“এই পরিচালক দিয়ে কেনো আমরা সিনেমা বানাচ্ছি যার সিনেমা মুক্তি পাবে কি পাবে না এর নিশ্চয়তা নাই । একথা শুনে প্রযোজককে আশ্বাস দিতে নিজের পারিশ্রমিক ছেড়ে দেন, যদি সিনেমা মুক্তি পায় এবং হিট হয় তাহলে পারিশ্রমিক নিবেন” ।
মাত্র পাচ হাজার টাকা নিয়ে মুম্বাই আসেন তিনি , কিছু একটা করতে হবে এই মুম্বাইয়ে এইটা-ই আপাতত মূল লক্ষ্য ছিলো । যদিও কলেজ লাইফে থাকতে ইচ্ছা ছিলো “সাইনটিস্ট” হবেন কিন্তু কলেজ লাইফ শেষ করার পর উক্ত লক্ষ্য সময়ের সাথে সাথে “ভ্রষ্ট” হয়ে যায় । Jab We Met খ্যাত ইমতিয়াজ আলী এবং জাগদীশ শার্মার সাথে তিনি মুম্বাই আসেন, তিনজন একই ভার্সিটিতে এডমিশন দেন কিন্তু ভাগ্য দেবী সহায় না হওয়ার সাথে দুই বন্ধু ভর্তি হয়ে গেলেও তিনি হতে পারেননি । ভার্সিটিতে সুযোগ না পাওয়ায় ব্যাপক দুর্ভোগে পড়ে যান, একদিকে অর্থ সংকট অন্যদিকে থাকার জায়গা না পাওয়ায় ইমতিয়াজ আলীর রুমে-ই লুকিয়ে থাকতে শুরু করলেন কিন্তু কথায় আছে কোনো কিছু-ই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, ধরা পড়ে গেলেন হোস্টেলসুপারের কাছে ।
এরপরের সিচুয়েশন আরো করুণ হয়ে উঠলো, রেল স্টেশনে রাত্রিযাপণ শুরু করে দিলেন, আর পেটকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য হোটেল বয়ের কাজ ধরলেন । কিছুদিন এই কাজ করার পর তার এক বন্ধু তাকে নিয়ে যায় থিয়েটারে, এখানে এসে কিছুটা স্বস্তি পেলেন কিন্তু মানসিক প্রশান্তির থেকে এখনও অনেক দূরে ছিলেন ।
ছোটবেলায় খুব আন-সোশ্যাল ছিলেন, কারো সাথে মিশতে চাইতেন না, কিন্তু বই পড়ার ব্যাপক নেশা ছিলো তার, এই নেশার কারণ এই না যে আমাকে জানতে হবে এর কারণ ছিলো “ইংলিশ না জানা” । ছোটবেলায় ইংলিশে খুব দুর্বল ছিলেন, যে স্কুলে পড়তেন তা ছিলো বেশ নামকরা স্কুল, সেখানকার শিক্ষার্থীরাও ছিলো অনেক হাই-প্রফাইলের, সিংহভাগ-ই কথা বলতো ইংলিশে । কিন্তু তিনি ইংলিশ না জানায় কারো সাথে মিশতে চাইতেন না । তাই সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন “বই”কে । স্কুল জীবনে-ই অনেক বড় বড় রাইটার যেমন লিও টলস্টয়, কাল মার্কস , জার্মান লেখক ফ্রান্ৎস কাফকা-এর অনেক বই পড়ে ফেলেন । পড়ার পাশাপাশি ব্যাপক লেখার হাতও ছিলো তার, তার লেখাগুলোও ছিলো অনেক বেশি হাইথ্রটের, অনেক সময় দেখা গেছে এমন কিছু লিখে ফেলেছেন যা তার ঐ বয়সে কারো মাথায় আসার কথা না, স্কুলের শিক্ষকগণ এই লেখা দেখে তার বাবা-মার কাছে নালিশ নিয়ে গেলেন, তাকেও নিষেধ করলেন এই ধরনের লেখা লিখতে । কিন্তু কোনো বাধা-ই তার কলম থামাতে পারেনি, এমনও হয়েছে স্কুল/কলেজ লাইফে রাইটিং কম্পিটিশনে বরাবর-ই প্রথম স্থান দখল করতেন। কলেজ জীবন থেকে-ই বিভিন্ন ম্যাগাজিন সহ নানান পত্র-পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত । এক সময় মাথায় ভূত চেপে বসে, ভার্সিটির রুমমেটকে নিয়ে ম্যাগাজিন বের করবেন, যার সাবজেক্ট থাকবে সমাজ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করবেন আর সেই “অন্যভাবে” হলো পর্ন ম্যাগাজিন আকারে । এরপর যখন প্রকাশকের কাছে নিয়ে যান পাবলিশ করার জন্য তখন প্রকাশক এক প্রকার ক্ষেপে মারতে উঠে যান, ঐখানে মারা যায় তাদের “পর্ন ম্যাগাজিন” বের করার স্বপ্ন ।
এরপর আবার ঐ থিয়েটার জীবন শুরু করলেন, ছোটবেলায় বই পড়ার পাশাপাশি সিনেমাও প্রচুর দেখতেন, এইটাও শুধুমাত্র দেখার জন্য দেখা আর কি । একদিন রাইটার/পরিচালক হবেন এমন কোনো চিন্তাও করেননি । থিয়েটারে অনেক নামিদামী ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচয় হয় । ঐ পরিচয় পর্যন্ত-ই । একটি বিষয় তা মধ্যে খুব বেশি পরিমানে ছিলো আর তা হলো প্রচুর খাটতে পারতেন, একে-ই পুজি করে সবার দৃষ্টিতে আসেন । এমনও হয়েছে থিয়েটারের টিকেট পর্যন্ত বিক্রি করেছেন কোনো প্রকার উৎকষ্ঠা না করে, “আমাকে এই কাজ দেয়া হয়েছে, আমাকে এই কাজ করতে হবে” এইটা-ই ছিলো মতবাদ । এমনও হয়েছে কেউ একজন তাকে বলেছে সিনেমা দেখা শুরু করে দেন, এতে থিয়েটারে জায়গা করে নিতে সুবিধা হবে, এমনিতে প্রচুর সিনেমা দেখতেন, এই দেখার মাত্র আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলেন, দশদিনে পঞ্চাশের অধিক সিনেমা দেখে ফেলেন । বাইসাইকেল থিফস এর মতো অনেক বিখ্যাত সিনেমা দেখে ফেলনে সেই সময়, যা পরবর্তীতে তাকে ব্যাপক ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে । ঐদিকে লেখা-লেখি চালিয়ে-ই যাচ্ছিলেন ।
থিয়েটারে নাটক দেখে হাতে তালি দেওয়ার দৃশ্য তাকে খুব আকৃষ্ট করতো, মনে মনে ভাবতেন তিনি কবে এমন হাতে তালি পাবেন , এই দৃশ্য কবে তার জন্য হবে । ধীরে ধীরে থিয়েটারে শক্ত অবস্থান তৈরী করে নেন । ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন বাঘা বাঘা পরিচালক,প্রযোজক আর অভিনেতাদের সাথে । তখন-ই পরিচিত হন গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর খ্যাত সারদার খান ওরফে মানোজ বাজপাই-এর সাথে ।
থিয়েটারে করতে করতে এক সময় মনে হলো আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া দরকার, শুরু করলেন স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ, এই কাজ আগেও করতেন থিয়েটারের জন্য, কিন্তু এবার একটু জোরে-শোরে শুরু করলেন । বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্টের কাজ শুরু করে দেন, এক সময় টিভি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সিনেমায় কাজ করা শুরু করলেন । কো-রাইটার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন রাম গোপাল ভার্মার SATYA সিনেমার মাধ্যমে, প্রথম সিনেমাতে-ই বাজিমাত । প্রযোজক থেকে শুরু করে সবখানে-ই “আনুরাগ কাশ্যাপ” এর গুঞ্জন । সবার প্রশংসা বাক্য তার কাজের মান আর গতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিলো । এরপর আর পেছনে তাকানো নয় ।
কিন্তু কথায় আছে বসন্ত সব সময় থাকে না, তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি । খুব “সাহস” করে নির্মান করলেন Paanch , “সাহস” করে বলতে কি জাস্ট সবাইকে দেখিয়ে দিতে যে বড় তারকা ছাড়া সিনেমা নির্মান অসম্ভব না । তখন শুধু কে কে মেনন ছাড়া কেউ-ই পরিচিত না, কে কে মেননও খুব একটা সিনেমা করেননি তখনও । কিন্তু ভাগ্যের পরিক্ষায় হেরে গেলেন, প্রথম কাজ করলেও তাও সেন্সরের খাচায় বন্দি হয়ে গেলো । তবুও হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না আনুরাগ । আবারো শুরু করলেন সিনেমা নির্মান এবারও কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সেন্সরের ছাড় পত্রের পেলো না ব্ল্যাক ফ্রাইডে । দু বছর পর ছাড় পেলো ব্ল্যাক ফ্রাইডে, এবার একটু আশার আলোর দেখা পেলেন । এরপর শুরু করলেন বলিউডের অন্যতম সেরা মিস্ট্রি-থ্রিলার আগলী-এর স্ক্রিপ্টের কাজ যা ২০১৩ সালে এসে সিনেমার পর্দায় আসে, ২০০৭ সালের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার সিনেমা “নো স্মোকিং” খুব একটা সমাদৃত হয়নি কিন্তু যারা কাজের মূল্যায়ন করতে জানে তারা ঠিক-ই বুঝতে পেরেছেন আনুরাগ কাশ্যাপ কি নির্মান করেছেন । নো স্মোকিং নির্মানের পর অনেক রিকুয়েস্ট আসতে থাকে স্ক্রিপ্টের জন্য । এক সময় এমনও গিয়েছে যখন আনুরাগ কাশ্যাপ স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছেন কিন্তু পেমেন্ট হিসেবে শুধু পেয়েছেন এক টুকরো “ধন্যবাদ । এমন অনেক সিনেমা আজো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখাচ্ছে যার রাইটার আনুরাগ কাশ্যাপ কিন্তু সিনেমার শুরুতে বা শেষে তার নামের কোনো টাইটেল নেই ।
কাজের প্রশংসা ঠিক-ই পাচ্ছিলেন কিন্তু পাচ্ছিলেন না প্রযোজকদের দেখা, পরপর তিনটি সিনেমা বাজার করতে না পারায় প্রযোজকরা একটু ভয় পাচ্ছিলেন তাকে দিয়ে পরিচালনা করানোর জন্য । এরপর বিনা পারিশ্রমিকের চুক্তি করে নির্মান করেন DEV D । এটি খুব ভালো বিজনেস করে, এবং ক্রিটিক্সদেরও পজিটিভ রিভিউ পায় । অন্যদিকে আনুরাগ কাশ্যাপকে আদর্শ মেনে অনেকে কাজ করা শুরু করে দেয় কিন্তু প্রযোজকদের তা পছন্দ না হওয়ায় তারা কাজ বন্ধ করে দেয়, সবাই ছুটে আসে আনুরাগ কাশ্যাপের কাছে, সব কিছু শুনে তাদেরকে নিয়ে একটি টিম তৈরী করেন যার না নাম AKFPL । দেব ডি-এর পর নির্মান করেন গুলাল-দ্য গার্ল ইন ইয়োলো বুটস , যার বক্স অফিসে খুব একটা সাড়া না ফেললে , আনুরাগ কাশ্যাপের জন্য পজিটিভ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে । এরপরের ইতিহাস সবার-ই জানা ।
প্রতিভার কদর তিনি সব সময় করেন, নতুনদের নিয়ে কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন, আমিত ত্রিভেদী সহ আরো অনেক প্রতিভাবান সিনেমা কলাকুশলীদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন । বর্তমান বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা “নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিক ওরফে ফায়জাল খান” তার হাত ধরে-ই বলিউডে পদার্পন করেছেন । তিনি শুধু সিনেমা লিখতে বা পরিচালনা করতেন না সাথে ভালো স্ক্রিপ্টে প্রডিউসও করতেন । দ্য লাঞ্চবক্স, শাহিদ, লুটেরা, কুইনের মত সিনেমার প্রডিউসার তিনি ।
আজকে হয়তো তার একটি কাজ নেগেটিভ রিভিউ পাচ্ছে, মানলাম কাজটি ভালো হয়নি তাই বলে কি তিনি আগের “আনুরাগ কাশ্যাপ” নেই, যার গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর, দেভ ডি, নো স্মোকিং বলিউডের টার্নিং পয়েন্ট, যিনি মাত্র তিনটি চরিত্র দিয়ে বলিউডের অন্যতম সেরা থ্রিলার সিনেমা নির্মান করেছেন তিনি আজ “বাজে পরিচালক” ট্রেড মার্কে ভূষিত । একে-ই মনে হয় বলে “যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা” যখন কোনো ভালো পরিচালকের কাজ তার আগের কাজের মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়ে যাবে তখন তিনি বাজে পরিচালক । জাস্ট গ্রো আপ ম্যান, কষ্ট করে একটু গুগল করে দেখুন বলিউডের সেরা নির্মাতার লিস্টে তাকে পেয়ে যাবেন ।
বলিউডের মোস্ট ট্যালেন্টেড সিনেমা নির্মাতার এবং স্টোরি টেলারের লিস্টে আনুরাগ কাশ্যাপের নাম সব সময় থাকবে । রাজ কুমার হীরানীর পর আমার সব’চে প্রিয় সিনেমা নির্মাতা তিনি ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:০৫