"ঠগী" নামটা আগে শুনেছিলাম, কিন্তু তাদের অদ্ভূত এবং চিত্তাকর্ষক ইতিহাস পাই শ্রীপান্থের লেখা "ঠগী" নামের বইটিতে। কি রকম নির্মম, নির্বিকার, ঠান্ডা মাথার খুনী এই ঠগী তা কল্পণাকেও হার মানায়। কিভাবে ঠগীদের দল পথিকদের সুন্দর ব্যবহারে ভুলিয়ে-বালিয়ে নিয়ে যায়, তারপর পছন্দ মত কোন জায়গায় নিয়ে "ঝিড়নী" দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়, সে অনেকটা কিংবদন্তীর মত। অথচ এতে আয় হত খুবই কম, লুটের টাকা যদি একশ' জনের মধ্যে ভাগ হয় তো কি-ই বা থাকে। শুধু সামান্য টাকার জন্যই এত খুনো খুনী?
এক ইংরেজ ভদ্রলোকের হিসাব অনুযায়ী সে সময় বছরে গড়ে এভাবে মানুষ খুন হত চল্লিশ হাজার! আর এর বেশিরভাগই ঠগী'দের শিকার। এক-দুই নয়, তিন তিনটি শতাব্দি ধরে চলেছে এমন নিরব হত্যাযজ্ঞ।
এক টুকরো রুমাল
বেশি না, এক টুকরো কাপড় বা রুমালই হল হাতিয়ার। সেই রুমালে বিশেষভাবে গিট দিয়ে একটা ফাস বানানো হয়। এটাকে বলা হয় সিক্কা বা পেলহু।
পথ চলতে চলতে ঠগীর দল এক সময় শিকারের সন্ধান পেয়ে যায়। প্রথমে তাদের কথায় ভুলিয়ে দলে নিয়ে আসা হয়। পথিককে বলে, - "পথে কত কিছুর ভয় আছে, কখন কি হয়ে যায় ঠিক নেই। আসুন একসাথে গেলে ভয়টা কম হবে&"। এরকম নানা প্রলোভনে ভোলানো হয় তাদের। শিকার যদি টোপে ধরা দেয় তো ভালোই।
এরপর পথ চলতে থাকে, হয়তো পছন্দমত জায়গা খোজার জন্যই। তারপর একদিন দলের কারো সাথে গল্পে মশগুল হতে হয় পথিকের। গল্পের নেশায় পেয়ে বসে, কোথায় কি ঘটছে খেয়াল থাকে না তার।
আর ঠিক তখনি পিছন থেকে কেউ এসে রুমাল পরিয়ে দেয় গলায়। এক হেচকা টানে মুহুর্তেই মৃত্যু হয় পথিকের, কিছু বুঝে উঠার আগেই। এরপর হাত-পা ভেঙ্গে গাড় মটকে মাটিতে চাপা দেয়া হয়। এই হল ঠগীদের নিখুত খুনের নমুনা।
ঠগীদের জীবন-যাত্রা
একেবারে বাউন্ডুলে নয়, ঠগীদেরও সংসার আছে -- বউ, ছেলে, মেয়ে সব। অন্য আট-দশটা মানুষের সাথে তাদের কিছুমাত্র তফাত নেই, খুনী চরিত্রের ছিটেফোটাও নেই। বাড়িতেই থাকে, কাজ করে, সংসার দেখাশোনা করে।
তারপর বর্ষার পর পরই একদিন তারা নেমে পরে রাস্তায়। পথে দেখা হয় আরো অনেকের সাথে। নিজেদের চিনে নিতে কষ্ট হয় না, কারণ ওদের আছে নিজস্ব ভাষা। এমনি ভাষা, যার শব্দ ভান্ডার নিয়ে একটা প্রমাণ সাইজের ডিকশনারি হয়ে যাবে! চলতে থাকে তারা দূর-দূরান্তে। ধীরে ধীরে দল ভারী হতে থাকে। সবার ভিতর বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পন করা থাকে।
যেতে যেতে তারা শিকারও পেয়ে যায়। একজন শিকার থেকে হয়তো তেমন কিছুই মেলে না। কিন্তু দল যত বড়ই হোক না কেন, সকলেই সমান ভাগ পায়। এইটা নিয়ে কোন রেষারেষি কখনোই হয় না।
বংশ পরম্পরায় চলে ঠগীদের এই পেশা। অনেক পিতাই তার সাত বছরের সন্তানকে নিয়ে যায় পথে। শিশুটি হয়তো কিছুই জানতে পারে না তার পিতা কি করছে, কিন্তু সেই শিশুও ডাকাতির ভাগ পেয়ে থাকে। ফেরার পথে সেই ভাগ থেকে কিনে দেয়া খেলনা বা অন্য কিছু পেয়ে সে বরং খুশিই হয়।
কখনো কখনো ঠগীদের মধ্যেই বিয়ে হয়, কখনো বা স্ত্রী জানতেই পারে না তার স্বামী একজন ঠগী। সে এক অদ্ভূত জগৎ!
পেশা? নেশা? নাকি আরো বেশি কিছু?
শুধু কি ডাকাতির জন্যই এত এত খুন? কিসের লোভে দিনের পর দিন এই হত্যাকান্ড?
এবার বিস্ময়কর তথ্যটা দিচ্ছি।
অবস্থা বিচারে এ সামান্য ডাকাতির পেশা নয়, একটা ধর্ম। ঠগীদেরও দেবতা আছে, নিজস্ব বিশ্বাস ও আচার আছে। ঠগীরা মনে করে তাদের উৎপত্তি মা ভবানীর ঘাম থেকে। কিংবদন্তী অনুসারে ভবানী আর রক্তবীজের লড়াই-এর ভিতর দিয়ে ঠগীদের জন্ম। সেই থেকে তারা মানুষ মেরে যাচ্ছে শুধু মা ভবানীর ভোগের উদ্দেশ্য। এতে নাকি তারা মানুষের উপকার করছে, কারণ তা না হলে ভবানী পুরো পৃথিবী শূণ্য করে দিত। বড় অদ্ভূত এ বিশ্বাস, যেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই একত্র হয়েছে মা ভবানীর ছায়াতলে।
প্রতিবছর বর্ষার শেষেই শুরু হয় ঠগীদের ততপরতা। এসময় গোপনে কোদাল বানিয়ে সেটা মন্ত্রপূত করা হয়। এই কোদাল হল ঠগীদের আসল প্রতীক। পাঠা বলি দিয়ে ভোজ উৎসব করা হয়। তারপর তারা পথে নামে।
পথেরও আছে অনেক নিয়ম কানুন। মা ভবানী সব সময় ওদের গাইড করে। কোন পথে শেয়াল যায়, কোথায় পেচা ডাকে, কোথায় একটা কাক বা চিল উড়ে গেল, এইসব দেখেই তাদের পথচলা। আবার শিকার হাতে পেলেই "ঝিরনী" দেয় না, তাতেও মা'য়ের অনুমোদন চাই। কোন কোন সময় অশুভ সংকেতও নির্দেশ করে দেবী, না মানলেই দলের কারো মৃত্যুর আশংকা। সব মিলিয়ে এক অদ্ভূত জীবন ওদের।
ঠগী স্লীমেন
আরেক কিংবদন্তীর নাম উইলিয়াম স্লীমেন। ব্রিটিশ রাজের অধীনেই ভারতে আসে। কিন্তু শীঘ্রই তার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠে ঠগী। প্রথম প্রথম কেউ পাত্তা দেয় না তেমন, এমনকি ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ তাকে "ঠগী স্লীমেন" বলে ডাকত।
কিন্তু হার মানেননি তিনি, অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। এবং একদিন সফলও হন তিনি, দেখিয়ে দেন ঠগী কোন রুপকথা নয়, বাস্তবতা। শুধু প্রমাণ দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজের চেষ্টায় ভারতবর্ষ থেকে নির্মূলও করেন ঠগীদের। এক সাথে চালিয়ে গেছেন আইনী আর সামাজিক লড়াই।
মোটামুটি ১৮৩০ এর দশকেই একে ঠগীদের দল ধরা পরতে শুরু করে। বেরিয়ে পরে ঠগীদের অদ্ভূত ইতিহাস। দেখা যায় এ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, বরং সেই সুলতানী আমল থেকেই চলে আসা এক ইতিহাস। সমগ্র ভারত জুড়ে আছে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক, যেমন উত্তরে, তেমনি দক্ষিণে। যদিও উত্তর-দক্ষিণের ভিতর বনিবনা ছিল না তেমন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৫০