তিন পাগলের হল মেলা 'ন' দে এসে। কিন্তু এখানে তিন নষ্ট (NSTU) পাগলের মেলা বসেছে জার্মানির Augsburg সিটি তে।
পাগল বললাম কারন আমরা যা করতে যাচ্ছি তা অনেক টা পাগলামি ই বটে।
-ক্রিসমাসের পর জার্মানদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে তুষার পাত শুরু হলে ও আমাদের জন্য অনেকটা অভিশাপের মত ই। কারন ওই তুষার পাত ঘরে বসে জানালা দিয়ে দেখতে ই ভালো, কিন্তু ওইটার মাঝে হাটার মত যন্ত্রণা ভালো কোন ফিলিংস নাহ।
-তার উপর পরের দিন আমার জার্মান ইতিহাসের সেরা শীত পরার কথা, -১৫ থেকে -২৬ হতে পারে। এই শীতের মাঝে বাহিরে যাওয়া পাগলের পাগলামি।
- তার উপর ওইদিন রাত ১২ টায় বাসায় ডুকেছি কাজ শেষ করে, পরেরদিন রবিবার, সপ্তাহের একটা মাত্র ছুটির দিন, সোমবার সকাল ৬ টায় আবার কাজে যেতে হবে।
কিন্তু ওই যে বললাম পাগলের মেলা বসেছে। তাই রাত ১২.৪৫ এ প্লান করে ফেললাম অস্ট্রিয়া যাবো পরের দিন। যে ভাবা সেই কাজ।
সবাই কে কল করা শুরু করলাম। কিন্তু কেউ শীতের দোহাই দিলো, কেউ বান্ধবীর উষ্ণ বন্ধন ছাড়তে পারবে না, কেউ টাকার মায়া ছাড়তে পারবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০ জনের একটা গ্রুপ দাড়া করাই ফেললাম রাত ২ টা নাগাদ।
সকাল ৭.৩০ এ মিট করার কথা সবার, কিন্তু সকালে বাঙ্গালির নর্মাল কাহিনী মত মাত্র ৫ জন হাজির, বাকিদের নানা কাহিনী। ওকে ৫ জন ই সই।
সকালে ট্রাম ধরে আউসবুরগ থেকে মিউনিখ, তারপর ট্রেন বদলাই সালসবুরগ।
সারা রাস্তা বৃষ্টির মত তুষার পাত, বিরামহীন ভাবে।
ট্রেনে তো ভালো ই ছিলাম, নামার পর ই বুঝতে পারলাম ঠাণ্ডা কি জিনিষ, মনে হল কেউ কষাই একটা থাপ্পর দিয়েছে।
তারপর নিচে নেমে ইনফো সেন্টার থেকে তথ্য নিয়ে পরলাম মহা চিন্তায়, কোথায় যাওয়া যায়।
১। ক্যাবল কারে চড়ে ১৮৩৪ মিটার উপরে উন্তারসবুরগ যাওয়া যায়
২। হেটে হেটে পুরা সিটি, মার্কেট, ক্যাসেল দেখা যায়।
রাত জেগে যেসব জায়গার ম্যাপ এঁকেছিলাম সব ই বাদ দিতে হল, কারন যাওয়া আসায় ই সব টাইম শেষ হয়ে যাবে।
ভোটা ভুটি হল কে কোথায় যেতে চায়। কোন রকম কাহিনী ছাড়া ই পাহাড় ঘেরা উন্তারসবুরগ জিতে গেলো। প্লান হল ওটা ঘুরে সময় থাকলে সিটি তে হেটে হেটে ফিরবো।
তারপর টিকেট কেটে বাসে চড়ে বসলাম। শহরের শেষ মাথায় আমাদের গন্তব্য। ভালো ই হল এক ঢিলে ২ পাখি মারা যাবে। কষ্ট করে নেমে পুরা শহর দেখতে হবে না,সব দেখে ফেললাম বাসের ভিতর থেকে ই।
বাস থেকে নেমে টিকেট কেটে চড়ে বসলাম ক্যাবল কারে, গন্তব্য ১৮৩৪ মিটার উঁচু পাহাড়ের চূড়া। নির্ধারিত সময় ১০ মিনিট। তার মাঝে ই সবার চিৎকার আর ভয়ার্ত আওয়াজ আপনাকে চমকে দেয়ার জন্য কাফি।
উপর থেকে ঘটা ঘট কিছু ছবি তুলে নিলাম, যদিও বাহিরে কুয়াসার মত বরফ আর তুষার পাত হচ্ছিল।
উপরে উঠে সবাই দৌড় দিলাম বরফ ঢাকা পাহাড়ে। ওরে বাপ রে কি সাঙ্ঘাতিক শীত। অনেক টা -৪০ থেকে -৫০ হবে। সাথে মুশুল ধারে বৃষ্টির মত তুষার পাত। নিজেদের কে এভারেস্ট জয় কারি দল মনে হচ্ছে।
হাঁটু সমান বরফের লেয়ার, কোন কোন জায়গায় কোমর সমান, কোথাও মাথা সমান।
আমরা সব বাধা জয় করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।
বন্ধু মজিদ খান প্রথমে পিক তুলার জন্য জ্যাকেট খুলে নিয়েছিলো, কিন্তু একটু পর ই শাস্তি পেয়ে গেল, ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা। লেজ গুটাই দৌড় দিলো। আমরা প্রায় ১ ঘণ্টা বরফ জয় করে, ফুটবল খেলে, স্নও মানব তৈরি করে ব্যাক করলাম।
কিন্তু এ কি হাল, হাত আর পায়ের মাঝে কোন সেন্স পাচ্ছিলাম নাহ। আঙ্গুল নামক কোন জিনিসের অস্তিত্ত অস্বীকার করতে হবে।
দৌড় দিলাম ওয়াস রুমের দিকে, পরে টয়লেট করার পর হাত ড্রাই করার গরম বাতাস দিয়ে আঙ্গুল খুঁজে পেলাম।
তারপর ২ টা বিয়ার খাওয়ার পর নিজেদের আঙ্গুল কাজে লাগাতে পারলাম।
প্রথম বার ই শকিং ছিল, কিন্তু পরে আরও ৩ বার বাহিরে গেলাম, তখন খুব বেশি একটা খারাপ লাগে নাই।
এইবার ফেরত আসার পালা। মনটা ই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এই বরফের সমুদ্র আমাদের খুব বেশি আপন করে নিয়েছিল এই অল্প সময়ে।
আসার পথে অর্ধেক আসার পর বাস থেকে নেমে গেলাম, তারপর হেটে হেটে অস্ট্রিয়া এর সাদা রুপ উপভোগ করলাম। কিছু ক্যাসেল দেখলাম, কিছু টেম্পেল দেখলাম।
বরফের উপরে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নাচ উপভোগ করলাম।
তারপর ফেরত আসার পথে ঘুমাই ঘুমাই জার্নি শেষ।
শেষ হয়ে হইলো না শেষ, জার্নির মধুময় স্মৃতি মনের মাঝে গেঁথে রবে হাজার বছর ( যদি বেঁচে থাকি)
কিছু টিপসঃ
১। আমরা বাঙালি, একটু আরাম প্রিয় জাতি, তাই সবাই কে সময় দেয়ার সময় ১ ঘণ্টা এগিয়ে বললে ঠিক সময়ে যাওয়া যাবে।
২। কিছু ক্যাশ টাকা নিয়ে যাওয়া ভালো, কারন মিউনিখে বানহফের কাছাকাছি সালদা ব্যাংক ছাড়া অন্য কোন ব্যাংকের বুথ নাই। অন্য বুথ থেকে টাকা তুল্লে একটু বেশি চার্জ দিতে হবে।
৩। একা যাওয়ার থেকে গ্রুপে গেলে অনেক সুবিধা, কারন সিঙ্গেল টিকেট ২২ ইউরো এর মত, কিন্তু ৫ জনের গ্রুপ বায়ার্ন টিকেট ৪৩ ইউরো। ( সালসবুরগ পর্যন্ত)
৪। সালসবুরগে জন প্রতি সালসবুরগ টিকেট পাওয়া যায় ২২ ইউরো দিয়ে ( এটা দিয়ে সব ধরনের বাস, ট্রাম, ক্যাবল কার, ক্যাসেলে এন্ট্রি, পার্কে প্রবেশ ফ্রি) । কিন্তু যদি এই টিকেট না কাটেন তাহলে প্রতি জায়গায় ই অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে।
৫। হাতে একটু সময় নিয়ে গেলে ভালো হয়, নাহলে আমাদের মত মাত্র সিটি আর উন্তারসবুরগ ঘুরে ই দিন শেষ হয়ে যাবে। কারন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কিছু স্থান আমরা কাভার করতে পারি নাই সময়ের অভাবে ( ওগুলো তে যেতে ৩-৪ ঘণ্টা লাগে বানহফ থেকে )
৬। কিছু ছবি তুলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু ক্যামেরা মেন আনাড়ি হওয়ায় অটো মুডে কিছু ছবি তুলেছে, যা বরফের সমুদ্রে কিছু ই নাহ।ছবি দেখার জন্য এই লিঙ্কে ক্লিক মারেন ( Click This Link )
৭। অতীব দুঃখের বিষয় ক্যামেরা মেন হওয়ার কারনে আমার পিক নাই বললে ই চলে, গিবন বড় ই নিষ্ঠুর।
সবশেষে সবার অস্ট্রিয়া ভ্রমন আনন্দময় হোক এই কামনায় আজকের মত বিদায়।
ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৫ ভোর ৬:০৪