somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিশেল ফুকোর বাতি জ্বালানি - সলিমুল্লাহ খান ( দ্বিতীয় পর্ব)

২৫ শে জুন, ২০১০ রাত ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মিশেল ফুকোর বাতি জ্বালানি - সলিমুল্লাহ খান ( প্রথম পর্ব) এর লিঙ্ক


ফুকো একসময় বলতেন ‘আমি নিৎসের শিষ্য’। পরে দেখা গেলো কি উনি নিৎসের থেকে একটু গা মোচড় দিলেন। শেষ বয়সে উনিই প্রমাণ করলেন যে উনি কান্টেরও শিষ্য।

এখানে একটা কথা বলে রাখার দরকার আছে। আমরা যারা এয়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাস পড়তে চাই তাদের পক্ষে এই নামগুলো প্রথমে কতক ধূম্রজাল তৈরি করে। কান্টের লেখা আমরা সবটুকু পড়ি নাই। কাজেই আন্দাজ করে বলা যাবে না কান্ট কী জিনিস? সেটা ভারতীয় বিখ্যাত হাতির মত। কারো কাছে মনে হবে থামের মত, কারো কাছে কুলার মত, কারো কাছে ঢেঁকির মত। আমরা এখন দেখবো কান্টের কোন অংশটা কী? এইজন্য আমরা শুধু এইটুকু বলবো, এয়ুরোপে যে যুগটাকে এনলাইটেনমেন্ট বলা হয় সেটাকেই আমি খুব সংক্ষেপে বলছি আমাদের যুগ। অষ্টাদশ শতাব্দি বলে যে বড় শতাব্দি ওইটাই এনলাইটেনমেন্টের শতাব্দি। মনে হতে পারে, আমিও মানুষের চোখে একটু ধুলা দিতে পছন্দ করি। কিন্তু আসলে তা নয়। মনে হয় আমরা এখনও কান্টের যুগেই আছি। নচেৎ আমাদের বাতিজ্বালানি শেষ হয় না কেন?

এখন কান্ট সাহেবের প্রবন্ধটাও লেখা হয়েছে একই নামে। কান্ট লিখেছেন হিসেব করে দেখেন সেই ১৭৮৩ বা ১৭৮৪ সময় নাগাদ। এটা অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ পর্যায়। তার মানে আমি এটা বলতে পারি, আমরা বলি কি, ‘দি ওউল অব মিনার্বা বিগিনস্ ইটস্ ফ্লাইট ওনলি আফটার ডার্ক।’ এটা হেগেলের বিখ্যাত উক্তি। মিনার্বা দেবির পেঁচাটি উড়াল শুরু করে সূর্য যখন অস্তাচলে বসে ঠিক তখন। অন্ধকার হয়ে আসছে যখন তখনই পেঁচা রাষ্ট্র হয়। দিনের বেলা পেঁচা বের হতে পারে না।
‘পেঁচা রাষ্ট্র করে দেয় পেলে কোন ছুতা,
জানো না সূর্যের সঙ্গে আমার শত্রুতা?’

কাজেই দিনের বেলা সে বের হতে পারে না। তাই উনি বলছেন, যখন কোনো ঘটনা ঘটতে থাকে, তখন দার্শনিকের পক্ষে তাকে বোঝা হয়ত সম্ভব হয় না। ঘটনা যখন শেষ হয়ে যায়, দার্শনিক তখনই তার সূত্র তৈরি করেন।

কান্টের ক্ষেত্রে সেটা সত্য মনে হচ্ছে। এনলাইটেনমেন্ট প্রায় শেষ পর্যায়ে যখন এসে পৌঁছেছে এয়ুরোপে তখনই কান্ট এই প্রবন্ধটা লিখে বলছেন, ‘এনলাইটেনমেন্ট’ বলতে আপনারা এতদিন যা মনে করতেন, এনলাইটেনমেন্ট তা নয়।’ ‘ইট ইজ সামথিং ডিফারেন্ট।’

তাহলে এনলাটেনমেন্ট বলতে আসলে এতদিন কী মনে করতেন এয়ুরোপের দার্শনিকরা? দুই একজনের নাম নেন। এনলাইটেনমেন্টের মধ্যে বড় দার্শনিক কারা? যেমন ভলতেয়ার। যাকে কখনো গুরু মানেন আমাদের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী শিবনারায়ণ রায়। তাঁর সম্পাদিত জিজ্ঞাসা পত্রিকা ঢাকায় আসতো বলে আমরা কিছু পড়েছি। উনি এখনো মনে করেন যে আমাদের বাংলাদেশের বা ভারতের মতন তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর সমস্যা এনলাইটেনমেন্টের সমস্যা। আমরা এখনো যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক দিব্যদৃষ্টি লাভ করি নাই। শিবনারায়ণ রায়ের বক্তব্য অনুসারে এনলাইটেনমেন্টই আমাদের মত গরিব দেশের প্রধান সমস্যা।

তো এনলাইটেনমেন্ট মানেটা কী? আক্ষরিক অর্থে ধরেন আপনি সন্ধ্যাবেলা একটা বাতি জ্বালান। সেটাই এনলাইটেনমেন্ট। যেখানে আগুন নাই, সেখানে আগুন নিয়ে আলো করা। এখন আগুনের দুটা সমস্যা। ইট জেনারেটস বোথ লাইট এন্ড হিট। এখন আপনি যদি এমন একটা আগুন দেখেন হুয়িচ জেনারেটস মোর হিট দ্যান লাইট, তাহলে সেটা অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। আমরা আগুন এনেছি আলো করার জন্যে, কিন্তু অধমদের দেশে ঘটে যায় অগ্নিকাণ্ড। আমরা মনে করি কি এনলাইটেনমেন্ট বলে একটা আদর্শ এয়ুরোপে তৈরি হয়েছে, সেটা আমরা আমদানি করেছি, ইচ্ছায় হোক আর বাধ্য হয়েই হোক। এইটা আমাদের দেশে আগুন জ্বালিয়েছে। আগুন আলোর জন্য না অগ্নিকাণ্ড ঘটানোর জন্য সেটাই বিচার্য বিষয়। শিবনারায়ণ রায় মনে করেন, আগুন জ্বালানোই আমাদের দায়িত্ব, তা অগ্নিকাণ্ড ঘটাবে না আলোক দান করবে সেটা পরের ব্যাপার।

এই ধরনের একটা এটিচুড আছে। এই এটিচুডের একটা উদাহরণ ‘গোলাম মুরশিদ’। তিনি আমাদের এখানে শিব রায়ের ছাত্র। উনি একটা বই লিখেছেন। নাম রিলাকটেন্ট দেবুতাঁত (Reluctant Debutante)। বাংলা মানে লিখেছেন ‘সংকোচের বিহ্বলতা’। এই নামে উনিই বাংলায় অনুবাদ করেছেন, নিজের বই নিজেই। সেখানে বলছেন, মেয়েরা যে প্রথম হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, আস্তে আস্তে পুরুষেরা মেয়েদের শিক্ষিত করলেন এইটাকে হলো এনলাইটেনমেন্ট। এনলাইটেনমেন্ট সম্পর্কে অনেক আলোচনা আছে। আমি এখানে একটাই বললাম।

আরেকটা হল, এনলাইটেনমেন্টের প্রধান শত্রুর নাম যে জিনিশ তাকে তাঁরা বলেন কুসংস্কার। প্রথমে সংস্কার এবং তার আগে কু লাগিয়ে দিলেন। তাঁরা মনে করেন ঝাড় ফুঁকে বিশ্বাস, পীর ফকিরে বিশ্বাস এগুলোই কুসংস্কার। এটা বলতে বলতে তাঁরা বলেন যে কোনো ধর্মে, মানে নীতিটীতিতে বিশ্বাস করাও কুসংস্কার। এনলাইটেনমেন্টের মূল মেসেজ এইটা।

এনলাইটেনমেন্ট ওয়াজ নোওন ইন এয়ুরোপ এজ এন্টি-রিলিজিয়ন। যেটা থেকে আজকের সেক্যুলারিজম কথাটা তৈরি হয়েছে। শিব রায় বলেন ‘আমরা নাস্তিক।’ এটা বলেন তাঁরা ঘরের মধ্যে। আর পাবলিককে বলেন কি ‘আমরা এনলাইটেন্ড পিপল।’ এখন এইটারই একটা কুৎসিত অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মহাশয়: ‘আলোকিত মানুষ’। এনলাইটেনড মানে আলোকিত। আলোকিত শব্দটা খেয়াল করছেন? যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, যেমন আমি এখানে আছি। আর ওখানে বাতি জ্বলছে। আমি আলোকিত হলাম না? আলোটা বাইরে থেকে আসছে। কিন্তু কান্টের লেখা পড়লে আপনি দেখবেন, আমার ভেতর থেকে যদি আলো আসতো, আলো বের হতো তাহলে আমি তো আলোকিত হতাম না, হতাম আলোকদানকারী।

সে হতো ‘আলোকিত’ নয়, ‘আলোকক’। আলোকিত বা আলো মুরগি হবে কেন সে? সে হবে ‘আলোকক’ বা আলো মোরগ। উনি যেটা করছেন সেটা আলো মুরগি বলেই মনে হয়। আসলে এইটা কী? যদি আপনি মার্ক্সের ভাষায় দেখেন, এয়ুরোপের প্রবলেম এমনই। ধনিক শ্রেণী চেয়েছে, আমাদের গরিবরা, আমাদের কথামত চলবে। আমরা তাদের ভালো করে একটু খাওয়াবো পরাবো। তাদের ঠিক যে পরিমাণ বিদ্যা দরকার এ পরিমাণ দেব। যেমন ক্লাস ফাইভ। যেমন এখানে ব্রাক বলে, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়লেই যথেষ্ট। সেই রকম আর কি ।

এই ধরনের মতবাদই এনলাইটেনমেন্টের মতবাদ হিসেবে তৃতীয় বিশ্বে আসছে। এয়ুরোপে কী ছিলো সে কথা আমরা মিশেল ফুকোকে বলতে দেব। আমাদের দেশে এর মানে হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, নারী শিক্ষা এবং ঠিক সেইটুকু শিক্ষা যেইটা শুধু দরকার। এইটার নাম হয়েছে ইনফর্মাল এডুকেশন। আর কী বাজে এর বাংলা তর্জমা, ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা’! এইজন্য তাঁরা লাখ লাখ কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছেন। কমনওয়েলথ্ এডুকেশন ফান্ড ইত্যাদি আবরণে হেন কাজ নাই তারা করছেন না। লোকগুলোকে ‘শিক্ষিত’ করতে হবে। শিক্ষার আলো বিলাতে হবে।

শিক্ষার সংজ্ঞা কী? সংজ্ঞাটা স্বচ্ছ বটে: যেটুকু করলে সে করে খেতে পারবে, পরতে পারবে। কান্ট সাহেবের সংজ্ঞাটা ঠিক সেইরকম নয়। আমি এই জন্যই বলছি, যখনই আমরা কোনো শব্দ পাব, শব্দটার গিভেন যে অর্থ বাজারে সেটাই আমাদের মাথায় প্রথমে লাফ দিয়ে আসবে। কিন্তু দেখবেন যে ওইটার বিরুদ্ধে লড়াই একটা করতে হবে আপনাকে। নইলে আপনি একজনের রক্ত আরেক জনের গায়ে দেবেন। উদোর পিণ্ডি দেবেন বুদোর ঘাড়ে ।

আমি প্রথমেই বলেছিলাম জানতে হবে পরিবর্তনটা কেন? তথাকথিত হিয়ুম্যানিজম বা মানবতাবাদের সমালোচক হিসেবে জন্মগ্রহণ করার পর মিশেল ফুকো হঠাৎ করে এনলাইটেনমেন্টের ভক্ত হয়ে উঠলেন কেন?

তাঁকে তো কিছু একটা করতে হবে। উনি বললেন, এনলাইনটেনমেন্ট কথাটাকেও আমি খৎনা বা ক্যাসট্রেট করাবো। দ্যা ওয়ার্ড ইটসেলফ্ হ্যাজ টু বি ক্যাসট্রেটেড। এর মধ্যে দুইটা অর্থ মিশে আছে। এনলাইটেনমেন্ট অর্থে এতদিন বলা হতো, আলোকিত করা। উনি বললেন, না তা নয়। বলছেন, এনলাইটেনমেন্ট অর্থ আলোকক তৈরি করা। যে লোক আলোর দ্বারা আলোকিত হয় না, যে নিজেই আলো দেয়, এমন লোককেই প্রকৃত প্রস্তাবে বলা হবে এনলাইটেনড ম্যান। উনি রেফারেন্স দিলেন কান্ট সাহেবের। কান্ট ভরসা ফুকো। খেলা জমলো।

এখানেই ফুকোর মূল বক্তব্য। এনলাইটেনমেন্ট মানে আগে বলা হতো হিয়ুম্যানিজম। হিয়ুম্যানিজমের ভেতর কী আছে। হিয়ুম্যানিজমের ভিতর আছে একটা গোঁয়ার গোবিন্দ, একটা এরোগেন্স। এরোগেন্সটা কী? ম্যান হ্যাজ রিপ্লেস্ড গড এজ দি সেন্টার অব হিয়ুম্যান অ্যাটেনশন। এইটাই বটে হিয়ুম্যানিজম। এটা আসছে কোথা থেকে ? কোপারনিকাস আর কেপলার থেকে। সৌরজগতের কেন্দ্র আর পৃথিবী নয়, সূর্য। এইটাও একটা মতবাদ। কেন্দ্র কী? এই কথাটার মধ্যেই মতান্ধতার নিশানা হাজিরনাজির আছে।

তারপর একদিন বোঝা গেল কিনা মানুষ ‘আশরাফুল মখলুকাত’ এই কথাটাও ঠিক নয়। মানুষ আর পাঁচটা প্রাণীর মতই আরেকটি প্রাণী বটে। এটা ডারুয়িন বললেন।

তারপর সবশেষে জানা গেল, মানুষ যুক্তিশীল এটাও ঠিক নয়। মানুষের মধ্যে যুক্তি ও অযুক্তির সমান প্রাধান্য এবং মানুষ যে অতিরিক্ত আত্মম্ভরিতার সঙ্গে বলেছে আমরা যুক্তিশীল, আসলে মানুষের ইতিহাস দেখলে তা সত্য মনে হয় না। এই দুনিয়ায় যত যুদ্ধবিগ্রহ এবং যত অন্যায় অবিচার সেইগুলিও যদি মানুষই করে থাকে তবে মানুষ একাধারে যুক্তিশীল এবং অন্যাধারে যুক্তিহীন দুটো কথাই সত্য এ কথা একসাথেই বলতে হয়। ফ্রয়েডের আবিষ্কার এ ছাড়া আর কী?

foucault001.jpg
মিশেল ফুকো

তবে হ্যাঁ, মানুষ কথা বলে । এই অর্থে যদি আপনি বলতে চান মানুষ যুক্তিশীল তবে ঠিক আছে। জাক লাকাঁ দেখাচ্ছেন এ সত্যে আত্মম্ভরিতার কিছু থাকছে না। কারণ মানুষ যতটা না ভাষার মনিব, তার চেয়ে ঢের বেশি তার গোলাম। মানে দাস। দাশ নয়; দাস।



তিনটা অংকুর আছে হিয়ুম্যানিজমের। একটা: ম্যান এজ দি সেন্টার বা কেন্দ্রাভিমানী মনু বা মনিশ্বর। লক্ষ্য করেন, এই আইডিয়াটা। মানুষ ঈশ্বরের জায়গা দখল করেছে। এই এরোগেন্সেরই নাম ছিলো হিয়ুম্যানিজম। কথাটার বাংলা দাঁড়ায় মনিশ্বরবাদ। এটা আমি বানালাম। আর ওই এরোগেন্স প্রচারক বা পয়গম্বর আন্দোলনের নাম এনলাইটেনমেন্ট। ইহার বাংলা হতে পারে বাতিশ্বরবাদ। তাতে বোঝায় কী? বোঝায় মানুষ নিরন্তর প্রগতিসাধন করছে। প্রগ্রেসকে আমরা বাংলায় বলেছি প্রগতি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রগতি হয়েছে। আগে মানুষ বনেজঙ্গলে ছিল, তারপর মানুষ গ্রাম করেছে, এরপর শহর করেছে। এখন শহর থেকে মানুষ চাঁদে যাবে। ধরেন এইটাই প্রগতির ইতিহাস।

মানুষ জঙ্গলে ছিল। সেখানে মানুষ কী করতো? মানুষ সেখানে ছিল পেগান। তারা প্রকৃতি-পূজারি ছিল। তারপর একসময় তারা বুঝতে পেরেছে প্রকৃতিপূজা নয় কোন দেবির কি দেবতার পূজা করতে হবে। তারপর মানুষ ভাবল, না, না, গোষ্ঠী বা জাতি (ট্রাইব) পূজা এসবও ঠিক নয়। সমগ্র নিখিল জগতের এক প্রতিপালক আছেন তাঁর পূজা করতে হবে। এখন নয়া এনলাইটেনমেন্ট বলছে, আসলে নিখিল জগতের একমেবাদ্বিতীয়ম যে প্রতিপালক আছেন সে সত্যও মিথ্যার রকমফের বৈ নয়। এই প্রগতির ধারণা এইভাবে দেখা যাচ্ছে। তাহলে এই ধারণাগুলির ধারাকেই আমরা বলছি এনলাইটেনমেন্ট।

মানুষ এখন বুঝতে পারছে এই বিরূপ বিশ্বে সে নিয়ত একা। তার কোন প্রভু নাই। যে পরিমাণে সে নিজেই নিজের প্রভু সেই পরিমাণেই সে অসহায়। ফ্রিডম ইজ এ ডেঞ্জারাস থিং। ম্যান হ্যাজ টু নো হি ইজ ফ্রি এন্ড হি ইজ এলোন ইন দ্যা ইউনিভার্স। এই যে মনোভাব, এটাই এনলাটেনমেন্টের বক্তব্য হিসেবে জারি আছে।

তার সাথে যুক্ত হলো এটা ও সেটা। জোর ও জবরদস্তি। ধর্ষকাম ও বলপ্রয়োগ ছাড়া এনলাইটেনমেন্ট হয় না। আমি বললাম অসুবিধা কী, তুমি তোমার মনোভাব নিয়ে তোমার বাড়িতে থাক আর আমি আমার মনোভাব নিয়ে আমার বাড়িতে থাকি। কিন্তু তা তো নয়। বাতিওয়ালা বলে বসে: তোমাকে আমার মতবাদ গ্রহণ করতে হবে। নইলে আমি তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব।

এই যুদ্ধ নিয়ে এয়ুরোপ গেল আমেরিকায়। সে আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের বললো, তোমরা তোমাদের এই প্রাগৈতিহাসিক ধারণা নিয়ে থাকতে পারবে না। তোমাদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে হবে। শুধু গ্রহণ করলেই যথেষ্ট হবে না। তোমাদের বৈজ্ঞানিক ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। সেক্যুলারিজম গ্রহণ করতে হবে এবং মাঝে মাঝে খ্রিস্টধর্ম এবং সেক্যুলারিজম এক হয়ে গেছে। এটার লম্বা ইতিহাস। তাঁরা একহাতে বাইবেল আরেক হাতে রাইফেল নিয়ে গেছে। জয় করেছে। জয় করে তাঁরা সেখানে সভ্যতা কায়েম করেছে। এটার নাম এনলাইটেনমেন্ট।

এনলাইটেনমেন্ট একটা দার্শনিক মতবাদ মাত্র নয়। এটা একটা রাজনৈতিক আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরে, সবশেষে বলা হচ্ছে কি এনলাইটেনমেন্টের ফলে আমরা যারা আমেরিকান-ইন্ডিয়ানদের মত সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাই নাই - চীন, আরব বা আফ্রিকা এই সমস্ত দেশের মানুষ - যারা এয়ুরোপের সংস্পর্শে এসেছে তারাও এয়ুরোপের মতবাদ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এখন আমরা আমাদের দেশে এমন সব মানুষ তৈরি করেছি যারা এয়ুরোপীয় মতবাদকে আমাদের ভাষায় প্রচার করেন এবং সেই প্রচার বাবদ তারা যেই যুক্তি দেন সেইটাই এনলাইটেনমেন্টের যুক্তি। মানুষকে আলোকিত হতে হলে এই কুসংস্কার সেই কুসংস্কার বাদ দিতে হবে। ইনফ্যাক্ট সমস্ত সংস্কার বাদ দিতে হবে।

এখন আমাদের সমালোচনা হবে: কুসংস্কার বাদ দেওয়া সম্ভব, কিন্তু সমস্ত সংস্কার বাদ দেওয়া কি সম্ভব? নাকি এনলাইটেনমেন্ট নিজেও একটা সংস্কার নয়? মিশেল ফুকো এই কথা জিজ্ঞেস করেছেন। উনি বলছেন, এনলাইটেনমেন্ট নিজেও একটি সংস্কার। তাহলে সেটা কী সংস্কার? সেটার আগে কি ‘ক’ু কথাটা ব্যবহার করা যায়? ধরুন, এনলাইটেনমেন্টও আরেকটি কুসংস্কার। এক কুসংস্কারের বদলে তবে আপনি আরেক কুসংস্কার আনছেন। তাই না? তার বিরুদ্ধে লড়াই করার দাওয়াটা কী আপনার? এই হচ্ছে জিজ্ঞাসা।

এনলাইটেনমেন্ট জিনিসটা ভালো কেন? উনি বললেন, এনলাইটেনমেন্ট এমন একটা মতবাদ যে নিজের খাওয়াইর ভিতরই নিজের দাওয়াই তৈরি করে নেয়। ওর বিষের মধ্যেই ওষুধ আছে। এনলাইটেনমেন্ট ইজ এ ডকট্রিন অব প্রগ্রেস অব ম্যানকাইন্ড। সামন্তবাদের পরে পুঁজিবাদ আর পুঁজিবাদের পরে সমাজতন্ত্র। এটাকে বলে গ্রান্ড ন্যারেটিভ অব প্রগ্রেস। অথবা কুসংস্কার থেকে সুসংস্কার।

কিন্তু তার ত্রুটিটাও এইখানে। এটা খোদ কার্ল মার্ক্সই বলেছেন। আজ পর্যন্ত যত ধর্ম এসেছে পৃথিবীতে সব ধর্মই বলেছে কি না আমি সত্য, আমার আগের সব ধর্মই মিথ্যা, সব ভুল। আমিই হইলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম, সঠিক ধর্ম। খ্রিস্টধর্মের মূল আর্গুমেন্টটা কী? আর্গুমেন্টটা এইমতো: আমরা এয়াহুদি জাতির সন্তান, কিন্তু বর্তমান এয়াহুদি যারা রাব্বাই আছেন, তারা ধর্মটাকে বিকৃত করেছেন। কাজেই ধর্মটাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য আরেকজন নতুন নেতা এসে গেছেন। তিনি ‘হযরত ঈসা’। আমরা তাঁর অনুসারী। তিনি ভগবানের বা ভগওয়ালার পুত্র। সুতরাং আমাদেরটাই সঠিক ধর্ম। ইতোপূর্বে আগের ধর্ম যেহেতু বিকৃত হয়েছে তাই সেটা বাতিল। এটাই সর্বশেষ ধর্ম।

একই যুক্তিতে ইসলামের শর্তও এই: ইসলামই সর্বশেষ ধর্ম। ইসলাম এমবডিস দ্যা লেটেস্ট ট্রুথ, সর্বশেষ সত্য। আমার শেষ বহির ধর্ম, লাস্ট রিভিলড রিলিজিয়ন। আর কোন রিভিলড রিলিজিয়ন আসবে না। অর্থাৎ এই পর্যন্ত যেগুলো এসেছিল সব বাতিল। এখন ইসলামের পরে কে আসবে? ইসালামের পরে শুধু ইসলামই আসতে পারে। আর কিছু আসতে পারে না। হোয়াটয়েভার কামস মাস্ট বিন উয়িদিন ইসলাম। যদি এটা ইসলাম-বিরোধী হয় তাহলে এটা বাতিল অথবা ইসলামের ভিতরের হয় তাহলে এটা এর অংশ। আবার আরেকটা ইসলামের দরকার নাই। দি সেইম ইসলাম দেয়ারফোর কেন নট বি ইমপ্রুভড।

এখন মজার বিষয়, ধনতন্ত্রের ইতিহাসও একই যুক্তিতে এগিয়েছে। এটা কার্ল মার্ক্স বলছেন। উনি বলছেন যে একসময় পৃথিবীতে মানুষ বনেজঙ্গলে থাকতো, সেখান থেকে কিছু মানুষ কিছু মানুষকে দাস করেছে দাস প্রথা তৈরি করেছে। তারপর মানুষ সামন্ত—প্রথা - তৈরি করেছে। কিছু মানুষ কিছু মানুষের সার্ভেন্ট থাকবে। তারপর এখন আমরা তৈরি করছি ধনতন্ত্র। এই তন্ত্রে বলা হয়েছে কি সবাই স্বাধীন। কিছু লোক শ্রমিক, কিছু লোক পুঁজিপতি থাকবে। তার মধ্যে সকলে সমান। কিন্তু আবার সকলে সমান নয়। অদ্ভুত যুক্তি। যাঁর সম্পত্তি আছে সে, যার সম্পত্তি নাই তাকে নিজের কাজে খাটাতে পারে। তখন সে বলে যে, আপনিও একজন মজুরি শ্রমিক। তবে আপনি যদি ডাক্তার হন, তবে ইউ আর ওনলি এ হাইলি এফিশিয়েন্ট ডে ‘লেবার’। আপনার বেতনটা একটু বেশি, কিন্তু চরিত্র একই।

এই মতবাদটি অ্যাডাম স্মিথ প্রচার করলেন: ‘ধনতন্ত্রের পরে পৃথিবীতে আর কোন তন্ত্র নাই’। এটাই শেষ তন্ত্র, লাস্ট রিভিল্ড স্যোশাল সিস্টেম। ক্যাপিটালিজম ইজ দ্যা নিউ ইসলাম অব মডার্ন টাইমস। ধনতন্ত্রই আধুনিক জমানার শেষ এসলাম। এরপর আর কোন রিভিল্ড স্যোশাল সিস্টেম থাকতে পারে না।

এই যে মতবাদ, এনলাইটেনমেন্টও তাই। ভলতেয়ার ও দিদ্রো প্রভৃতি ফরাসি দার্শনিক বললেন, ‘আমরা যে সংস্কারে এসে উপনীত হয়েছি, সেটা পৃথিবীর শেষ সংস্কার’। মিশেল ফুকো বললেন, ‘এই কথা ঠিক নয়।’। এনলাইটেনমেন্ট জিনিসটাকে আমরা কেন বেছে নেবো, এটাও যদি আগের মতই হয়? উনি বলছেন, ‘আমি যদি এয়াহুদি ধর্ম ত্যাগ করি তাহলে আমি খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করবো না কেন? আর খ্রিস্টধর্মই যদি ত্যাগ করতে পারি তবে ইসলাম ত্যাগ করবো না কেন? সুতরাং আখেরি যুক্তি, লাস্ট লজিক হচ্ছে কি আমি কোনো ধর্মেই থাকব না।

ওঁর বক্তব্য: আমি যদি সামন্তবাদ ত্যাগ করতে পারি, দাসপ্রথা ত্যাগ করতে পারি, ধনতন্ত্র ত্যাগ করতে পারি তাহলে আমি সমাজতন্ত্রে আসব না কেন? উনি আরও বলেন ‘অবশ্যই আসব, কিন্তু এত যখন ত্যাগ করলাম তাহলে সমাজতন্ত্রটা ত্যাগ করতে অসুবিধা কী?’ তাঁর প্রশ্ন, ‘আমি যাব কোথায়? আমার তো একটা লক্ষ্য দরকার’। এই হলো ক্রাইসিস এর পর্যায়।

এইখানে, এই যে আমি আপনাদের সামনে একটা গোলকধাঁধার মত অবস্থা উপস্থিত করলাম, এটাই হচ্ছে মিশেল ফুকোর সার বক্তব্য। উনি বলেছেন, ‘মানুষের কোন আলটিমেট তন্ত্র থাকতে পারে না। কোন আলটিমেট ধর্ম থাকতে পারে না’। তাহলে, আপনাকে প্রতিদিনই নিজের ধর্ম নিজে রচনা করতে হবে। প্রতিদিনই নিজের তন্ত্র নিজে রচনা করতে হবে।
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×