চীণের ফু সুংলিং এর একটি গল্প ‘দড়ির ভেলকি’। গল্পটিতে একজন যাদুকর তার বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে যাদু দেখিয়ে থাকে। একদিন কোন খেলাটি দেখাবে, এই প্রসঙ্গে সে বলে, দেখুন, আমি প্রকৃতির নিয়ম পর্যন্ত পাল্টে দিতে পারি। চারজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিল, তারা পীচফল আনার আদেশ দিলে যাদুকর অনুযোগের সুরে বলে, ভদ্রমহোদয়গণ মেটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। বরফ এখনো গলতেই শুরু করে নি, পীচফল পাব কোথায়? তবে যদি চেষ্টা না করি তাহলে কর্তাদের রাগ হবে। .....মাটি বরফে ঢাকা রয়েছে, তাই পৃথিবীতে পীচফল পাবার কোনো আশাই নেই। একমাত্র স্বর্গরাজ্যের রাজমাতার বাগানেই সারা বছর ফলে ফুলে ভরে থাকে। ওখানেই পীচফল পাওয়া যেতে পারে, কাজেই স্বর্গরাজ্য থেকে পীচফল চুরি করে আনতে হবে।
যাদুকর ঝুড়ি থেকে কয়েক শো হাত লম্বা দড়ি বের করে দড়ির এক মাথা ধরে উপরদিকে ছুঁড়ে দিল, আর দড়িটা শূণ্যে খাড়া হয়ে ঝুলে রইলো। তারপর তার বয়স হয়েছে এই বলে ছেলেকে দড়ি বেয়ে স্বর্গে যেতে বলল। ছেলে মুখ ভার করে বলে যে, বাবার মাথায় কিছু নেই, এই দড়ি বেয়ে কি যাওয়া যাবে? মাঝ পথে ছিঁড়ে তার শরীরের হাঁড় একটাও আস্ত থাকবে না! বাবা বলে, আমি কথা দিয়েছি, এখন তা আর শোধরাবার উপায় নেই। যদি কষ্ট করে একটা পীচফল চুরি করে আনতে পার, তাহলে কর্তারা নিশ্চয়ই আমাদের কমপক্ষে একশো রৌপ্রমুদ্রা দেবেন। তা দিয়ে আমি তোমার জন্য একটি সুন্দরী বউ ঘরে আনব।
ছেলেটি উঠে গেল, এবং মুহুর্তে মেঘের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে বড় একটা পীচফল পড়ল নিচে। উৎফুল্ল যাদুকর সেটি তুলে কর্মকর্তাদের সামনে রাখল। হঠাৎ দড়িটা শূণ্য থেকে মাটির উপর পড়ল। তা দেখে সে চিৎকার করে উঠল— দড়িটা কেটে দেয়া হয়েছে। হায়, এখন আমার ছেলের কি হবে? এমন সময় পড়ল ছেলেটির মাথা। দু’হাতে ওটাকে জড়িয়ে সে কাঁদতে লাগল— পীচফল চুরি করার সময় নিশ্চয়ই পাহারাদারার ওকে ধরে ফেলেছিল। আহা, আমার অভাগা ছেলে আর বেঁচে নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে পড়ল ছেলেটির পা, দেহের অন্যান্য ছিন্নভিন্ন অংশ। দুর্ভাগা যাদুকর সেগুলো কুঁড়িয়ে ঝুড়ির মধ্যে রেখে মুখটা বন্ধ করতে করতে বলল, ও ছিল আমার একমাত্র সন্তান, এই পীচটির জন্যই আমার ছেলে প্রাণ হারিয়েছে। দয়া করে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সাহায্য করুন। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব আপনাদের কাছে।
ভীতসন্ত্রস্ত দর্শকগণ বৃষ্টির মত টাকা-পয়সা ছুঁড়ে দিল এবং যাদুকর সেগুলো তার কোমরে বাঁধা থলিতে রাখল। তারপর ঝুড়িটির উপর একখন্ড কাপড় রেখে চিৎকার করে বলে উঠল, বাবা, ভদ্রমহোদয়গণকে ধন্যবাদ জানাতে আসবে না? অমনি উস্কখুস্ক চুলের একটি ছেলে ঝুড়ির ঢাকনা তুলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। যখন সে সবাইকে নমস্কার করছিল, তখন দেখা গেল যে ছেলেটি ওই যাদুকরের ছেলে।
এই যে গল্পটি, এটি কোনো মতেই চমকপ্রদ গল্প নয়, পাঠককে আন্দোলিত করা, এ-গল্পের উদ্দেশ্য নয়। এটি সেই গল্প— দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের গল্প; বুর্জোয়া সমাজব্যাবস্থার যে-প্রতারণা, সেই প্রতারণার শিকারের ফলে নির্মম এই কৌশল অবলম্বন করা, যা আরেক ধরণের প্রতারণা, এই প্রতারণার ফাঁদ ফেলা অসহায় মানুষের গল্প; কারো আমোদ-ফুর্তিকে অবলম্বন করে বাঁচা-মরার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কোনো মতে বেঁচে থাকা মানুষের গল্প।
তেমনি ভাঙ্গনের ‘বাজিকরের মৃত্যু’ গল্পটির ভাষা বা যটনা পরম্পরা চমকপ্রদ নয়, পাঠককে ধাধাঁয় ফেলা এর লক্ষ্য নয়। আমরা দেখি, বাজিকররা হাতের অভিনব কারুকাজ ও অসাধারণ বাকচাতুর্যের মধ্য দিয়ে মঞ্চে একের পর এক নান্দনিক কলা-কৌশল প্রদর্শন করে দর্শকদের বিমাহিত করে রাখে ঘন্টার পর ঘন্টা। দর্শকদের মধ্যে উচ্ছাস আর উৎকন্ঠার শেষ নেই— কী হয়! এরপর কী হয়! আলো ঝলমলে মঞ্চে বর্ণিল মুখোস পরা বাজিকরদের অভাবনিয় দৃশ্যের অবতারণা। দর্শকদের অপলক চোখে মঞ্চ বরাবর হা হয়ে থাকা, আর একটু পর পর এই গুঞ্জন— না জানি এরপর কী হয়! আমরা পাঠকরাও দর্শকদের সাথে মিশে যাই, দর্শক হয়ে উঠি।
একসময় দেখা যায় বাজিকরদের রক্তাত বিভৎস হাত, হাতের আঙ্গুল রাক্ষসের আঙ্গুলের মত দীর্ঘনখ বিশিষ্ঠ; একি! আমরা আঁতকে উঠি, মঞ্চজুড়ে বিকৃত আর্তচিৎকার, হাহাকার... কোনো বিপদের চিহ্ন? ‘‘বয়স্করা বিপদ আঁচ করে নিল। মঞ্চ দখল করেছে হায়েনারা। হয়তো এরা বাজিকররূপী রাক্ষস। ওদের সূচালো নখাগ্র আর হিংস্র চাহনী বলে দিচ্ছে এরা মানুষ না; পিশাচ!’’
তো, এখন কথা হচ্ছে কারা এই পিশাচ? কারা এই হায়েনা? বাজিকররূপী রাক্ষস? যাদের সূচালো নখাগ্র আর হিংস্র চাহনী দেখে আমাদের ভুল ভাঙ্গে— ওরা মানুষ নয়, পিশাচ। আমাদের চোখ খুলে যায়— দেখতে পাই কোথায় আছি আমরা। একেক সময় একেক রকম কৌশল অবলম্বন করে আমাদেরকে খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে বাজিকররূপী রাক্ষস বা পিশাচ; যাদেরকে দেবদূত বলেই মনে হয়। আমরা সেই খেলার কখনো নীরব দর্শক, কখনো অসহায় দর্শক, কখনো অবুঝ বা বিভ্রান্ত দর্শক।
পৃথিবীতে আজকের দিনের কেন্দ্রীয় বিষয় আর মানুষ থাকছে না, মানুষ হয়ে উঠছে নিছক মাধ্যম, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে পুঁজিতন্ত্রের আগ্রাসন; কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে পুঁজি, পণ্য আর মুনাফা। এই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষকে মূল্যায়ন করা হয় কার কত টাকা আছে এই বিবেচনায়, এই কাঠামোর মধ্যে; মানুষ হিসেবে কারো কোনো আইডেন্টি বা সত্ত্বা থাকছে না। মানুষ মানুষের রক্তপ্রবাহে চালিত হয় না, পুঁজিতন্ত্রের রক্তপ্রবাহে চালিত হয়।
আমেরিকা আফগানিস্তানে মারনাস্ত্র নিক্ষেপ করে কেনো? খুব সহজ হিসেব, সে দেশের জনসাধারণের জীবন বিপন্ন, তাদের স্বার্থে আমেরিকা ধ্বংশযজ্ঞ চালায়। সেখানে লাদেন লুকিয়ে আছে, যে পৃথিবীর জন্য হুমকি-স্বরূপ, মানব সভ্যতার জন্য হুমকি-স্বরূপ; মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা ধ্বংশযজ্ঞ চালায়। ইরাকে কেনো যুদ্ধ করে? সাদ্দাম সৈরাচরী, তো, সে দেশের জনগনের মুক্তির জন্য আমেরিকা যুদ্ধ করে; এ তার নৈতিক দায়িত্ত্ব। এই যে আমেরিকা, এখানে আমেরিকার মুখের বুলি বাজিকরদের বাকচাতুর্য আর ধবংশযজ্ঞ বাজিকরদের রক্তযজ্ঞ; এক কথায় বাজিকররূপী আমেরিকা। আমাদের রাজনীতিবিদরাও বাজিকররূপী, এনজিও বাজিকররূপী।
গ্রামীণ ব্যাংকের মোহাম্মদ ইউনুসের দিকে তাকালে আরো স্পষ্টতই প্রতিয়মান হয় কারা বাজিকররূপী রাক্ষস, হায়েনা বা পিশাচ। কিন্তু তিনি আমাদের কাছে দেবদূত এর মত আবির্ভূত হন; যতখন না আমরা দেখতে না পাই তার সেই রক্তাত বিভৎস হাত, হাতের আঙ্গুল রাক্ষসের আঙ্গুলের মত দীর্ঘনখ বিশিষ্ঠ। ততখণ তিনি আমাদের এই খেলা দেখিয়ে যান : একটি ডিম, ডিম থেকে মুরগী, মুরগী থেকে অনেক ডিম, অনেক ডিম থেকে অনেক মুরগী, অনেক মুরগী থেকে একটি ছাগল, ছাগল থেকে গরু... এই যে চক্র বা খেলা, এই খেলার ফাঁদ উম্মেচিত করাই সাহিত্যিকের কাজ, এখানে আমরা যার প্রতিফলন দেখতে পাই : রক্তযজ্ঞ, রক্তাত বিভৎস হাত, হাতের আঙ্গুল রাক্ষসের আঙ্গুলের মত দীর্ঘনখ বিশিষ্ঠ;— এই প্রতীক এর মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়ে দেন, শোষন, নিপীড়ন ও লুন্ঠনের ব্যবস্থা। আর এর মধ্য দিয়ে বাজিকররূপী পুঁজিপতিরা তাদের স্বার্থ হাসিল করে।
এ-রকম খেলার প্রধান কারসাজি বা বৈশিষ্ঠ হল দর্শকদের একদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ আর মনোযোগী করে সম্পূর্ণ ভিন্নদিক থেকে রহস্য উদঘাটন করা; যার জন্য কেউ প্রস্তুত থাকে না। দৃষ্টি অন্যদিকে থাকে বলে কেউ বুঝতে পারে না এদের কারসাজি বা চাতুরি; আর বুঝতে পারে না বলে স্বভাবতই ঠকতে হয়। তো, যাদের কথা বললাম, এদের যে খেলা, তা একদিকে উন্নয়নের নামে, শান্তির নামে, নিরাপত্তার নামে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভুলিয়ে রাখে; আর অন্যদিকে সুক্ষ্ম কৌশলে তাদের স্বার্থ হাসিল করে, আর এটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
শেষ দৃশ্যে বাজিকরের খেলা নয়, লেখকের খেলা; আমরা দেখি— ‘‘পূণরায় স্থিরদৃশ্য থেকে শুরু হলো। সেই রক্তাত মানুষগুলোর বিভৎস চেহারা সেই রক্তে ভেজা তাদের চোখ, নাখ, কপাল...’’ এখানে প্রধান বাজিকর দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘‘শেষ দৃশ্যে এই রক্তাত মানুষগুলো কিছুক্ষণের জন্য জীবিত হয়ে উঠবে। তারা বাজিকর এবং তার সাঙদের অভিশাপ দিবে। তখন আমরা মঞ্চে নেতিয়ে পড়বো। আমাদের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়ে যাবে। রক্তাত মানুষগুলোর অভিশাপ আমাদেরকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিবে। অতঃপর রক্তাত মানুষগুলোর দৃশ্য যখন সমাপ্ত হবে, তখন আমরা আবার সজীব হয় উঠবো। এটাই শেষ দৃশ্য। কিন্তু খবরদার! বাজিকর কন্ঠে উম্মা প্রকাশ করে স্মরণ করিয়ে দিল— কেউ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাখবেন না। হাতের বাঁধন খুলে রাখবেন। মনে রাখবেন, একটু অসতর্ক মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আমাদের ভয়াবহ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’’
যথারিতি শেষ দৃশ্য অভিনিত হচ্ছে। একসময় আমরা দেখতে পাই রক্তাত মানুষগুলো তাদের বাঁধনখোলা হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করছে; কিন্তু এ-কথা ছিল না। তারা ‘‘হলরুমের দিকে তাকিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতগুলো আরো সজোর মুষ্ঠিবদ্ধ করছে। এবং সাথে সাথে এক যাদুকরী ভঙ্গিমায় সমস্ত হলরুমের দর্শক তাদের হাতগুলো উত্তোলিত করে বজ্রমুষ্ঠি করে তুলছে।’’ আর ‘‘বাজিকর ও তার সাঙরা করুণ আর্তনাদ করতে করতে মঞ্চে নুইয়ে পড়ছে।’’ তো, বাজিকরের মুত্যু, মানে শোষকের মৃত্যু; আর দর্শকরূপী জনগনের প্রতিরোধ এর মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়।
ভাঙ্গনের গল্পের শিক্ষনীয় বৈশিষ্ঠ বা তাৎপর্য হলো, বড় শিল্পমাত্রই যা দেখা যায়— বিদ্যমান সামাজের কুফলগুলিকে আমাদের ঘৃনা করতে শেখায়, ঘৃনা করতে শেখায় এর অকাল্যানকর উত্তরাধিকার; এবং জীবনের নীচতা ও ক্রুরতা কাটিয়ে উঠতে আমাদের ভাবতে শেখায়। আমরা আমাদের দেখার চোখ জন্ম দেয়ার শক্তি সঞ্চয় করি, আমাদের জীবনবোধ ও উপলব্ধির প্রশ্নটি শানিত হয়ে ওঠে।
আমাদের চোখের সামনে যে-সমাজ গড়ে উঠছে, সে সমাজের কোন দিকটি লেখকের কলমে বর্ণিত বা উম্মেচিত হবে, সমাজের কোন প্রতিচ্ছবি তিনি আঁকবেন, এবং বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় লেখকের অবস্থান কি রকম; এসব অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ। এখানে ম্যাক্সিম গোর্কিকে স্মরণ করা যেতে পারে, তিনি বলেছেন, ‘‘লেখক হচ্ছেন তাঁর দেশের ও তাঁর শ্রেনীর মুখপাত্র। তিনি তাঁর স্বদেশে ও স্বসমাজের যেন চক্ষু, কর্ণ আর হৃদয়। এক কথায় তাঁর যুগের তিনি বানী বা প্রতিধ্বনি।’’—[কেন লিখছি]।
‘শাদা বিবেক কালো বিবেক’ ভাঙ্গনের এই গল্পটি আমি প্রথম পড়ি, পড়ে অভিভূত হই— ব্লগে এমন সিরিয়াস ও দায়িত্ত্বশীল; অর্থাৎ আমার এই পথ চলাতেই আনন্দের জন্যে নয়, তোমরা যা বলো ভাই বলো আমার মন জানে আর আমি জানি এমনটি নয়, এবং মনের খেয়াল-খুশির রঙে রাঙানো নয় এমন লেখা তখন পর্যন্ত পাই নি।
আমাদের সামাজিক যে প্রেক্ষাপট, এই গল্পটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেয়; এবং একই সাথে কেবল মার খেয়ে না যেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে উদ্ভুদ্ধ করে। বস এর চরিত্রের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সমাজের বুর্জোয়া শ্রেনীকে আমরা দেখতে পাই; যারা ভোগ ও শোষণ করে আরো, আরো বুর্জোয়া হয়ে ওঠে। ভোগ ও শোষণ করা, এটি বসের নারী ভোগ ও নারীর প্রতি যে লালসা; এই প্রতীক এর মধ্য দিয়ে উঠে আসে। আর এর বিপরিতে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হিসেবে একজন ঘুরে দাঁড়ায়, যার মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই মধ্যবিত্ত-চরিত্রের প্রতিরূপ।
নুন খাওয়া এবং নুন খেয়ে নুনদাতার গুন গাওয়া আর তার দোষ ভুলে যাওয়া; সামাজিক এই অবক্ষয়ের এক নির্মম চিত্র ফুটে উঠে ‘নুনের গল্প’ গল্পে। যেমন— ‘‘হারু মিয়ার ঘ্যান ঘ্যান সত্ত্বেও তার বেলাবিস্কুট আর গরম পানির চা’য়ের বাকী পড়ে যাওয়া হিসাবের পৌনে তিন টাকা ভুল ধরি। রফিকের বিশেষ অঙ্গের কাছাকাছি কোথায় বিষ ফোঁড়া উঠেছে সেটা আমাদের আলোচনায় চা’য়ের কাপে ঝড় তোলে। মালেক মহাজনের লাল গরুটার লেজের গোবরে পোকা কয়টা লেগে আছে সে হিসাব করতে গলদর্ঘম হই। কিন্তু, মালেক মহাজনের লেজের আগায় কয়টা কুত্তা বসত করে সে হিসাবে আমরা কোনোদিনও যাইনা।’’
সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে যে-অন্ধকারের উৎসব, আরো ভয়াবহ হলো মানুষের ভেতরে মনুষত্ত্ববোধ এর কোনো লক্ষণ নেই; কেবল আরো ভালো থাকা যায় কীভাবে এই প্রতিযোগিতা। এর খুবই তাৎপর্যময় প্রকাশ এর মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়েছে— ‘‘আর মিনতির ঝলসানো মুখটাকে কল্পনায় এঁকে সময় নষ্ট না করে আমরা ঘরে ফিরে গিয়েছিলাম..... কিন্তু মিনতির সীমাহীন কষ্ট আমরা দু’চোখে দেখার কোন প্রয়োজন বোধ করিনি’’ কেনো? ‘‘কারণ, নুন খেয়ে সেদিন আমাদের ভীষণ ঘুম পাচ্ছিলো।’’ অর্থাৎ নুন খেয়ে খেয়ে আমরা নষ্ট হয়ে গেছি, আমাদের মনুষত্ত্ববোধ বলতে কিছু নেই। আরো ভালো থাকতে গিয়ে আসলে আমরা বেঁচে নেই, বেঁচে থাকা যাকে বলে, টিকে আছি মাত্র। এটি ঠিক এখনকার মধ্যবিত্তের ভায়াবহ চিত্র।
করুণ একটি গল্প ‘নৈঃশব্দের ভাঁজে ভাঁজে’। আমরা জানি প্রেমে জীবনে মরণে কোনো ভেদ থাকে না। ‘‘এই সেই আগুন, গালিব, যা জ্বালালে জ্বলে না, নেভালে নেভে না’’— [গালিব] বা ‘‘তোমাতে আমাতে তো কোনো তফাৎ নেই; / প্রেমের নামে তৃতীয় বস্তুটা কেনো মাঝখানে’'— [জিগার মুরাদাবাদি]।
‘একুশের গল্প : বর্ণাক্ষর’ প্রথমেই আমাদের অভিভূত করে এর ভাষা—সহজ, সাবলীল ও সুন্দর উপস্থাপনা; যা আমাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দম ফেলার সময়টুকু না দিয়ে ধরে রাখে। গল্পটি পড়তে পড়তে আমাদের ভেতরে এক সুন্দর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। বর্ণ, অক্ষর আর বাবা যখন শহীদ মিনারে ফুল দিতে যায়, সঙ্গে সঙ্গে যেন আমরাও যাই। শহীদ মিনার প্রঙ্গনে দেখতে পাই মনুষের ঢল; বর্ণকে দেখতে পাই, অক্ষরকে দেখতে পাই, বাবাকে দেখতে পাই, সঙ্গে নিজেকেও দেখতে পাই। এই যে গল্পের সাথে পাঠকের মিশে যাওয়া, এটি একজন গল্পকারের অনেক সাধ্য সাধনার পরে পাওয়া পরম বস্তুর মত।
ভাঙ্গন সম্পর্কে বললে, এইটুকু কেবল বলি— আমাদের যার যে-লেখা, তা যার যার চেতনারই বহিঃপ্রাকাশ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১:১৫