কঠোরতা থাকলেও আমাদের বেলায় দেখতাম স্যারেরা কেমন জানি প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। রাস্তা ঘাটে স্যারদের সাথে দেখা হলে স্যারেরা আমার লেখাপড়ার খোঁজ খবর নেওয়ার পাশাপাশি অপরাজিতার লেখাপড়া বিষয়েও আমাকে জিজ্ঞাসা করত। তারা পরোক্ষভাবে বোঝাতে চাইতেন যে, তারা আমাদের রিলেশনটা জানেন এবং তারাও চান আমাদের আজীবন এক সাথে দেখতে।
এভাবেই ssc পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। স্কুলের টেষ্ট পরীক্ষা শেষ এবার এসএসসির জন্য প্রস্তুতি। কারো সাথে কারো দেখা নেই। এর মাঝেই সব কিছু যেমন শেষ হয় তেমন এটাও শেষ হবার দিন ঘনিয়ে এলো। হটাৎ একদিন আমার সেই বন্ধূটি যে আমাকে প্রেমের চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল, সে এসে জানালো যে, অপরাজিতা তাদেরই গ্রামের আবু হানিফ নামের এক ছেলের সাথে প্রেম করে। শুনে প্রথমেই মাথাটা ঘুরে উঠলো। এমনটা হতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না। মুহুর্তের মধ্যেই সবকিছু কেমন জানি শুন্য মনে হতে থাকল........
বন্ধূটিকে আমি অনেক বিশ্বাস করতাম। তারপরও মন মানছিল না। আমার সেই প্রথম চিরকুট বয়ে নিয়ে যাওয়া সহপাঠিনীর সাথে দেখা করলাম। তাকে বললাম সে যেন যত দ্রুত সম্ভব অপরাজিতাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসে । আমি তার সাথে জরুরী একটা বোঝা পড়া করতে চাই। পরের দিন সে আসল........
বান্ধবীটি আমাকে ডাকালো এক ছেলেকে দিয়ে আমি গেলাম।
কেমন আছ? গম্ভীরভাবে জানতে চাইলাম ।
কোন উত্তর নাই।
আবার প্রশ্ন করলাম কি ব্যাপার কি হয়েছে? কি সমস্যা?
কোন উত্তর নাই । চুপচাপ পাথর মুর্তি।
রাগে ক্ষোভে আমার ভেতরটা এমনিতেই পুড়ে যাচ্ছিল এই কয়দিন। তার উপর এই পাথর মুর্তি। কর্কষভাবে প্রশ্ন করলাম; তার আরেকটি প্রেমের বিষয়ে । কেন সে আমাকে এমন যাতনা দিল। যা আমি কখনই গ্রহণ করতে পারবো না।
কোন উত্তর নাই। সেই চুপচাপ।
মন বলল বন্ধুর কথাই ঠিক। তাছাড়া উত্তর দিবে না কেন?
রাগে-দুঃখে বের হয়ে আসলাম।
এদিকে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল; পড়াশোনা সব শিকেয় উঠেছে। রাতের পর রাত জেগে থাকি। চোখের নীচে কালি। চেহারায় আর সেই রোমিও ভাবে নেই। যে কেউ দেখলেই মনে করতো আমি অনেক অসুস্থ।
পরীক্ষার আর মাত্র ৩ দিন বাঁকী। একদিন অপরাজিতার পাশের বাসার এক ছেলে আমাকে ডেকে তাদের বাসায় নিয়ে গেল যে অপরাজিতা জরুরী ভাবে আপনাকে দেখা করতে বলেছে। আমি ছেলেটির বাসায় গিয়ে বসলাম । বাসায় কেউ ছিল না। কিছু্ক্ষণ পর অপরাজিতা আসল। চেহারা বিধস্ত চোখের নীচে কালি । মনে হয় এই কয়দিনে কত যেন বয়স বেড়ে গেছে।
আমাকে জিজ্ঞেস করল; কেমন আছো?
আমি বললাম; ভালো।
তারপর কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল অদ্ভুত ভাবে। কেমন জানি আমার মনে হচ্ছিল ও শুধু একটি বার বলুক যে বন্ধূটি যা বলেছে তা মিথ্যা। কিন্তু কোন কথাই বলল না। শুধু চোখ দিয়ে জল ঝরছিল অঝোরে। বারবার জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। কোন উত্তর দিলনা। হাত ধরলাম প্রথম বার । কোন সাড়া দিলনা। আমার ভিতরে তখন চুড়ান্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ভুলে গেলাম বন্ধূটির সতর্কবাণী। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলাম। অনেক্ষণ ছিলাম এভাবে। চোখের জলে শার্ট ভিজিয়ে দিল কিন্তু কথা বলল না। তার পর আসতে আসতে উঠে চলে গেল। একটা বারের জন্যও ফিরে তাকাল না।
এসএসসি পরী্ক্ষা দিতে চলে গেলাম শহরে। একই স্কুলে পরীক্ষার সীট পড়েছে। শুধু চোখাচোখি হতো কোন কথা হত না।
পরী্ক্ষা চলাকালীন একদিন জানলাম অপরাজিতার বিয়ের জন্য জোর তাগাদা চলছে তার বাড়ি থেকে। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল যে দিন তার তিনদিন পরে সন্ধার পূর্ব মুহুর্তে বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলাম । আমার বাড়িতে পৌছার পথিমধ্যে অপরাজিতার বাড়ি। সন্ধার পরে সে নাগাদ পৌছে দেখলাম। নানা রঙ্গের রঙ্গীন বাতি জ্বলছে। বুঝতে পারলাম আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল।
[অনেক বছর পরে জানতে পেরেছিলাম সেই বন্ধূটি অপরাজিতাকে জানিয়েছিল যে, আমি তাকে ভালবাসি নি। শুধু বাজিতে জিতে তার সাথে অভিনয় করেছি।কিন্তু আজও আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি]
তারপরের ইতিহাস সিনেমার মত;
জেলা শহরে আমার মামার মালিকানাধীন একটি বেসরকারী হাসপাতাল আছে। সেই সুবাদে সেখানে আমার মাঝে মাঝে যাতায়াত আছে। এবং অনেক অনেক ব্লাড ডোনারদের লিষ্টে আমার নামও আছে।
তো শেষ দেখা হওয়ার অনেক দিন প্রায় পাচ বছর পরে একদিন আমি সেই হাসপাতালে মামার বন্ধূদের সাথে দেখা করতে যাই। তখনি জানতে পারি যে একজন ইমার্জেন্সী রোগীর জন্য তিন ব্যাগ রক্ত লাগবে। দুই পাউন্ড রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে আর এক পাউন্ড অতীব জরুরী দরকার । কারণ গর্ভবতী রোগীটির পেটে মৃত বাচ্চা । ইমার্জেন্সী অপারেশন করতে হবে। আমাকে দেখা মাত্র হাসপাতালের পরিচালক ধরে বসলেন রক্ত দেবার জন্য। যেহেতু আগে থেকেই রক্ত দেবার অভ্যাস ছিল তাই কিছু না জেনেই ব্লাড ডোনেট করলাম এবং একটু পরেই বাড়ী চলে আসি অন্যান্য সাধারণ দিনের মতই। জানার ইচ্ছাও পোষণ করিনি যে রোগীটা কে।
বেশ কিছুদিন পরে তার ভাই একদিন পথিমধ্যে দেখা করে আমাকে তাদের বাড়ীতে বিনা কারনে দাওয়াত করে বসল। আমি কিছুই বুঝলাম না। বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করলাম । পরে শুনেছিলাম রোগীনিটা ছিল সেই অপরাজিতা। আর তারা হাসপাতালের ব্লাড ডোনারদের লগ বুক থেকে আমার নাম ঠিকানা পেয়েছিল।
এখনও তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং তাদের ফ্যামিলীর সকলেই যেখানেই আমার সাথে দেখা হোক অত্যন্ত সম্মান এবং স্নেহ পরায়নভাবে আমার সাথে কথাবার্তা বলে।
আমি এখনও বুঝিনা; তাদের সাথে কিরুপ আচরণ করা উচিত(!) ঘৃণাভরে ? নাকি আন্তরিকভাবে?
কিছুই বুঝিনা; শুধু অসীম শুন্যতা........................মহাকালের বুকে নিঃশেষ হচ্ছি প্রতিনিয়ত....।