বার বার ব্যর্থতায় ক্ষোভ আর হতাশায় একাকার হয়ে সেদিন ও ক্লাসে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করল। স্যারের বক্তৃতা যখন একটুও কানে ডুকছিল না, শুধু এমনি এমনি তাকিয়ে ছিল বোর্ডের দিকে, হুট করেই খেয়াল হয় ওটার কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। ওটা ঠিক আগের জায়গায় নেই যেন। অথবা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে ও যেন আগের জায়গাতে নেই, অন্য কোথাও সরে পরেছে বেমালুম। একটু পরই আবার সব ঠিক হয়ে আসে। তখন মুখ ঘুরিয়ে বায়ে তাকাতেই অদূরে শান্তার দিকে চোখ পরে। ও আচ্ছা, ওর দৃষ্টিপথ তাহলে ওইদিক থেকে ছিল এতক্ষণ। আমি তাহলে এটাও পারি! নিজের এমন বিবর্তনে মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করে ও।
কিভাবে এমনটা হল ও নিজেও তা বলতে পারবে না, কখন থেকে তাও না। শুধু মনে আছে খুব ছোট থেকেই আসেপাশের মানুষগুলোকে ও যেন বেশ বুঝতে পারত। যেমন মোতালেব চাচার অমায়িক ব্যবহারের পরেও লোকটাকে ওর কোনদিনও ভালো লাগেনি। মুদি দোকানের কালোমত লোকটার মনে অনেক দুঃখ। চারুকলায় পরা ওই ভাইয়াটা বিশাল প্যাচে পরেছে। আর বেসরকারী এক অফিসের এমডি আলম সাহেব যে তার মেয়েবন্ধুকে খুন করার পরিকল্পণা আটছে, এটা ও ছাড়া আর কেউ জানে না।
প্রথম প্রথম ওর মনে হত সবাই ওর মত বোধহয়। কিন্তু অভিজ্ঞতায় জেনেছে এটা ঠিক স্বাভাবিক না, এটা এমন কিছু যা একান্তই ওর নিজের। অন্য কারো এমন ক্ষমতা নেই।
তবে অনেকটা অসতর্কতার কারণেই জীবনের প্রথম একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। শুরুটা ছিল সেই ছোট ক্লাসে থাকতে। ওর বয়সী এক ছেলে যাকে তাকে গিয়ে প্রশ্ন করে, - মনে মনে একটা সংখ্যা ধর তো! তারপর সেইটাকে বিভিন্ন উপায়ে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের পর কত থাকে, সেইটা ও অবলীলায় বলে দিচ্ছে। সময়ে সেটা এক অদ্ভূত খেলায় পরিণত হয়, আর সবাই সেই ছেলেটির প্রতীভায় বিস্ময়াভিভূত না হয়ে পারে না। কিভাবে একেবারে সঠিক সংখ্যাটা মিলে যাচ্ছে, সেই রহস্যের তল খুজে পায় না কেউ। অল্প বয়সী সেই বাচ্চা ছেলেগুলোর কাছে এ যেন এক মস্ত জাদু।
অথচ ছেলেটির ট্রিক বুঝতে এক মিনিটও লাগে না ওর। আর বুঝতে পারার পর ছেলেটির প্রতি ওর তীব্র ঘৃণা হয়। এটা তো নির্ঘাত জোচ্চুরী। কি সহজেই না সবাইকে বোকা বানিয়ে চলেছে ওই বদমাইস বানরমুখো ছেলেটা! দেখলেই মনে হয় ওই থ্যাবড়া মুখে চটাশ করে একটা চড় বসিয়ে দিতে পারলে মনটা শান্ত হত। গোপনে এই কথাটা অন্যদের জানাতেও ভুল করে না ও, কিন্তু কেউ ওর কথায় সায় দেয় না, সবার কাছে ছেলেটা যেন হিরো হয়ে বসে আছে।
শেষে একদিন রেগেমেগে বলে বসল, - এত যখন পারোস, পারলে আমি মনে মনে কি ধরছি সেইটা ক তো?
এ কথায় ছেলেটি আর ওর চেলারা ঠিক দমে না। অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটির পর এক সময় ওকেই চেলেঞ্জ করে বসে, - পারলে তুই ক তো !!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একসময় ও ঠিক ঠিক জবাব দেয়। কে মনে মনে কোন সংখ্যা ভেবে নিয়েছে তার সবটাই বলে দেয়। কিশোর বয়সী আবেগে ওরা ওকে হেসে প্রায় তুরি মেরে উড়িয়ে দিলেও মনে মনে সবাই অবাক না হয়ে পারে না। কারণ ওরা জানে ও একবারও ভুল অনুমান করেনি। কিভাবে এটা সম্ভব হল ভেবে পায় না ওরা। হেসে উড়িয়ে দিলে কি হবে, শীঘ্রই এ খবরটা রটে যায় সবার কাছে।
প্রতিদিনই কেউ না কেউ ওকে যাচাই করতে আসে, এবং বিস্ময় নিয়ে ফিরে যায়। যেমন একজন ধরেছিল ২৫৯৪১০, যা ও কোন কিছু না ভেবেই ঠিক ঠিক বলে দিয়েছে। সবচেয়ে জ্ঞানী বলে পরিচিত ছেলেটি কোথা থেকে যেন পাই-য়ের মান জেনে এসেছিল। সেটাও ও ঠিক ঠিক বলে দেয়, ৩.১৪! শুরুতে এটা নিছক খেলাই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। ওই ছেলেটি আর তার চেলারা ক্ষেপে যায়। আর সবাই উদ্গ্রিব হয়ে পরে ওর ট্রিক বোঝার জন্য। কিন্তু এই কথা কি আর কাউকে বলা যায়? আর বললেও কি কেউ বিশ্বাস করবে?
কিন্তু অবস্থা আরো খারাপ হয় যখন ওকে জব্দ করার অতি গোপনীয় ভয়াবহ পরিকল্পণাটি ভেস্তে দিয়ে উলটো ওদের বিপদে ফেলে দেয়। অথচ এটা ওর জানার কথা না, এমন না যে কেউ একজন সেটা ওর কাছে ফাস করে দিয়েছে, তবু কিভাবে বুঝে ফেলে সেটা একটা রহস্য। সন্দেহ থাকে না আর কারো যে ওর ভিতর অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে এবং সবাই এক রকম ভয় করতে শুরু করে ওকে। কাছে ঘেষে না কেউ, শুধু ক্লাস বাদে সময়টুকু ওর থেকে দূরে দূরে থাকে। সবার চোখে ও হয়ে উঠে কোন রূপকথার ভিলেন, নানা রকম গুজব রটতে থাকে ওর নামে। অল্পদিনেই ও একেবারেই বন্ধুহীন, নিঃসঙ্গ হয়ে পরে।
তখন শুধু পিতার বদলী হওয়া সুবাদে নতুন স্কুলে ভর্তির পর হাফ ছেড়ে বাঁচে ও। এইবার ও সতর্ক হয়ে পরে। কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না, একজন আঁচ করতে পারলেই শেষ। শত্রু-মিত্র সবার অতিগোপনীয় ব্যাপারগুলো জেনে ফেলার পরও চুপ থাকতে হয় ওর। একবার প্রকাশ হয়ে পরলেই আবার আগের অবস্থায় পরতে হবে। কিন্তু তারপরও ভুল একটা হয়েই যায়।
সেদিন সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষা, কিন্তু পড়া হয়নি কিছুই ভালোমত। প্রশ্ন কমন পাচ্ছে না বা উত্তর গেছে ভুলে। কি করা? শেষে একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি ওর কয়েক বেঞ্চ আগে বসেছে। একবার ওর দিকে পিছন থেকে তাকায়, নিবিষ্ট মনে চেয়ে দেখে, তারপর হঠাৎ ওর মাথায় টুপ করে ডুকে পরে ও। মুহুর্তেই পড়ে ফেলে মনে মনে কি ভাবছে ছেলেটা। প্রশ্নের উত্তর যা চিন্তা করছিল, সেটা পুরোটাই পড়ে ফেলে স্পষ্টভাবে। তারপর পুরোটাই হুবহু ওর খাতায় লিখতে থাকে। ব্যস, এক নং-এর উত্তর শেষ, এবার পরের প্রশ্ন। কে লিখছে? হ্যা, উমুক ছেলেটা, উত্তর যা ভাবছে তা ওর মাথা থেকে পড়ে নিয়ে লিখে ফেলে খাতায়। এভাবে অন্যের ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়ে কিছু না পেরেও খাতা ভরিয়ে দিয়ে আসে।
মনে মনে ভাবল, এ তো ভারি মজা! এবার থেকে আর কোনকিছু পড়ার দরকার পরবে না, এমনি এমনি লিখে ফেলতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হল, সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষায় ওর উত্তরগুলো যে কয়েকজনের সাথে একেবারে দাড়ি-কমা সহ মিলে গেছে, যেভাবেই হোক সেটা স্যারের নজর এড়ায় নি। স্যার মুখে কিছুই বলে নি, কিন্তু খাতা দেখানোর সময় তিনি কি ভাবছিলেন, সেটা ধরতে পেরেই ওর ভুলটা চোখে পরে। হয়তো তেমন কিছুই না, স্যার ঘূর্ণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারবে না আদপে কি ছিল ব্যাপারটা। হয়তো ভাববে একজন আরেকজনের খাতা দেখে লিখেছে, নম্বর কিছু কমিয়ে দেবে। তবু আরো সাবধান হওয়া ভালো। স্যার যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে কে কার খাতা দেখে লিখেছে তবে সবাই অবাক হবে বই কি!
এরপর থেকে পরীক্ষায় ও একইভাবে অন্যের খাতা কপি করতে শুরু করে, তবে পুরোপুরি না। একটু এদিক-সেদিক করে লেখে যেন সমাজ স্যারের মত কেউ বিব্রত না হয়। তারপরও সবাই ভেবে অবাক হয় ও এত ভালো রেজাল্ট করছে কিভাবে, এমনকি ওর মা-বাবাও। ওকে কেউ পড়তেই দেখে না তেমন, বরং অন্য সব কাজেই ব্যস্ত থাকে ও বেশি। তবুও এমন হয় কিভাবে? এ কারণেই রেজাল্ট যেন খুব বেশি ভালো না হয় তার জন্য একটু না একটু ফাক রেখে দেয় ও। আরো একটা বড় কারণ আছে, সেটা হল ও ভালো ছাত্র হতে চায় না।
ও শুধু চায় ঘুরে বেড়াতে, পাখির মত। আর মানুষ দেখে বেড়ায়। নানা রঙের মানুষ। আর ইচ্ছে হলে ডুব দেয় তাদের মনের ভিতর আর নিমেষেই পড়ে ফেলে সবটা। কত বিচিত্র মানুষের চিন্তাধারা, একের সাথে অন্যের মিল নেই, যেমন মিল নেই চেহারায়, গলার স্বরে। ধীরে ধীরে এটা এক রকম শখে পরিণত হয়। কোন একটা জনাকীর্ন পার্ক, রেস্তরা, শপিং কমপ্লেক্সে চুপচাপ বসে বসে মানুষের ভাবনাগুলো পড়তে। প্রতিবারই মনে হয় যেন এক অতল সাগরে ডুব দিয়েছে ও, অজস্র জলজ প্রাণীর সাতড়ে যাবার মত মানুষের ভাবনার স্রোত কোন তীরে ভাঙ্গে না কোনদিন, আকাশের অসীম গতিবিধি তার।
এমনি চলছিল একাকী নিরুদ্বেগ। কিন্তু একটা সময় যেন ছন্দপতন ঘটে।
সেদিনও ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে মানুষের চিন্তাগুলো পড়ে নিচ্ছিল অন্যদিনের মতই। কারো দিকে তেমন তাকায় না, প্রয়োজনও পরে না খুব একটা। কিন্তু হঠাৎ একটা টেবিলের দিকে চোখ পরে যায়। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে টেবিলে বসা ছেলে-মেয়েগুলোর ভিতর লাল জামা পরা মেয়েটির দিকে। তারপর চারদিক যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়, মানুষের ভাবনাগুলো থমকে যায়, সময় যেন থেমে যায় কিছু না বলেই, ডান টেবিলের ছেলেটার চায়ে চুমুক দেবার পর গরম বোধ করা যা চিনি কম হওয়া কিছুই মনে হয় না, কাউন্টারের মামাও আর বিরক্ত হয় না, আর আকাশের কোন দৈত্য রিমোট কন্ট্রল টিপে হৈ-হল্লারত ছেলেপিলেদের মিউট করে দেয়।
এই প্রথম কোন মেয়েকে দেখে ও চোখ ফেরাতে পারে না আর একটা অন্য রকম ভালোলাগাবোধ কাজ করতে থাকে। যদিও ও মেয়েদের এড়িয়েই চলে, কারণ মেয়েদের যত উদ্ভট এবং জটিল চিন্তার জালে আটকা পরে বার বার খাবি খাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে ওর। মেয়েদের ভাবনা-চিন্তা ওর কাছে এক গোলকধাধার মত মনে হয় যার ডোকার বা বের হবার পথ নেই। তবু আজ ওর ইচ্ছে হল মেয়েটির সাথে একটু কথা বলতে, নইলে যেন জীবন্টা বৃথা হয়ে যায়। কিন্তু অর বন্ধু-বান্ধবীদের সামনে গিয়ে নিশ্চই বলা যাবে না, আগে তাকে একা পেতে হবে। কিন্তু কি বলবে? জীবনে এই প্রথম ওর দিশেহারা অনুভূতি হয়।
এক সময় ওরা টেবিল থেকে উঠে পরলে পর ও পিছু নেয়। তবে এমনভাবে যে কেউ টের পায় না। ওদের গতিবিধি দেখে বুঝে নেয় কোথায় যাচ্ছে, তারপর ঘুর পথে সেখানে যায়। এক সময় মেয়েটা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। এইবার আর চিন্তা থাকে না। ওর পিছু পিছু বাস স্টেন্ডেই চলে আসে। এইবার কথা বলতেই হবে, নিজেকে প্রস্তুত করে ও। কিন্তু কি বলবে? তার সমাধানও আছে, শুধু মেয়েটা কি ভাবছে সেটা বুঝে নিয়ে কথা চালু করা যাবে। আপাতত সেইদিকেই মনোযোগ দেয়। এখনি মেয়েটির মাথার ভিতর ডুকে পরবে ও, অনুমতি ছাড়া, হিহি!
এবং তখনি ব্যাপারটা খেয়াল করে। দেখে মেয়েটির মাথা পুরোপুরি শূণ্য, কিছুই ভাবে না। এর মানে কি? আরেকবার চেষ্টা করে। কাজ হয় না, কিছুই নেই পড়ার মত, ঠিক যেন খালি পৃষ্ঠা। এমন তো হবার কথা নয়। ও কি ওর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল? না তো, বাকি সবার তো দিব্যি পড়া যাচ্ছে, শুধু মেয়েটার... চকিতেই ব্যাপারটা বুঝে নেয়। যেকারণেই হোক, সবার চিন্তা-ভাবনা যেমন পড়তে পারার ওর ক্ষমতা এই মেয়েটির উপর কাজ করছে না। আর এতেই জিদ চেপে যায়, মনের সকল শক্তি দিয়ে চেষ্টা চালায় তবু পারে না। আর এই করতে করতেই এক সময় মেয়েটা বাসে উঠে পরে।
একেবারেই আহাম্মক বনে যায় ও। এমন তো কখনো হয়নি। সেই কৈশর থেকে এমন কাউকে পায়নি ও যার মনের কথা চাইলেই পড়ে ফেলা যাচ্ছে না। জীবনে প্রথমবার নিজেকে এতটা ব্যর্থ মনে হয় ওর।
মেয়েটা সম্পর্কে খোজ খবর নিতে শুরু করে ও। নাজিয়া মেয়েটির নাম, ওদের জুনিয়র। এরকম আরো অনেক তথ্য বের করতে ওর সময় লাগে না। যদিও কাউকে জিজ্ঞেস করেনি, ওর কাজ তো মানুষের মন নিয়ে। এর ওর মাথা ঘেটে বের করে ফেলে নিমেষেই। এমনকি নাজিয়ার এক বান্ধবীর মাধ্যমে মোবাইল নম্বরটাও জেনে ফেলে। কিন্তু অনেক ভেবেও সাহস করে কোনদিন ফোন দেয়া হয়নি। ইচ্ছে ছিল মেয়েটির মনের কথা আগে জেনে নিবে, কিন্তু তা আর হয় না। ওই দিনের পর অনেকবার মেয়েটাকে দেখেছে ও, কিন্তু প্রতিবারই কোন বিচিত্র কারণে মেয়েটির মাথায় ডুকতে পারে না বা ওর চিন্তাগুলো ধরতে পারে না।
তাই হতাশায় আর রাগে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে একদিন ক্লাসে আবিষ্কার করে ও এখন শুধু মানুষের চিন্তাগুলো নয়, কে চোখ দিয়ে কি দেখছে সেটাও বুঝতে পারে। যেমন শান্তা হা করে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে কি দেখছিল সেটা এক পলক দেখার সুযোগ হয় ওর সেদিন। এরপর শুধু চোখের দৃষ্টি নয়, ধীরে ধীরে পঞ্চইন্দ্রয়ের উপর ওর দখল আসতে শুরু করে। ওর ক্ষমতা যেন আরো বেশি বিস্তৃত হয় দিন দিন।
এখন শুধু মানুষের ভাবনা নয়, অনুভূতিগুলোও বুঝতে পারে ও। যেমন কেউ আঘাত পেলে তার বেদনাটা ঠিক ঠিক ধরতে পারে ও। কারো আনন্দ অনুভূতি বুঝতে পারে। ছোট ভাই যেদিন জ্বরের ঘোরে কাতড়াচ্ছিল, সেটাও পরখ করে দেখেছে। আর বুঝেছে পাশের বাড়ির আন্টি খুব অভিনয় করতে পারে। প্রখর রোদে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টটা ওর মত আর কেউ বুঝবে না। আর বুঝবে না মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন যেমনটা এক্সিডেন্টে মারা যাওয়া এক মানুষের বেলায় দেখেছে, এক বারের পর আর ইচ্ছে হয়নি সেই ভয়ানক কষ্ট আবার পরখ করে দেখার। এক সময় ও একটা খেলা আবিস্কার করে। যাকে তাকে চিমটি দিয়ে বা সূক্ষ্ণ কিছু ফুটিয়ে পরখ করে তাদের কেমন লাগে, কতটা দিলে কতটা ব্যথা পাওয়া যায়। এইটা করতে গিয়ে অনেকবার ধমক খেতে হয়েছে ওকে। আবার ইচ্ছে করে কাউকে খারাপ কথা বলে দেখেছে ওদের কেমন লাগে বোঝার জন্য। অবাক হয়ে খেয়াল করে গালাগালি শুনে অনেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও মনে মনে খুশি হয়। এ এক নতুন অবিস্কার ওর জন্য।
এমনি করে এক বিপুল জগৎ ওর কাছে উন্মোচিত হতে শুরু করে দিন দিন। ওর আসেপাশের মানুষগুলোর খাবারের স্বাদ নেয়াটাও ওর নজর এড়ায় না। ও সব জানে। রাজপথ থেকে বেডরুম, সব। রুমানা ম্যাম ক্লাসের দুই ক্রিকেটারকে খুব জ্বালাতন করলেও মনে মনে যে তাদের স্নেহ করেন এটা শুধু ও জানে। বাড়িতে ঝগড়া করে এসে সুবোধ স্যারের মেজাজ যে খারাপ, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না, সেটা শুধু ও জানে। পাশের বাড়ির আন্টি এলাকার এক ভাইকে দিয়ে কি করিয়ে বেড়ায়, এটা ও শুধু জেনেই ক্ষান্ত হয় না, মাঝে মাঝে ওদের চরম অবস্থাটুকুও ভাগাভাগি করে নেয়। ক্লাসের টোনাটুনি নামে খ্যাত এক যুগলের সম্পর্ক যে আসলে ভালো যাচ্ছে না, এটাও কেউ ঘূর্ণাক্ষরে সন্দেহ করে না। মাঝে মাঝে শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে হলে ছোট শিশুদের দেখে, আর বয়স্ক মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা বোঝার চেষ্টা করে অবাক হয়ে দেখে সেখানে বোঝার কিছুই নাই, শৈশব আর বার্ধক্য দুইটিই অর্থহীন রকমের সাদামাটা।
কি নেই ওর? সবকিছুই ওর জানা। এই পৃথিবী জুড়ে ওর মত জ্ঞানী আর কেউ নেই, কেউ নেই। নিজেকে আর মানুষ না, অন্য কিছু মনে হতে থাকে ওর। বিশাল, বিস্তৃত, দানবীয়, অসীম, ঠিক যেন আকাশটার মত। হ্যা, ও হল আকাশ, দিগন্তজোড়া বিস্তৃত এক আকাশ যা কেউ কোনদিন ছুতে পারেনি পারবেও না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, - ওই নীল আকাশটাই আমি!
আর ঠিক তখনই আবার চোখ পরে মেয়েটির দিকে। সিড়িতে ওর ঠিক পাশ কাটিয়ে চলে যায় নাজিয়া। আর মুহুর্তে একরাশ পারফিউমের মাদকতাময় সুবাস ছড়িয়ে যায় চারপাশে, যেন এখনি একটা ভ্রমরা উড়ে এল হঠাৎ, যেন এটা পারফিউম নয়, ওর নিজেরই গন্ধ। নিমেষেই সব ভুলে যায় ও, মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখে, আর মনে মনে প্রার্থনা করে নাজিয়া যেন একটা বার ফিরে তাকায়। কিন্তু তা আর হয় না। তখন ভাবতে বসে, পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার তাকিয়ে ছিল কি? হয়তো, হয়তো বা না। এমনি ভাবতে ভাবতে খেয়াল হয় আজো মেয়েটার মনের ভিতর ডুকতে পারেনি। কি ভাবছে সে, কিছুই জানা যায় না। এই একটা জায়গাতেই আটকে যেতে হয় বার বার। আর তখনি ক্ষোভ-হতাশায় একাকার হয়ে ওঠে। এতক্ষণের ভালোলাগাটুকু আর থাকে না।
একদিন রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গে ওর। স্বপ্নে দেখে ও আর আগের মত নেই, আর মানুষের মন পড়তে পারছে না। তখন মানুষগুলোকে বড় অচেনা লাগতে শুরু করে, মনে হয় যেন কোন ভীনগ্রহ থেকে উঠে এসেছে তারা যাদের সম্পর্কে ও কিছুই জানে না। বিশাল পৃথিবীর বুকে তখন নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হতে থাকে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অন্যের চিন্তার উপর নির্ভর করে চলতে হয়েছে ওকে, সেই কৈশর থেকেই। হঠাৎ করেই যেন সব হারিয়ে অতল সাগরে পরে গেল, কি করবে কিভাবে করবে কিছুই জানে না। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারছে না কারণ এতে অভ্যস্ত না ও। জানে না কি করে মানুষের সাথে কথা শুরু করতে হয়! স্বপ্নটা এতই বাস্তব ছিল যে ঘুম ভাঙ্গার পরও স্বাভাবিক হতে সময় লাগে ওর।
আর সেদিনই ও প্রথম অনুভব করতে পারে যে ও কত একা। এই জীবনে কারো সাথে গভীরভাবে মিশতে পারেনি। আর পারবেই বা কি করে? মানুষের মনের ভিতর যেই কুটিল জালের বিস্তার, তাকে এড়াবে কি করে? অভিজ্ঞতায় জেনেছে, প্রতিটি মানুষ মুখে ভদ্রলোকের মুখোশ এটে রাখলেও ভিতরটা তাদের কত নোংরা! এমনকি ওর দেখা সবচেয়ে ভালো ছেলেটার মনেও মাঝে মাঝে এমন বদ চিন্তা আসে যা তাকে ঘৃণা করার জন্য যথেষ্ট। কিভাবে তাদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ চালিয়ে যেতে পারবে ও?
মনে মনে ভাবে, - আমার এই ক্ষমতা না থাকলেই ভালো ছিল। নিষ্ঠুর পৃথিবীর অনেকটাই ঢাকা পরত তাতে। একটা সাধারণ মানুষের মতই আমার জীবনটা হতে পারত।
জীবনে প্রথম এরকম একটা তীব্র ইচ্ছে হল ওর। স্রষ্টার কাছে মিনতি জানালো, চিৎকার করে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হল, - কেন? কেন হে খোদা! আমিই কেন এমন হলাম? কেন কেন কেন? বরাবরের মতই নিরব বিধাতা।
এই যখন অবস্থা, তখন আরেক বিপত্তি এসে হানা দেয়। ও খেয়াল করে সবাই ওর বিরুদ্ধে জোট পাকাচ্ছে। একটা বৃত্ত গড়ে উঠছে ওকে নিয়ে। যেদিকে তাকায় সেদিকেই শুধু শত্রু চোখে পরে। অথচ কারণটা খুব হাস্যকর। ক্লাসের অনেকের ধারণা ও অন্যের নোট চুরি করে। এমন সন্দেহের কারণ তো আছেই। কিন্তু সামান্য ক্লাস নোট নিয়ে সবার এমন নীচু মানসিকতায় হাপিয়ে উঠে ও। এইবার পড়াশুনার ব্যাপারে কেউ আর সাহায্য করবে না, কেউ ওকে ক্লাসনোট বা লেকচার কিছুই দিচ্ছে না আর। শুধু তাই না, পরীক্ষার আগে আগেই ডিপার্টপার্টমেন্টের লাইব্রেরির প্রয়োজনীয় বই সব লোপাট করে দিবে।
কিন্তু তাতে ওর কিছুই হবে না, ওর নোট পড়ারও দরকার পরে না, পরীক্ষার হলে বসেই যা করার করে ফেলে। কিন্তু এমন আচরণে হঠাৎ রোখ চেপে গেছে, দেখে নিবে এবার ছোটলোকগুলোকে।
শেষে ঠিক করল ওরা লাইব্রেরি থেকে বই সরিয়ে নেবার আগেই ও তুলে নেবে। সব বই, যাতে আর কেউ পড়তে না পারে। একেবারে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেখে দেবে নিজের কাছে। তাতে যদি কিছু জরিনামা গুনতে হয় তাই সই।
সেই মানসেই সেদিন ও গিয়েছিল লাইব্রেরিতে। আর ডুকেই একেবারে নাজিয়ার সামনে পরে যায়। টেবিলের এক কোণায় একা বসে আছে মেয়েটা। প্রথমে ইচ্ছে হল আপাতত এড়িয়ে যাবে। তা-ই যাচ্ছিল। কিন্তু এমন সময় মগজের ভিতর একটা নাম ঝন্ঝন্ করে বেজে উঠে, - “আবির”!
শুরুতে বুঝতে পারে না কি হল। শব্দের উৎস খুজতে গিয়ে আবার শুনল নামটা, “আবির”। নাজিয়ার দিকে তাকালো একবার। মেয়েটা তখন মাথা নিচু করে অদ্ভূত একটা হাসি ঢাকার চেষ্টা করছে। বুঝতে আর বাকি থাকে কি হল ব্যাপারটা। নিজের অজানতেই মেয়েটার মাথার ভিতর ডুকে পরেছে ও। আর মেয়েটা তখন এক নাগাড়ে শুধু একটা মানুষের কথাই ভেবে চলেছে, - “আবির”!
জীবনে এই প্রথম এমন বিমূঢ় অবস্থায় পরে ও। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সকল ক্ষোভ-দুঃখ-হতাশা লাইব্রেরির দরজার উপর খাটিয়ে সবাইকে অবাক করে বিকট শব্দে বেড়িয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৩