"ছোটবেলা থেকে-ই সংগীত আর ঈশ্বর ছিলো আমার ধ্যান-জ্ঞান কিন্তু বাবা কখনও চাইতেন না আমি সংগীতের পূজারী হই, সংগীত সাধনার পথে সব'চে বড় অন্তরায় হিসেবে ছিলেন আমার বাবা । ঈশ্বর আমাকে এই বাধা থেকেও মুক্ত করে দিলেন 'বাবার অকস্মাৎ প্রয়াতের মাধ্যমে' । এই ঘটনা ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিলো । কখনও কোনো নারীর হাত ধরিনি । আমার নিরলস সংগীত সাধনার মাধ্যমে আমি স্থান করে নেই ভিয়েনার সম্রাটের কোর্ট মিউজিশিয়ান হিসেবে । সৃষ্টিকর্তার দয়া-ই ছিলো এসবের কারণ । হঠাৎ একদিন ঈশ্বর মনে করলেন আমার পরিক্ষা নেওয়া উচিত , তার প্রতি আমার কতোটুকু ভালোবাসা সঞ্চিত হয়েছে তা একবার পরখ করা উচিত । পরীক্ষার মাধ্যমে হিসেবে বেছে নিলেন "সংগীত"কে । ঘটনাক্রমে একদিন ভিয়েনায় উপস্থিত হন "মোৎসার্ট" । এই 'মোৎসার্ট এমন একজন মানুষ যার উপস্থিতির মাধ্যমে আমি-ই হেরে গিয়েছিলাম ঈশ্বরের পরীক্ষায় , যার উপস্থিতির মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি । এক সময় মনে হয়েছে এই "মোৎসার্ট"-ই হয়তো ঈশ্বর, যিনি স্বয়ং নেমে এসেছেন আমাকে পরীক্ষা করার জন্য । সর্বোচ্চ পর্যায়ে ঘৃণা করতাম এই মোৎসার্টকে । আর তার মৃত্যুর প্রধান কারণ আমি " এভাবে-ই আত্মহত্যার অপচেষ্টার পর পাদ্রির কাছে কনফেস করছিলেন সালিয়েরি ।
সিনেমার নাম আমাদেউস(Amadeus ) যার প্রকৃত অর্থ "সৃষ্টিকর্তার প্রিয় পাত্র" । আর সিনেমাটি ঘিরে উঠে সালিয়েরির ঈর্ষাপরায়ণ'কে কেন্দ্র করে ।
মাত্র তিন বছর বয়স থেকে সুরের খেলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন "উলফগ্যাং আমাদিউস মোৎসার্ট" । তার পিতাও বেশ খুশি হয়ে গেলেন পুত্রের এমন কৃতি দেখে । পিয়ানোতে সুর তোলার মত কষ্ট সাধ্য কাজ রপ্ত করে তিন বছর বয়সে । পাচ বছর বয়সে নতুন সুর তৈরী করতে পারতেন আর আট বছর বয়সে বেহালায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেন । একবার শুনে-ই যেকোনো সুর হুবহু বাজাতে পারতেন । এভাবে শৈশব থেকে সুরের জগতে নিজেকে বিলিন করে দেন, নতুন কোনো কিছু তৈরীর ব্যাপার মোটেও আগে থেকে ভাবতেন না, বেহালায় নিজের জাদুকরী আঙ্গুল রাখতেন আর সৃষ্টি করে ফেলতেন নতুন সুর । প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন মোৎসার্ট । অস্ত্র দিয়ে নয় তিনি সুর দিয়ে বিশ্ব জয় করার ছক আকছিলেন নিজের মনে আর তিনি সেই যুদ্ধে জয়ীও হয়েছেন । অস্ট্রিয়ার সাজলবুর্গের ছোট্ট মোৎসার্ট এখন সকল সংগীত পিপাসুর প্রিয় ব্যক্তিত্ত্ব । মূলত তিনি ছিলেন পিয়ানোবাদক । ভিয়েনার শ্রেষ্ঠ পিয়ানোবাদক হিসেবে এখনও তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। পিয়ানোর পাশাপাশি অপেরা আর কন্সার্টো(এক ধরনের বাজনা যা অর্কেস্ট্রার মাধ্যমে এক বা একাধিক ব্যক্তিবাদক সংগীত বাজানো হয়)তেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী । মাত্র ৩৫বছর বয়সে মারা যান এই বিশ্ব বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ।
আমাদিউস সিনেমার নামকরণ করা হয় এই "উলফগ্যাং আমাদিউস মোৎসার্ট" নামানুসারে, যদিও সিনেমা গল্প ছিলো সালিয়েরি কেন্দ্রিক । যিনি মোৎসার্টকে মন থেকে সম্মান করতেন , মোৎসার্টের অবাক করা সকল কৃতি তিনি জানতেন । যেসব সুর সৃষ্টি করতে সালিয়েরির মতন সংগীত সাধকের ঘাম ছুটে যেতো সেই সুর মোৎসার্ট হেসে-খেলে পিয়ানোতে তুলে ফেলতো । যাকে ঈশ্বর সমতুল্য মনে করতেন সালিয়েরি সেই মোৎসার্টকে একদিন সালিয়েরি দেখে ফেলে নারীর সংস্পর্শে, তখন থেকে ঈশ্বরের আর সহ্য করতে পারে না সালিয়েরি । কারণ যেই মোৎসার্ট-ই ছিলো তার আর্দশ , ছোটবেলা থেকে মোৎসার্ট হতে চাইতেন সালিয়েরি, প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করতেন । সেই মোৎসার্টের এমন চরিত্র তার মনে ঘৃণার সঞ্চার করেছে । এখন সে ঈশ্বর আর মোৎসার্ট দু'জন-কেই ঘৃণা করে । ঈশ্বরকে ঘৃণা কারণ শুধুমাত্র একটি , "তিনি কেনো এমন অযোগ্য লোককে এমন প্রতিভার অধিকারী করেছে, যেখানে সে সারাজীবন শুধুমাত্র তার উপাসনা করেছে ।" এভাবে ঈর্ষাপরায়ন হয়ে উঠে সালিয়েরি । মোৎসার্টের আধ্যাত্মিক সুর যখন ভিয়েনাবাসীর অন্তরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হচ্ছিলো সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মোৎসার্টকে পরাজিত করার নকশা তৈরী করে ফেলে সালিয়েরি । আর এভাবে কৌশলে মোৎসার্টকে পরাজিত করতে থাকে তার-ই সুরকে কাজে লাগিয়ে । ধীরে ধীরে মোৎসার্ট আর্থিক সংকটে পড়ে অনেক টাকা ঋণী হয়ে যায় আর ঐদিকে সালিয়েরি হিংসার অনলে ডুবে নিজের ভেতরের প্রাণীকে জাগিয়ে তোলে ।
একটি সিনেমায় যা যা প্রয়োজন তার সবটুকু-ই ফুটে উঠছে এই সিনেমায় ।। মূলত আমাদেউস ছিলো পিটার স্যাফার রচিত একটি মঞ্চনাটক , যা পরবর্তীতে সিনেমার পর্দায় নিয়ে আসেন ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কুকুস নেস্ট খ্যাত মিলোস ফোরম্যান । মোৎসার্টের সুরলহরী সকল অভিনেতা/অভিনেত্রীদের কতোটা আবেগ সৃষ্টি করেছে তা তাদের অভিনয় ফুটে উঠেছে । সবার অভিনয়ের কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন সালিয়েরির চরিত্রকে রূপ দানকারী মারে আব্রাহাম আর মোৎসার্টের চরিত্রকে রূপ দানকারী টম হালঞ্চ । দু'জনের অভিনয় এক বাক্যে অনবদ্য । আমার সাধারণ চোখ হয়তো সমানভাবে তুলনা করে ফেলেছে দুজনের অভিনয় কিন্তু অস্কার কর্তৃপক্ষের কাছে মনে হয়েছে মারে আব্রাহাম বেশি ভালো করেছেন তাই চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা আব্রাহামের ঝুলিতে-ই স্থান পেয়েছে । আমাদেউসে প্রতিটি দিক দিয়ে সর্বোচ্চ শৈল্পিক মান রক্ষা করেছে । অভিনয়ের পরে যে ব্যাপারটি পুরো সিনেমায় অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করেছে তা হলো আলোক-সজ্জা । পুরো সিনেমা কোনোরূপ কৃত্রিম আলোর ব্যবহার করা হয়নি । যেসব দৃশ্যে আমরা আলোর ব্যবহার দেখতে পেয়েছি তা পুরোটা-ই ছিলো "মোমবাতির" আলো । পুরো সিনেমাটিতে আলোক-সজ্জার গুরু-দ্বায়িত্ব পালন করেছে "মোমবাতি' । যদিও এই কৌশল সর্বপ্রথম ১৯৭৫ সালে স্ট্যানলী কিউব্রিক দেখিয়ে দিয়েছেন তার "ব্যারি লিন্ডন" সিনেমায়, সেখানে কিউব্রিক এই প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য নতুন এক প্রকারের লেন্স তৈরী করিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে মোমবাতির আলোয় দৃশ্যগুলো হয়ে উঠেছিলো আরো বেশি প্রায়বন্ত ।
পুরো সিনেমা মূল ভিত্তি ছিলো "আবহ সংগীত" । এতো অসাধারণ আবহ সংগীর খুব কম সিনেমাতে-ই শোনা যায় ।
মোৎসার্ট আর সালিয়েরির মাধ্যমে পরিচালক মিলোস ফোরম্যান আমাদেরকে আরো একটি ব্যাপার দেখানোর চেষ্টা করেছেন আর তা হলো "মেধার মূল্যায়ণ" । মেধার মূল্যায়ণ একদিন না একদিন হবে-ই যা মোৎসার্ট চরিত্রের মাধ্যমে আমাদের দেখানো হয়েছে । জীবিতাবস্থায় হয়তো মেধার মূল্য পাননি কিন্তু তার মৃত্যুর এতো বছর পর এখন সবাই তার সৃষ্টির গুণ-কীর্তন করছে ।
আমার দেখা সেরা সিনেমার একটি এই "আমাদেউস' । তিন ঘন্টার সিনেমায় এক মূহুর্তের জন্য বিরক্ত লাগেনি । মোৎসার্টের সুর আর সালিয়েরির অভিনয় দেখতে দেখতে কখন সিনেমা শেষ হয়ে গেছে টের-ই পাইনি ।
আমাদেউস হলো প্রতিভা-প্রতিহিংসার প্রয়াতের প্রতিচ্ছবি ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৭