মোহাম্মদ তাজাম্মুল হোসেন
৪ঠা ফেব্রুয়ারী বিটিভি এর একটি বিকালের প্রোগ্রামে চোখ পড়ল। প্রোগ্রামটিতে কিছু আকর্ষনীয় কথা শোনা গেল। কিন্তু প্রোগ্রামটির নামটি আমার কাছে ভ্রান্তিমূলক মনে হল। আমি এখানে সেই ভ্রান্তিটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
‘একুশ থেকে স্বাধীনতা’ এই দেখলাম প্রোগ্রামটির পরিচয়। পরিচয়টি কি সঠিক ছিল? আমার কাছে আদৌ নয়। ‘একুশ’ বলতে আমরা বাংলাদেশীরা যারা কিছু বিদ্যা শিখেছি তারা বুঝি ২১শে ফেব্রুয়ারী-১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা স্মরণের বিষয়াদি। ঐতিহাসিক সেই ঘটনার কথা। সেতো ইতিহাস। তাই ইতিহাসবিদরা ভিন্ন আর কে ভাববেন? আমি প্রশিতি বা ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারী ইতিহাসবিদ না হয়েও কেন যেন ঐ বিষয়টি নিয়ে কিছু নাক গলাতে চাইছি। বলতে পারেন, অনধিকার চর্চা। কিন্তু তবুও যেহেতু আমি একজন সচেতন বাংলাদেশের নাগরিক এবং এক যুগেরও বেশী সময় অবসর জীবন যাপন করছি, তাই ভাবছি অবসর এই সময়ের বিকল্প কোন ব্যবহার করা যায় কিনা?
বলা হয় যে ‘ভাষার অধিকার’ আদায়ের জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বিশাল অর্জন। রক্তের বিনিময়ে সেই অধিকার এদেশের মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলা তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা যা কিনা ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান ‘কেড়ে’ নিতে চেয়েছিল। আরও বলা হয় যে, ওরা পশ্চিমারা বা পাকিস্তানীরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দু ভাষা আমাদের মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমরা তা হতে দেইনি। উর্দুকে যেমন গিলিনি বরং বর্জন করেছি তেমনি পাকিস্তানকেও ঝেটিয়ে দিয়েছি। এসব কথা কোন ফেলনা বিষয় নয়। খাঁটি শক্ত কথা। কিন্তু অনেক শুভঙ্করের ফাঁকি আছে এসব অনেক শক্ত কথার মধ্যেও।
প্রথমতঃ ধরা যাক, এটা কি কোন বিশ্বাসযোগ্য কথা হতে পারে যে, তখনকার চার কোটি মানুষের একটি সচল সবল মুখের ভাষা অন্যরা ভুলিয়ে দিতে পারে? পারে না, পারার কথাও ছিল না। কিন্তু সেভাবে একটি ভাবাবেগের বন্যা তৈরী করা হয়েছিল। কেননা, ভাবাবেগী মানুষ যেমন আমরা তেমনি ভাবাবেগে যে আমরা কত মারাত্মকভাবে চালিত হয়েছি তা অতীত রেকর্ড খুঁজে দেখলেই বহুল নমুনা পাওয়া যাবে। অনেকে বলতে পারেন ১৯৪০ দশকের বিভাজনের বিষয়টিও তেমনি একটি ভাবাবেগের কার্যকারন ছিল। কথাটি পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। তবে এর মাঝেও একটি ভিন্ন বিষয় ছিল এবং তা ছিল এই যে সে সময় বৃটিশ ভারত উপমহাদেশের সকল অর্থøাৎ দশকোটি মুসলমান একাট্টা ছিল-বাংলাভাষী মুসলমানরাই মাত্র একাট্টা হয়ে ১৯৪৭ এর বিভাজন সম্ভব করেনি। যাহোক সেসব বিস্তারিত এখন থাক। আসল বিষয়ে আসা যাক।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সালে একটি মারাত্মক ভঙ্গুর বা নাজুক অবস্থার মধ্যে সৃষ্টি হবার পর পরই ১৭ দিনের মাথায় ঢাকায় একজন পদার্থ বিদ্যার প্রভাষকের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সংগঠন তৈরী হয়। আবুল কাশেম সাহেব সেটি গঠন করে বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানসহ জ্ঞান চর্চার জন্য নতুন দেশ পাকিস্তানে ল্য নির্ধারণ করেন। সেই সাথে তিনি বাংলা ভাষাকে উর্দুর সাথে সাথে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবীটিও উত্থাপণ করেন। কেননা, ততদিনে অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা ইংরেজী পরিত্যাগ করে উর্দুকেই করা হবে। এরই ৬ মাস পর যখন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা এবং গভর্নর জেনারেল ১৯৪৮সালের মার্চ মাসের শেষে ঢাকা সফরে আসেন (১মাস পর) তখন তিনি উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা বা সাধারণ ভাবের আদান প্রদানের ভাষা হিসেবে তার তদানীন্তন রমনার সভার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। এ নিয়ে ঢাকায় ছাত্রদের মধ্যে ঊষ্মা সৃষ্টি হয়। তারা একটি প্রতিনিধি দলে মিলে জিন্নাহর সাথে সাাৎ করেন। এরপর বিষয়টি বহুলাংশেই প্রশমিত হয়। এরপর ৬ মাসের মাথায় জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীকে হত্যা করা হয়। মতার টালমাটাল শুরু হয় কেন্দ্রে। আর ষড়যন্ত্র তা তো ছিলই। কেননা, পাকিস্তানকে শেষ করার জন্য শত্রুর অভাব ছিলনা-ভিতরে এবং বাইরে। মতার হাতবদলও হয় অতি দ্রুত গতিতে। এমনি এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঢাকার নবাব পরিবারের উর্দুভাষী সহজ সরল মানুষ খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা এসে একটি জনসভায় ১৯৫২ সালের জানুয়ারীতে প্রকাশ্যেই জোর দিয়ে বলেন যে, ‘টৎফঁ ধহফ ঁৎফঁ ংযধষষ নবঃযব ড়হষু ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ্থ, এমনি একটি বেফাস কথা তার বলার কি প্রয়োজন ছিল বুঝা মুশকিল, তবে ঐ সুযোগটা লুফে নিল কেউ কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও একই সাথে ভাবাবেগসহ বিষয়টি নিয়ে সংগ্রাম শুরু করলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারী সাধারণ ধর্মঘট ডাকলেন। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারী করল। ছাত্ররা তা ভঙ্গ করতে গেলে গোলাগুলিতে কিছু জীবন গেল।
১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলাভাষা নিয়ে যেসব ঘটনা তা আমার প্রত্য জানা ঘটনা নয়-কেননা ১৯৫২ সালে আমি রংপুরের একজন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাস নাইনের ছাত্র মাত্র। অবশ্য ১৯৫৪ সালে ঢাকায় কলেজে পড়াশুনা করতে আসলে পর ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর নগ্নপায়ে প্রভাত ফেরীতে অংশগ্রহন পরবর্তী প্রায় সব ঘটনারই আমি একজন প্রত্য সাী। আর সাী হবার সৌভাগ্যের কারণ এই যে, আমার পলাশী ব্যারাক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এর হোস্টেল থেকে মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল বলা যায় পাথর ছোড়া (ঝঃড়হব ঞযৎড়)ি দূরত্বের মতই কাছে ছিল। তবে অতি অল্পদিনের মধ্যেই যখন বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হল, ২১শে ফেব্রুয়ারীকে সরকারী ছুটি ঘোষণা করল সরকার, মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের সরকারী বাসভবনকে বাংলা একাডেমীতে রূপান্তর করা হল এবং সর্বোপরি ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থান দেয়া হল, তারপর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন আমিতো বুঝেছিলাম চুড়ান্তভাবে মীমাংসিত ও শেষ হয়েছিল। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ প্রায় পাঁচ বছর আমি এক নাগাড়ে ঢাকাতে অবস্থান করি পড়াশুনার পর চাকুরীতে। বাংলাভাষার প্রশ্ন তখন স্বাভাবিকভাবে কারও মুখে শোনা যায়নি। যদিও ১৯৫৮ এর শেষ থেকে আয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন দেন এবং ১৯৬২তে ভিন্ন একটি শাসনতন্ত্র জারী করেন, তখনও কিন্তু ভাষা কোন নতুন ইস্যু হয়নি। কেননা, এই দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রেও একইভাবে দুটি ভাষাকেই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিল। তবে আয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে ১৯৬২ এর পর থেকেই ভিন্ন আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯৬৫ এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর সেই আয়ুব বিরোধী আন্দোলন পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে জোরদার হয়। এই ফাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসন আন্দোলন ৬ দফার ভিত্তিতে নতুন রূপ ধারন করলেও স্বাভাবিক কারণে বাংলাভাষা কোন প্রসঙ্গই ছিল না। কেননা সেটি অনেক আগেই সেটেল্ড বিষয় ছিল।
১৯৭০ এর নির্বাচন এবং তারই অনুসঙ্গ হয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, সেখানে বাংলাভাষা-উর্দু ভাষার একটি ুদ্র দ্বন্দ্ব এভাবে বিস্তৃত করানো হয় যে, উভয় ভাষীরা পরস্পরের শত্রু। এরই কিছু পৈশাচিক চিত্র ঘটে ১৯৭১ এর মার্চ থেকে মে মাসের প্রায় ১০ তারিখ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু প্রায় ১০ সপ্তাহের মধ্যে দেশের সর্বত্র আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করলে প্রায় সবকিছু বহুলাংশেই স্বাভাবিক হয়ে আসে মাঝে মাঝে সংঘটিত কিছু বোমাবাজি, বিচ্ছিন্ন খুন-খারাবীর পর ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ হলে পর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় বসে-প্রবাসী অবস্থান থেকে চলে আসার পর-দেশ চালানো শুরু করে। তাই প্রশ্ন করা যায় ১৯৫৬ সালের পরবর্তী ১৯৭১ পর্যন্ত ১৫টি বছর একুশ কিভাবে কতটুকু সম্পর্কিত ছিল? পরো সম্পর্ক যদি কিছু থেকেও থাকে, তা থেকে কি সুনির্দিষ্ট ও সঠিকভাবে ধরে নেয়া যায় যে ‘একুশ থেকে স্বাধীনতা’ একটি ধারাবাহিক বিষয় ছিল? এমনটি হলে কি ধরে নেয়া হয়না যে একুশের আগে বাংলাদেশের মানুষের কোন সংগ্রামের নমুনা নাই? একুশের আগে এদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য কোনকিছুই আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ ইত্যাদি কোনকিছুই করেনি?
ঐতিহাসিকরাই বলেন যে, বাংলাদেশের জ্ঞাত ইতিহাস অন্ততঃ কয়েক হাজার বছরের পুরাতন, হাল আমলে বৌদ্ধ সভ্যতা, সেনদের রাজত্ব এবং বৃটিশ এদেশ ১৭৫৭ সালে জবর দখল করার আগে এক নাগাড়ে ৫৫৪ বছর মুসলমানরা শাসন করেছিল। অনেকেই সেনদের মত বহিরাগত হলেও এখানেই তারা নিজেদের স্থায়ী আবাসস্থান গড়ে তুলেছিল। তারা ইসলামী সাম্যের শিায় এদেশীয়ই বনে গিয়েছিল। সেই সাড়ে পাঁচশ বছরের মুসলমান শাসন থেকে যখন বৃটিশরা ছলে বলে কৌশলে এদেশে কতৃêত্ব চালায় ১৯০ বছর ব্যাপী তখন তারা কি করেছিল? মুসলমানদের কোন্ অতলে নিপে করেছিল? হ্যাঁ, মুসলমানরা নিজেরাও এ জন্য কম দায়ী ছিল না। কিন্তু সেই অতল গহব্বর থেকে উঠে আসার জন্য, মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রত্যয় নিয়ে সেই ১৭৬৪ তে মীর কাসেম থেকে শুরু করে ফকির মজনু শাহ, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহর পথ ধরে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ এর মুসলিম লীগ হয়ে ১৯৪৭ এর পাকিস্তান রাষ্ট্রটির কায়েম কি কোন ধর্তব্যের বিষয় ইতিহাসে কোনভাবেই ছিল না? এই ১৯০ বছরে বাংলাদেশের মানুষ কি স্বাধীনতার জন্য কোন কিছুই করেনি? যতকিছু করেছে একুশ থেকে একাত্তর মাত্র?
বাংলাভাষার প্রশ্নে যদি আসা যায় তাহলেও বায়ান্নর একুশই কি সবকিছু? সেনদের রৌরব নরকের শাস্তির ভাষাকে কি সুলতানী আমল থেকে শুরু করে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী মুসলমানরাই উঁচুতে স্থান দেয়নি? নিজেদের ভাষা আরবী, ফার্সী-ছাড়াও তারা এদেশের মানুষের জন্য তাদের মত করে আরবী-ফার্সী সমৃদ্ধ বাংলাভাষাকে উন্নত করার সর্বাত্মক কোশেশ করেছিলেন। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করে বৃটিশ শাসক এবং তাদের স্তাবক সংস্ড়্গৃত পন্ডিতরা সেই মুসলমানি আমলের বাংলাকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক ষড়যন্ত্র যদি না করতেন, তাহলে এখন অন্য এক উন্নত বাংলাভাষা চালু থাকত এদেশে। ফোর্ট উইলিয়াম এর চেহারার বাংলাভাষায়ও এদেশের মানুষ অত ঘোর আপত্তি করত না, যদি না এদেশের সাধারণ মানুষের মুখের শব্দাদি ঝেটিয়ে তাড়িয়ে না দিত। কেননা, শব্দ তাড়ানোর সাথে সাথে মূল্যবোধও তাড়িয়ে দেয়ার তারা কোশেশ করেছিল। যদি তাদের ঐ কাজের বিপরীত আজতক মক্তব মাদ্রাসা চালু না থাকত তাহলে এদেশের মানুষ পূর্ণ তৌহিদবাদী থাকতে পারত কিনা সন্দেহ। কেননা, মুসলমানি আমলের বাংলাভাষার তাওহীদ সংরণ করার কারণে যেসব আবশ্যকীয় শব্দ ব্যবহার করত, তা ফোর্ট উইলিয়াম পন্থীরা বর্জন করা শুরু করেছিলেন। সেই বর্জন যে বাংলাদেশে কার্যকর নয় তার অসংখ্য প্রমাণ যেমন একটি ‘প্রয়াত’ যা এখানকার মানুষ ‘মরহুম’ (মুসলমান) কিংবা স্বর্গীয় (হিন্দু) ব্যবহার করাতেই আত্মিকভাবে স্বস্তি পায়। বাংলাদেশের শিক্ষার সর্বস্তরের কারিকুলাম সেই বাহাত্তর থেকে কোন লক্ষ্যে কলকাতা ও ভারতমুখী করা হচ্ছে তার জন্য দেখুন অধ্যাপক এম আই ইসলাম এর ‘জীবন স্মৃতি’, পৃষ্ঠা ৬২৩-৬২৫ (২০০৬ প্রকাশিত)।
একুশের সাথে স্বাধীনতাকে যুক্ত করায় অন্য যে সমস্যা জড়িত করা হয় তার একটি হল যারা এদেশে বাংলাভাষী নয়-যেমন চাকমারা, সাঁওতালরা, ইত্যাদি ুদ্র ুদ্র উপজাতিরা যারা একুশের সাথে কোনভাবেই জড়িত ছিলনা। তাছাড়া ১৯৭২ এর পরপরই ওদেরকে ‘বাঙ্গালী’ হতে বলায় তারা সেই যে বিদ্রোহ শুরু করেছে, যার শেষ বিগত ৩৬ বছরেও হয়নি। কবে হবে বলা যায় না। কেননা বাংলা ওদের মাতৃভাষা নয় (মাতৃভাষা শব্দটি সভ্য দেশে এখন ব্যবহার হয় না-তারা ব্যবহার করেন “প্রথম ভাষা” বা ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ)।
জাতিসত্তা গঠনের জন্য ভাষা একটি উপাদান। একমাত্র উপাদান নয়। ভিন্ন উপাদানগুলি হচ্ছে ভৌগলিক সীমানা, ঐ সীমানার জনগণ এবং সংগঠিত একটি সরকারের অধীনে নিয়মাবদ্ধ সকল মানুষ। একভাষী জাতি যেমন পৃথিবীতে আছে, তেমনি বহুভাষী জাতিও কম নয়। ভারতের প্রধান ভাষা ১২/১৪টি। তবু তারা একটি জাতি। তাছাড়া ভারতের প্রায় ৯ কোটি বাংলাভাষীরা ভারতীয় জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র। কেন তারা বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের সাথে একাকার হয়নি? না সাতচল্লিশে না একাত্তরের পর।হতে কি পারবে অদূর ভবিষ্যতে দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে? নাকি তারা চায় যে আমরাই যেন বরং দিল্লীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাই? এসব বিষয় চিন্তায় আনলে আমরা কি বুঝতে পারি? ১৯৪৭ পূর্ব দুই শতাব্দীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা কি প্রাসঙ্গিক বলে তখন মনে হতে পারে না?
যে তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলা ভাষা ইস্যু উত্থাপন করেছিলেন, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই যে, সেই আবুল কাসেমসহ, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর প্রমুখ সবার সাথেই আমার তাদের পরিণত জীবনে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তাদের কেউই আমাকে একথা বলেননি যে, তারা ‘একুশ থেকে স্বাধীনতা’ এর বিষয়ের মত কোনকিছু ঘুনারেও চিন্তা করেছিলেন। আমি যখন কাসেম সাহেবের মারাত্মক অসুস্থ্য অবস্থায় ১৯৮২ এর শেষে তার আজিমপুর রোডের বাসায় সর্বশেষ দেখা করতে যাই-তারপর আমি বেশ কয়েক বছরের জন্য লন্ডন চলে যাচ্ছিলাম-তখন তিনি সেই ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক কিছু কথাই আমার কাছে অকপটে স্বীকার করেছিলেন-আফসোসও করেছিলেন। তিনি যা কিছু আমাকে সেই অসুস্থ্য অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছিলেন তা আমি কথায় কথায় কারও কাছে কিছু বললেও লিখিতভাবে কোথাও বলিনি। আজও বলতে পারছিনা। তবে সেই ভাষা আন্দোলন এবং কাসেম সাহেবেরই অন্য একজন সহযোগী বা সহযোদ্ধা এবং ঢাকার মীরপুরে প্রতিষ্ঠিত তাদের বাংলা কলেজ এর প্রসঙ্গের একটি কথা ভাবছি উল্লেখ করা যায়। এই বাংলা কলেজের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্য এবং ভিন্ন একজন প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-প্রিন্সিপাল ছিলেন মতিয়ুর রহমান। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নবীনগর থানার আহমদপুর গ্রামের সরকার বাড়ীর ইয়াতিম আলী সরকার এর বড় ছেলে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র। মারাত্মক উৎসাহী ও কঠোর পরিশ্রমী লম্বা একজন ছাত্রলীগ কর্মী ও পরে নেতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনকে পরাজিত করার জন্য খালেক নেওয়াজ এর জন্য টানা এগারোদিন সেই নির্বাচনী এলাকায় ক্যাম্পেইন করে মারাত্মক অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ কিনা কত বড় ছাত্রলীগার এবং বাংলাভাষার জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মী ছিলেন তা সহজে আন্দাজ করা যায়। এই ব্যক্তিটি ১৯৬৪ সালে পিএইচডি করার জন্য লন্ডন চলে যান। সেখানে ইতিহাসে পিএইচডি করেন। তার স্ত্রীও পিএইচডি করেন। ১৯৭০ এ একবার দেশে এসেছিলেন বেড়াতে। এরপর আর আসেননি। ১৯৭১ এর পর ছয় ছয়খানা গবেষণা পুস্তক লিখেছেন। সবই বাংলাদেশ নিয়ে। ১৯৮২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী তিনি মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ঐ লন্ডনেই ইন্তেকাল করেন। এর কয়েক মাস পর আমি লন্ডনে যাই। তাই ১৯৭৪-৭৫ আমার সাথে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হলেও ১৯৮২ এর অক্টোবরে আমি দ্বিতীয়বার লন্ডনে গেলে আর তার সাথে দেখা হয়নি। তবে জেনে ছিলাম যে, তার ইচ্ছাতেই তার কবর হয়েছে ইসলামাবাদ জাতীয় কবরস্থানে (কবর নং-৩১, সেকশন চার)। বাংলাভাষার অন্য আর একজন ভেটারান সিলেট সুনামগঞ্জের মাহমুদ আলী যিনি কিনা ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা সরকারের রাজস্ব মন্ত্রী ছিলেন তিনি ১৯৭১ এর পর আর কোনদিনই তার নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেননি। ২০০৬ সালের ১৭ই নভেম্বর তিনি ৮৭ বছর বয়সে ইসলামাবাদেই ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই তার কবর হয়।
বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান বিটিভিতে আমি মনে করি যে, উপরোক্ত আলোচনার আলোকে একুশে ফেব্রুয়ারীর সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গকে জড়িয়ে ফেলা কোন যৌক্তিক বিষয় হতে পারে না। তাই এই বার্দ্ধক্যে বসে আশা করতে চাই যে, তারা বিষয়াদির নাম-টাইটেল চয়ন করার আগে আর একটু বেশী সাবধান হবেন।
তারিখঃ ০৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০০৮ইং
ইব্রাহিমপুর
কাফরুল, ঢাকা-১২০৬।