somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধিন্‌তার লাটিম বন্ধু

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধিন্‌তার সবাচাইতে প্রিয় বন্ধুটির নাম রাইয়ান। যদিও ধিন্‌তার স্কুলের প্রথম দিনগুলোতে রাইয়ান ধিন্‌তার চোখে ছিলো খুবই অদ্ভুত আর কাজ কারবার ছিলো রহস্যে ঘেরা! যেহেতু ধিন্‌তা স্কুলে নতুন ছিলো, তাই টিফিনের সময় নিজের মতোই একটি জায়গায় বসে খেতো আর চিরদিকে দেখাতো যে কে কী করছে! ধিন্‌তার চোখ বেশিরভাগ সময় রাইয়ানের দিকেই আটকে থাকতো। খুব অবাক হয়ে শুধু দেখতো আর ভাবতো যে, কীভাবে সবার থেকে আলদা হয়ে একা একা বসে লাটিম দিয়ে একভাবে এক নাগাড়ে খেলতো ছেলেটি। তাও আবার প্রতিদিন একই জায়গায় বসে! দেখে মনে হতো যেন জায়গাটি ঠিক তাঁর জন্যই বরাদ্দ করে রাখা হয়েছিল। ক্লাসের অন্যান্য বাচ্চারাও নিজ থেকে এসে তাঁর সাথে কথা বলতো না। ধিন্‌তাদের ক্লাসে মোট পঁয়ত্রিশ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিলো। কিন্তু সবাই মিলে খেলার সময় শুধু চৌত্রিশ জনই খলেতো। কারণ রাইয়ান সবসময় বাদ পড়তো বা নিজ থেকেই খেলায় আসতো না। ধিন্‌তাদের ক্লাস টিচার খুব চেষ্টা করতেন যেন সবার সাথে রাইয়ান খেলতে আসে। কিন্তু একবারের বেশি বললে সে খুব বিরক্ত হতো। মনে হতো, কেউ তাঁর ধ্যান নষ্ট করে দিচ্ছে, নিজের আলাদা জগৎটা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তাকে।

কী যে এতো চিন্তা করতো তা নাকি ধিন্‌তার বুঝেই আসতো না কখনো। বোঝার কথাও না। ক্লাস ফোরে পড়া বাচ্চা কতোটুকুই বা আর বুঝতে পারে! ধিন্‌তাদের ষাণ্মাসিক পরীক্ষার পর বাবা-মায়েদের ডাকা হয়েছিলো ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার অবস্থা সম্পর্কে জানানোর জন্য। সেদিন ধিন্‌তার পাশের সারিতে বসেছিলো রাইয়ান আর তাঁর মা-বাবা। ধিন্‌তা তাঁর মা-বাবাকে রাইয়ানের কথা বলছিলো। ধিন্‌তার মা-বাবা কিছুক্ষণ রাইয়ানকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। এরপর বাসায় যেতে যেতে পুরো ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলছিলো ধিন্‌তাকে। সেদিন ধিন্‌তা জানতে পেরেছিলো যে, রাইয়ানের অটিজম আছে। আর এটি কোন সমস্যা নয় বরং সে অন্য সাবার থেকে আলাদা এবং এক কথায় বলতে হলে, ‘বিশেষ শিশু’। আর তাই সে সবার সাথে কথা বলতে বা মিলেমিশে থাকার চাইতে নিজের মতো থাকতেই পছন্দ করতো। তবে ধিন্‌তার মা-বাবা বলেছিল যে, ভালোবাসা দিয়ে খুব কাছে টেনে নেয়া যায় তাদের। পরের দিন ক্লাসে গিয়ে ধিন্‌তা নিজ থেকেই রাইয়ানের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলো। সেই লাটিম দিয়েই খেলছিলো রাইয়ান!

ধিন্‌তা তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কী তোমার লাটিমটা দিয়ে একটু খেলতে পারি?” কিন্তু রাইয়ান কোন উত্তর দেয়নি। আবারও জিজ্ঞেস করলো ধিন্‌তা। তবুও কোন সাড়া শব্দ নেই! ক্লাস শুরু হওয়ার আগে যখন ঘণ্টা পড়লো, তখন রাইয়ান খুব বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে কান চেপে রাখলো। শব্দটা তেমন বিকট ছিলো না, তবুও তাঁর খুব অসহ্য লাগছিলো। সেদিন টিফিনের সময় ধিন্‌তা তাঁর পাশে গিয়ে বসেছিলো। নিজ থেকেই ধিন্‌তা জিজ্ঞেস করেছিলো যে, যেটা রাইয়ান খাচ্ছিলো সেটা ধিন্‌তাকেও কী একটু দেয়া যায় কিনা। কোন উত্তর দেয়নি রাইয়ান। যখনই ধিন্‌তা সেখান থেকে উঠে যেতে লাগলো, অমনি রাইয়ান ধিন্‌তার দিকে তাঁর টিফিন বক্সটি এগিয়ে দিলো। খুব খুশি হয়ে গিয়েছিলো ধিন্‌তা! এই বোধহয় শুরু হয়ে গেলো তদের বন্ধুত্বের পথচলা। খাওয়া শেষ করে আবারও রাইয়ান লাটিম নিয়ে বসে পড়লো।

ধিন্‌তাও তাঁর সাথে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “রাইয়ান আমিও একটু খেলি তোমার লাটিমটা দিয়ে?” সেই আগের মতোই কোন উত্তর না দিয়ে নিজের মতোই খেলছিলো সে! ধিন্‌তা আর তাকে বিরক্ত না করে পাশে বসেই রাইয়ানের খেলা দেখছিলো। পরের দিন ধিন্‌তাও একটা লাটিম নিয়ে তাঁর পাশে খেলতে বসে গেলো। রাইয়ান বিষয়টি খেয়াল করলেও প্রথম প্রথম কিছুই বললো না। ধিন্‌তা হঠাৎ খুব ভয়ে ভয়ে তাঁর লাটিমটি রাইয়ানের লাটিমের খুব কাছে নিয়ে ঘুরাতে থাকলো। মাথা উঁচু করে ধিন্‌তার দিকে তাকিয়ে রাইয়ান ফিক করে হেসে দিলো। ধিন্‌তাও হেসে দিলো। এরপর দুজনে মিলে দিব্যি লাটিম দিয়ে খেলছিলো। কিছুক্ষণ পর তাদের ক্লাসের কয়েকজন ছেলেমেয়ে এসে কানামাছি খেলার জন্য জোরাজুরি করলো। ধিন্‌তা যেতে চাইলো না। তবুও তাঁরা বারবার করে বলছিলো বলেই যেতে রাজি হলো ধিন্‌তা। রাইয়ানও তাদের সাথে খেলবে বলে জানালো ধিন্‌তা। সবাই আশ্চর্য হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। ধিন্‌তা রাইয়ানের পাশে বসে তাকে জিজ্ঞেস করলো যে সে খেলবে কিনা। দুই তিনবার পরপর জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কোন উত্তর না দিয়ে রাইয়ান নিজের মতোই খেলছিলো।

সবাই খেলার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো ধিন্‌তাকে। কারণ টিফিনের সময় শেষ হতে খুব বেশি সময় বাকি ছিল না। ধিন্‌তা উঠে গিয়ে ক্লাসের বন্ধুদের সাথে খেলতে গেলো। একটু পরেই ধিন্‌তা দেখলো যে, রাইয়ান তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রাইয়ানকে দেখে ধিন্‌তার এতোই ভালো লেগেছিলো যা বলার মতো না। এরপর তাঁরা সবাই মিলে খেলা শুরু করলো। রাইয়ানও খেলছিলো অনেকটা তাঁর নিজের মতো করেই। খেলা যখন তুঙ্গে, তখন খুব জোরে জোরে সবাই হাসি, কথা শুরু করলো। তখনই রাইয়ান দুই কান চেপে ধরে খুব অসহ্য বোধ করতে থাকলো। ধিন্‌তা সবাইকে বললো একটু আসতে কথা বলতে আর চিৎকার না করতে। কারণ এতে করে রাইয়ানের সমস্যা হয়। সবাই কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলো ধিন্‌তার ওপর। তবুও ধিন্‌তা সবাইকে বুঝিয়ে বললো যে, রাইয়ান তো তাদেরই বন্ধু। তাঁর জন্য না হয় এতোটুকুই করলো তাঁরা। এরপর থেকে ধিন্‌তা আর রাইয়ান টিফিনের সময়ে সবার সাথে খেলতো। যদিও বেশিরভাগ সময়েই সে লাটিমই ঘুরাতো। একসাথে সবাই মিলে টিফিন খেতো। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও রাইয়ানের বাসায় যেতো ধিন্‌তা, তাঁর সাথে খেলার জন্য। ধিন্‌তা রাইয়ানের সাথে খেলতে গেলে তাঁর মা-বাবাও অনেক খুশি হতেন। রাইয়ানের জন্মদিনে ক্লাসের সবাই গিয়েছিলো তাঁর বাসায়। অনেক খুশি ছিলো সেদিন রাইয়ান। অনেকগুলো উপহারও পেয়েছিলো! ধিন্‌তাও তাকে একটি উপহার দিয়েছিলো। আর সেটি ছিলো লাটিম!

যেহেতু সে লাটিম অনেক পছন্দ করতো, তাই ধিন্‌তা তাকে লাটিমই দিয়েছিলো। সেটা পেয়ে তো রাইয়ান বেজায় খুশি! এরপর থেকে রাইয়ান সেই লাটিমটা দিয়েই খেলতো। চশমা হাতে নিয়ে কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে গল্পটা শেষ করলো ধিন্‌তা। ধিন্‌তা হলো টয়ার দাদুভাই। আর রাইয়ান হলো টয়ার দাদুভাইয়ের বন্ধু। টয়া তাকে ডাকে রাইয়ান দাদু বলে। রাইয়ান দাদু এখনও ধিন্‌তার বন্ধু। প্রায়ই তাঁর বাসায় বেড়াতে যান ধিন্‌তা। তাকে নিয়ে ঘুরতেও বের হন। ধিন্‌তা তাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছেন লাটিম বন্ধু। তাঁর সাথে কখনো দেখা হয়নি টয়ার। তবে ধিন্‌তার কাছে টয়া শুনেছে যে, তিনি নাকি এখনও লাটিম দিয়ে খেলেন। আজকে ঘটনাক্রমেই টয়াকে ধিন্‌তার এই গল্পটি বলা! টয়ার ক্লাসেও এরকম একটি মেয়ে আছে। ওর নাম মাইশা। টয়া ধিন্‌তাকে মাইশার কথা বলার পর তিনি বলেছিলেন, “শুনো টয়া, মাইশার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করবে। ক্লাসের অন্য সবাইকে বোঝাবে যেন তাঁরা মাইশার সাথে মিলেমিশে থাকে। সবার ভালোবাসা আর বন্ধুত্বটা তাদের খুব দরকার।“
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৮ রাত ১২:৫৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরাকানে 'স্বাধীন মুসলিম রাজ্য' প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১১:১২


বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী সম্প্রতি একটি ‘স্বাধীন মুসলিম রাজ্য’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, যা আসলে হাস্যকর এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি , এবং চীনের ভূ-রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

১০০ টা নমরুদ আর ১০০ টা ফেরাউন এক হলেও একজন হাসিনার সমান নৃশংস হওয়া সম্ভব ছিলো না!!

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:৫২

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্য কবর খুঁড়তে হয়েছিলো ২ টা।
একটা না।
ফাঁসির ৪ ঘন্টা আগেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জানতেন না, আজকেই তাকে যেতে হবে।
ফ্যামিলি যখন শেষবারের মতো দেখা করতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিলিস্তিন নিয়ে এতো লাফালাফির কি আছে?

লিখেছেন অপলক , ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:১০

ফিলিস্তিনে গত ৩ বছরে মারা গেছে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫১ হাজার। বাংলাদেশে ১৯৭১এ মাত্র ৯মাসে মারা গেছে ৩ লক্ষ, যদিও শেখ মুজিব বলেছিল, ৩০ লক্ষ।
কোথায় ৫১ হাজার কোথায় ৩০ লক্ষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন ...

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:১৯





****
আরো দেখতে চাইলে ভেতরে আসেন ...







...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুগে-গুজবে বাংগালী....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:২৩

হুজুগে-গুজবে বাংগালী....

"হুজুগে-গুজবে বাংগালী"- বলে আমাদের একটা দুর্নাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। গুজব আর হুজুগ যমজ ভাই।
গুজব বা হুজুগের সবকিছু মানুষ কিনতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্যোতনা দেয় অন্ধ বিশ্বাস।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×