আমাদের এই পৃথিবীতে হাজারো জীবের বসবাস। তার মধ্যে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অন্যদিকে মানুষ নিঃসঙ্গ বসবাস করতে পারেনা। একত্রে বসবাস করা মানুষের সহজাত প্রবৃদ্ধি। এই জন্য জীবন ধারণ ও বেঁচে থাকার জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সমাজ বহির্ভূতকে মানুষ ভাবা যায় না। মূলত জন্ম মৃত্যু ও কর্ম সবলই সমাজ জীবনের অভিব্যক্তি। পবিত্র আল কুরআনের মতে: যেদিন আদম হাওয়ার সৃষ্টি সেদিন মানব সমাজের সৃষ্টি।
এই সমাজ পরিচালনায় ইসলাম কিছু নীতিমালা বেঁধে দিয়েছে। যাকে ইসলামী সমাজতন্ত্র বলা হয়ে থাকে।
ইসলামী সমাজতন্ত্র:
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজের নীতিমালাকে ইসলামী সমাজতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। মূলত রাসূল (সঃ) এর মক্কী জীবনেই ইসলামী সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে অতঃপর সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার করার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমিক ভাবে তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে রাসূল (সঃ) এর সময়ে একদল আরব নাবিক মালাবার উপকূলে বাণিজ্য উপলক্ষে আগমন করেন এবং ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু স্থানে ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠ করেন।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে ইসলামী সমাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। অতঃপর ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ইসলামী সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
ইসলামী সমাজতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে এর অনেকগুলো নীতিগত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। যেমন:
১. একতা:
একতা হলো ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলামী সমাজবদ্ধ মানুষ সর্বদা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। কেননা ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাসের ফলে সমাজের উন্নয়ন সাধন হয়, সমাজে খারাপ কিছু প্রবেশ করে সমাজকে ধ্বংষ করার স্পর্ধা দেখাতে পারে না।
২. সংঘবদ্ধতা:
সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করা ইসলামী সমাজতন্ত্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ সবাই একই সংঘের আওতায় এসে শান্তি সুখের সমাজ গড়ে তোলে।
৩. সামাজিক সম্পর্ক:
সমাজ সামাজিক সম্পর্কের নিবিড় বন্ধন। প্রত্যেক ব্যক্তি কোন না কোন সমাজের সদস্য। ফলে এ সম্পর্কে মানুষকে সমাজের আওতাভূক্ত করে রাখে।
৪. স্থায়িত্ব:
মানব সভ্যতার আদিতে সমাজ ছিলো, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ইসলামী সমাজতন্ত্রে সমাজের স্থায়িত্ব স্বাভাবিক রাখতে অবদান রাখে।
৫.সামাজিক মূল্যবোধ:
ইসলামী সমাজতন্ত্র সামাজিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলে সমাজ উন্নয়নে সকল মানুষকে একত্রিত করে এবং নানামুখী কার্যক্রম হাতে নেয়।
৬. সহযোগিতা:
ইসলামী সমাজতন্ত্রে সহযোগিতা অন্যতম একটি বিষয়। নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় ইসলামী সমাজতন্ত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যেমন: ইসলামী সমাজতন্ত্রে সুদ-ঘুষ হারাম করা হয়েছে।
৭. সামাজিক মূল্যবোধ:
ইসলামী সমাজতন্ত্র সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। এটি ইসলামী সমাজতন্ত্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
ইসলামী সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য:
ইসলামী সমাজতন্ত্রের নানাবিধ উদ্দেশ্য রয়েছে। তার মধ্যে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক সমাজ পরিচালনা এবং জনকল্যাণ হলো ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য। ইসলামী সমাজতন্ত্র মানুষের কল্যাণ সাধন, সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে।
ইসলামী সমাজতন্ত্রে মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:
ইসলামী সমাজতন্ত্রে মুসলমানদের উপর বেশ কিছু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। যেমন: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ, অন্যায়ের প্রতিবাদ, ঐক্যবদ্ধ থাকা, আল্লাহর পথে আহ্বান, সুদ ব্যবস্থার উচ্ছেদ, ঘুষ বন্ধ করা, কালোবাজারি বন্ধ করা, জুলুম বন্ধ করা, পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা, সমাজের উন্নয়ন সাধন, শিক্ষার মর্যাদা প্রদান, রোগীর সেবা, অমুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
ইসলামী সমাজতন্ত্রে মুসলিম চরিত্র:
চরিত্র কথাটি ক্ষুদ্র হলেও এর অর্থ বেশ ব্যাপক।আর মানব জীবনের ছোট-বড় সবকিছুই চরিত্রের অন্তর্ভূক্ত। তাই মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রেই উত্তম চরিত্র গঠনে ইসলামী সমাজতন্ত্র গুরুত্ব আরোপ করে থাকে।
মানব রচিত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ জড়বাদী এবং প্রয়োগবাদী দর্শন দ্বারা পরিচালত হওয়ার ফলে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক সম্বন্ধে চিরস্থায়ী সত্য বলে কোন কিছু নেই। ফলে মানব রচিত এই সমাজতন্ত্র মানব চরিত্রে ময়লা লেপন করে। তাই সচেতন মহল যুগে যুগে ইসলামী সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে আসছেন।
ইসলামী সমাজতন্ত্র ও আধুনিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য:
আল্লাহর দাসত্বের চেতনাবোধ থেকে যে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা তাকে ইসলামী সমাজতন্ত্র বলে। অন্যদিকে, বিশেষ কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মানব রচিত সমাজ ব্যবস্থাকে আধুনিক সমাজতন্ত্র বলা হয়ে থাকে।
তাই আদর্শিক দিক থেকে উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যামান।
সমাজতন্ত্রের প্রভাবে মানব সমাজ সামজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়। মানব রচিত সমাজতন্ত্র সমাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল করতে ব্যার্থ হয় এবং ইসলামী সমাজতন্ত্রই সমাজের সকল প্রকার উন্নয়ন এবং মানব উন্নয়নে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় মানুষ সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের অসৎ উদ্দেশ্যে ইসলামী সমাজতন্ত্রকে অবহেলা করে মানব রচিত সমাজতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে এবং বরাবরই তারা হতাশা ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছে না।
সুন্দর সমাজ গঠনে, সমাজ পরিবর্তনে ইসলামী সমাজতন্ত্রের বিকল্প নেই।