সকালটা শুরু হলো ধূসরতায়, পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে খুব। চেহারাভর্তি একরাশ চিন্তার দাগ। কি হতে চলছে. ?
কিইবা ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে.?
একটু ভেবেছিলাম মেয়েটিকে নিয়ে, সবেমাত্র ইন্টারমেডিয়েট ১ম বর্ষে পড়ে, ১৮ বছর কি বয়স হয়েছে..?
যদি ১৮ বছর বয়স না হয়ে থাকে, তাহলে একজন সামরিক দ্বায়িত্ববান পিতা হয়েও কিভাবে মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসানোর চিন্তা মাথায় আসে.?
যাই হোক তারা যতটা অসচেতন হোক আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তা মানতে পারি না।
আর মেয়েটিই বা কেমন.? হয়তো তারও রয়েছে পেছনের কোনো গল্প, ভালোবাসার সম্পর্কটা আজকাল না হওয়াটাই অস্বাভাবিক, তাছাড়া এ বয়সটা ভয়ংকর প্রেমঘটিত সম্পর্কে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমার কথাই বা ভিন্ন কি বলবো.?
আমিও কাউকে না কাউকে ভালবাসতাম বা ভালোবাসি। যদিও আমার সেই সম্পর্কের বহুআগেই ইতি ঘটেছে কিন্তু ভালোবাসাটা আমৃত্যুই রয়ে গেছে এবং রয়ে যাবে।
বিছানা ত্যাগ করেছিলাম প্রায় আটটার দিকে, উঠেই দেখি আম্মু নাস্তা রেডি করে রেখেছে। নাস্তা সেরেই দোকানের দিকে গেলাম , দেখি অনেকেই আছে । ঘন্টাখানেক সেখানে সময় কাটিয়ে বাড়ির দিকে ফিরেই বাবার সাথে দেখা।
হাতে দুইশ টাকা দিয়ে বললো- বাজারে যা, চুল দাড়ি কেটে আয়, বড়চুলে খারাপ দেখাচ্ছে।
চুল দাড়ি এলোমেলোতেই কম্পোর্টেবল বোধ করি, সেখানে চুল দাড়ি কাটতে বলায় মাথায় রাগ উঠে গেল, কেম্নে কি.?
এমনিতেই একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিছে তা মেনে নিয়েছি কিন্তু চুল কাটবো এটা কেমন কথা.?
বাবাকে বললাম - চুল দাড়ি এমনিতেই সুন্দর কাটা লাগবে না
বাবা বললো - ভালো দেখায় না খারাপ দেখায় সেটা তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো না, সেলুনে যেতে বলছি যাও।
আমার রাগ মাথায় উঠে বসলো - চুল যদি কাটতেই হয় তাহলে আমি পানিয়ালা যাচ্ছি না। এখন কি আপনি চান আমি পানিয়ালা না যাই.?
তাহলে আমার চুল দাড়ি যেভাবে আছে সেভাবে থাকলে যামু না হয় না।
সোজা বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে, রাস্তায় গিয়ে বসে রইলাম।
মোবাইল এ প্লে মিউজিকে গিয়ে ওয়ারফেজ এর রূপকথা গানটি ছেড়ে শুনতে লাগলাম এরই মাঝে আম্মুর ফোন - বাবা কই তুই..?
আমি - রাস্তায়
আম্মু - বাড়িতে আয় তোর আব্বু রাগ করছে
আমি - চুল দাড়ি থাকলে সমস্যা কি.?
আম্মু - বাবা কথাটা রাখ তুই, তোর বাবার একটা সম্মান ত আছে, তুই বাড়িতে আয় ।
আমি - আচ্ছা ।
কি আর করার, বাড়িতে গেলাম ।
আম্মু বলে- বাবা যা চুল দাড়ি কেটে আয়
আমি বললাম - আবার একই কথা. ?
আম্মু - তোর আব্বু রাগ করবে
আমি - কোন দুঃখে যে বাড়িতে আসতে গেলাম ।
দাও, টাকা দাও
বাধ্য হয়ে বাইক নিয়ে সোজা সেলুনে, আর বিসর্জন দিয়া দিলাম যত্মে গড়া চুল দাড়িগুলোকে। একদম ক্লিন শেভ। সেলুনের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেকেই চিনতে পারছি না। পুরাই বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।
কি আর করার, এটাই কপালে ছিল হয়তো। কেমন জানি আনইজি ফিল করতে লাগলাম। প্রায় তিন বছর পর ক্লিন শেভ হওয়া, আনইজি ফিল করাটাই স্বাভাবিক।
ইনোসেন্ট একটা লুক নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলাম, আম্মু দেখে মহাখুশি বললো বাবা এবার তোরে সুন্দর লাগছে , আর চুল দাড়ি বড় করবি না।
শখের চুল, শখের দাড়ি বিসর্জন দিয়ে এমনিতেই আমার গা জ্বলছে, আর আম্মু বলে এভাবেই তোরে সুন্দর লাগছে।
ভাবতে পারি না কেন যে মুরুব্বিগন মনে করেন ক্লিন শেভে ছেলেদের সুন্দর লাগে।
যাইহোক, দুপুরের পর বের হওয়ার পালা, কনের বাড়িতে যাওয়ার কথা।
সবাই যে যার মত প্রস্তুত হইছে, আমার বেলায় এসেই ঝামেলা বাধলো।
কালো রঙের টি-শার্ট, জিন্স আর সু। এগুলো নাকি পোশাক না, আমাকে ফরমাল হতে হবে। আরে বাবা এত নিয়ম কানুন কে চালু করলো কনে দেখার ব্যাপারে তা আল্লাহ মালুম।
এবার আমি টি-শার্টেই অটল ছিলাম। যেখানে ভার্সিটিতে ফরমাল না হয়ে পেজেন্টশন দেই, সেখানে কনে দেখতে গিয়ে বুঝি ফরমাল হবো.?
এবার যাওয়ার পালা- বাবা, চাচা, কাজিন, আর একটা কাজিনের জামাই সিনএনজিতে করে যাবে, আমি আর ছানাউল্লাহ বাইকে যাবো। সেখানেও আপত্তি, আমি বাইক চালিয়ে গেলে নাকি খারাপ দেখায়।
হায়রে মানুষ, এত নিয়ম কানুন কে সৃষ্টি করলো আল্লাহ মালুম।
এবারও মুরুব্বিদের নিষেধ অমান্য করে বাইক চালিয়েই যাত্রা শুরু করলাম। পানিয়ালা বাজার পর্যন্ত গিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুসময় পর বাবা চাচাদের বহন করা সিএনজি আসার পর সিএনজিকে অনুসরণ করে কনের বাড়িতেই পৌঁছলাম ।
প্রথমেই পরিচয় পর্ব এবং মিষ্টান্নভোজন ও সুপেয় পানীয় পানের পর্ব শেষ হয়ে মধ্যাহ্নভোজন এর পালা। পোলাও,চিংড়ি, ইলিশ, মুরগী, ডিম আর গরু দিয়েই বুফে সাজানো , যে যার ইচ্ছে মতই আহার করা শেষে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কনে দেখার পালা।
কনে দেখার পালা শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হল, না জানি মেয়েটির মনে এখন কি চলছে ।
মেয়েটি কেমন হবে?
মেয়েটি কি একটি অনিশ্চিত ভবিষৎ এর দিকে চলে যাচ্ছে না তো.?
আবার আমার ক্যারিয়ার এবং স্বপ্নও কি শেষ হওয়ার পথে নাকি.?
ভার্সিটি বন্ধুদের এবং সার্কেলের সবাইকে কনের ছবি দেখাতে হবে, সেখানে বর হিসাবে ছবি তোলাটা শোভনীয় না, তাই কাজিন কে বললাম - তুই মেয়ের ছবি তুলে নিস কয়েকটা।
ভাবনার মাঝেই, পানের থালা হাতে নিয়ে কনের প্রবেশ হয় রুমে। হালকা খয়েরি বর্ণের শাড়ী পরেছে সম্ভবত, কিছু কমন রঙ ছাড়া অন্য রঙ আমি চেনিনা। শাড়ীটা দেখে তবে খয়েরি রঙই মনে হল।
মেয়েটিকে মুরুব্বিগন বসতে বলার পর মেয়েটি আমার মুখোমুখি একটি চেয়ারেই বসলো, আমি নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।
চাচা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো - মা তোমার নাম বলো.?
মেয়েটি নিচু কণ্ঠে বললো- মুনতাহা ইসলাম নাদিয়া
চাচা বললো - কোথায় পড়ো.?
মেয়েটি বললো- শামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজে ইন্টার ১ম বর্ষে সায়েন্স বিভাগ নিয়ে পড়ি।
এরপর বাবা চাচা আরো অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটি স্বল্প বচনে বাবা চাচার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। মেয়েটিকে বুদ্ধিমতি এবং মেধাবিনী মনে হয়েছিল।
মরুব্বিদের কথা বলার মাঝে আমি মেয়েটির দিকে কয়েকবারই তাকিয়ে ছিলাম এমনকি দুজনের চোখাচোখি ও হয়েছিল কয়েকবার।
ভীষণ রূপবতী মেয়েটি, কপালের মাঝে ছোট্ট একটি টিপ পরেছিল টিপে যেন মেয়েটির সৌন্দর্য্য দ্বিগুন বৃদ্ধিকরে দিয়েছিল।
যদিও মেয়েদের চুলের প্রতি আমার দূর্বলতা সেখানে মেয়েটির চুল শাড়ীর আচলে ঢাকা ছিল তাই চুল আর দেখা হয়নি।
মেয়েটির সাথে যখন মুরুব্বিদের কথা বার্তা শেষ হলো তখন চাচা আমাকে বললো - বাবা তোমার কোনো কিছু জানার আছে.? জিজ্ঞেস করতে পারো।
আমি তখন এমনিতেই আনইজি ফিল করতেছিলাম, অন্য মনের মাঝে ভালোবাসর মানুষএর প্রতিচ্ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে, হানা দিয়ে উঠেছে যেন জমে থাকা সব বিরহ বিচ্ছেদ এর বেদনা।
চাচাকে বললাম আপাতত আমার কিছুই জিজ্ঞেস করার নাই।
চাচা মেয়েটিকে বললো- তোমার কিছু জানার আছে.?
মেয়েটি বললো - না
চাচা বললো - মা তাহলে তুমি ভিতরের রুমে যাও।
মেয়েটি ভিতরের রুমে চলে গেল, আমার কাজিন তার সাথেই ভিতরে গেল। আমি সেখান থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে বসলাম। মোবাইল বের করে নেট অন করতেই অনেকের মেসেজ কতদূর এগুলাম. ?
অনেকে তখনই ছবি চাচ্ছিল কনের, কিন্তু ছবি তোলার জন্য যাকে দ্বায়িত্ব দিয়েছিলাম সে এখনো কনের রুমেই।
মুরুব্বিগন গল্প জুড়ে দিলেন, চাচা আর কনের বাবার বন্ধুত্বের গল্প। এবং বিভিন্ন সুখ দুঃখের গল্প।
এরই মাঝে সন্ধ্যা নেমে আসলো।
তারউপর আজ আবার বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ, যে দল জিতবে সে দলই খেলবে এশিয়া কাপের ফাইনাল ভারতের সাথে।
ছটপট করতে লাগলো মন, খেলা শুরু হয়ে গেছে আর আমিও এখানে অসহায়ের মত বসে আছি।
চাচা ডাকলো আমাকে এবং বললো - একটু এদিকে চল,
আমাকে নিয়ে বারান্দার দিকে গেলো চাচা এবং বললো- নাদিয়াকে কেমন লাগছে তোমার. ?
আমি বললাম- দেখতে সুন্দরীই পছন্দ হওয়ার মতই
চাচা বললো- আমরা কি এখন সামনে এগুবো..?
আমি বললাম- আমার একটু সময়ের প্রয়োজন
চাচা বললো - আংটি পরিয়ে রাখলে ত তুমি সময় পাবেই তাছাড়া মেয়েটির বয়স এখনো আঠারো হয়নি, আঠারো হওয়ার পর বিয়ে হবে হাতে একবছর সময় থাকবে তোমার।
আমি বললাম- আংটি পরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমার সময় লাগবে। আমাকে কয়েকদির সময় দাও আমি পরে জানাচ্ছি।
চাচা বললো - আনুমানিক তোমার কতদিন সময় লাগবে.?
আমি বললাম - সর্বনিম্ন একমাস সময় দাও
চাচা বললো - তোমাকে ১৫ দিন সময় দিলাম তোমার মতামত জানানোর জন্য ।
আমি বললাম - আচ্ছা।
আমরা এখন চলে যাই.?
চাচা বললো - দাড়া, সবাইকে বলে যা।
চাচাকে নিয়ে আবার সবার মাঝে ফিরে আসি, চাচা বললো ইফাত তুমি তাহলে চলে যাও এখন, আমি বললাম আচ্ছা, সবাইর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর ছানাউল্লাহ বাইক নিয়ে সোজা বাজারে, ছানাউল্লাহকে বাজারে রেখে আমি বাড়ি এসে ড্রেস চেঞ্জ করে আবার বাজারে ব্যাক করি ।
বাজার থেকে খেলা শেষ করেই বাড়িতে ফিরি, তখন আর সময় ছিল কারো সাথে কথা বলার।
কাজিনকে মেসেঞ্জারে নক দিয়ে একটি ছবিও নিয়েছিলাম কনের, কাজিন সেল্ফি তুলেছে ।
ছবিটা বন্ধুদের মাঝে পৌঁছানোর পরই তাদের কারো কারো মন্তব্য এমন ছিল- ইফাত শালী আছে তোর.?
আমি বললাম- না একবোন একভাই
বেচারা হৃদয়ের তখন হৃদয় ভেঙ্গে গেল এবং বললো শালা, শালী ছাড়া বিয়ে করতে গেলি কেন.?
স্বপ্না বললো- মামা মেয়ের ভাইর সাথে আমারে সেট করাইয়া দে,
আমি বললাম - মামা, শালা সেভেনে পড়ে মাত্র
বেচারির ও মন ভেঙ্গে গেল।
সবাই প্রস্তুত আমি বিয়ে করবো সেখানো তারা উদযাপন করবে বলে, কিন্তু আমিই অনিশ্চিত তা নিয়ে।
হাতে আছে মাত্র পনের দিন সময় - একদিকে ফ্যামেলি অন্য দিকে ক্যারিয়ার, স্বপ্ন এবং ভালোবাসা..
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:২২