উপদ্রবটি নতুন নয়। কিন্তু বর্তমানে এই ‘উপদ্রব’ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে বিশাল বিষবৃক্ষের আকার ধারণ করে জাতির জীবন যেমন অতিষ্ঠ করে তুলেছে তেমনি বিপন্ন করে তুলেছে জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রিক নিরাপত্তাকে। এই উপদ্রবটির নাম ‘ভারতীয় দালাল’। সরকারের নীতি-নির্ধারক মহল থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভা, উপদেষ্টা পরিষদ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন, অর্থনীতি এবং বলা বাহুল্য রাজনীতির মতো প্রতিটি অঙ্গনে এরা অপ্রতিহত গতিতে বংশ বৃদ্ধি করে চলেছে। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, এই দালালরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে নিজ মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে প্রকাশ্যে সাফাই গাইতে লজ্জা করছে না। এখনই যদি এদের নির্মূল করার ব্যাপারে দেশবাসী উদ্যোগ না নেয় তাহলে দেশ ও জাতির কপালে অশেষ দুঃখ আছে।
আমাদের দেশে একটা প্রচলিত রোগও ইদানীং মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, ভারতের বিরুদ্ধে কথা বললেই সাধারণত ধরে নেয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার দুর্গন্ধ ছড়ানোর প্রয়াস। ভারতীয় দালালরা এরকম ধারণা বিস্তারে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে অনেকে সাম্প্রদায়িক হওয়ার ভয়ে ‘হক-কথা’টি বলতে লজ্জা বোধ করেন। অনেকে আবার মনে করেন, ভারতের বিরুদ্ধে কথা বললে তার ইহলৌকিক প্রতিপত্তি লাভ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি ‘পাকিস্তানপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। এরকম ভয়, দ্বিধা ও হীনমন্যতার সুযোগ ১৬ আনা নিচ্ছে ভারতীয় দালালরা। তাদের বড় সুবিধা হলো তাদের হাতে মিডিয়া আছে। আছে মাথার ওপর ক্ষমতাধর ‘সরকার’।
কিন্তু আমি দায়িত্ব নিয়ে জোর দিয়ে বলছি, ভারতবিরোধিতা মানে পাকিস্তানপন্থী হওয়া নয়। ভারতবিরোধিতা নামে সাম্প্রদায়িকতাও নয়। ভারতবিরোধিতা মানে ভারতের মেহনতি জনগণের বিরুদ্ধেও দাঁড়ানো নয়। আবার অর্থহীন বিরোধিতা করে একটি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে স্থায়ী শত্রুতাও পুষে রাখা নয়। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই, তবে তা হতে হবে সমান মর্যাদা ও সম্মানের ভিত্তিতে।
আসলে ভারতীয় দালাল নির্মূল করার আহ্বান প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাও নয়। এ হলো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নিজের অস্তিত্ব, ঐতিহ্য, ইতিহাস, ভূগোল ও সংস্কৃতি নিয়ে টিকে থাকার অতি জরুরি আকুতি। এই আকুতির অন্তরগত যে চেতনা তা প্রাণ ধারণ করেছে আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে। এর পাশাপাশি রয়েছে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের অপরিসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস। সেই সব পাতা ঘেঁটে দেখা যায়, যতবার বাংলাদেশ মোকাবেলার পথে গেছে ততবারই সে মহিমান্বিত হয়েছে। আর যখন দালালরা আমাদের নিয়ে গেছে আপস ও নতজানু বন্ধুত্বের দিকে, তখনই দাসত্বের শিকল ঝুলেছে জাতির গলায়। আর আঘাত বার বার যেখান থেকে এসেছে সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মূল কেন্দ্র অতীতেও ছিল দিল্লি, এখনও।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজ এভাবে কথাগুলো লিখতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু উপায় কী? অসুখ হলে ওষুধের ব্যবস্থা তো করতেই হবে। জাতির সব অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে আজ বিষাক্ত ভাইরাস। এই ভাইরাস থেকে রক্ষা করা না গেলে বাস্তবায়িত হয়ে যাবে এদেশীয় ‘লেন্দুপ দরজীদের’ পরিকল্পনা। সেজন্য অসুখ চিহ্নিত করা যেমনি জরুরি তেমনি সেই অসুখের সর্বশেষ বীজাণুগুলো খুঁজে বার করে সেগুলো নির্মূল করাও জরুরি।
অনেকে বলবেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কি ভারতীয় দালাল? প্রধান সমস্যা তো দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, দূষিত প্রশাসন, অঙ্গীকারবিহীন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব ইত্যাদি। আমি বলব, এসব সমস্যা যেমন সত্যি তেমনি সবচেয়ে বড় সমস্যা ভারতীয় দালাল। জাতির প্রতিটি কল্যাণ, মঙ্গল, উন্নয়ন ও সম্প্রীতির গতিরোধ করে ক্রমান্বয়ে মাথা উঁচু করে তুলছে এই দালাল সম্প্রদায়। এরা বাংলাদেশকে নানা ছলছুঁতোয় বিভক্তি, বিদ্বেষ, ঘৃণা ও হানাহানিতে লিপ্ত করে চাচ্ছে ব্যর্থ ও অকার্যকর তত্ত্বের বিকাশ ঘটাতে।
বাংলাদেশের জন্য আরও একটা দুঃখ, এখানে ভারতীয় দালাল আছে, পাকিস্তানি রাজাকার আছে, সৌদিপন্থী, চীনাপন্থী, মার্কিনপন্থী লোকজনও আছে, শুধু ১৬ কোটি মানুষের দেশে ‘বাংলাদেশপন্থী’ কেউ নেই। থাকলেও তারা চালকের আসনে বসে নেই। আছে গ্যালারিতে। এই গ্যালারির লোকগুলোকে আজ দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, সিসাঢালা জাতীয় সংহতি গড়ে তুলে বাঁচাতে হবে দেশকে।
দুই
শাহরিয়ার কবিরের মাধ্যমে যখন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গড়ে তোলেন শাহাদত্ চৌধুরী কিংবা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ারা, তখন ধারণা করা না গেলেও এখন এই কমিটি মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। কারণ মধ্যপর্যায়ে এই প্রক্রিয়া থেকে জাতীয়তাবাদীরা ছিটকে পড়ে যায়। এর চালকের আসনে বসে পড়ে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। এর সুফল ঘরে তোলে আওয়ামী লীগ। আর শাহরিয়ার কবির যিনি ‘ওদের জানিয়ে দাও’ এবং ‘সীমান্তে সংঘর্ষের’ মতো কিতাব লিখে আমাদের সমীহ আদায় করেছিলেন, তার চোখে এখন কাশ্মীরে কোথাও কোনো গোলমাল নেই। কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগণ হলেন ‘আতঙ্কবাদী’, পাকিস্তানের লেলিয়ে দেয়া ধর্মোন্মাদ জঙ্গি। উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘স্বাধীনতার পিপাসা’ আজ তার চোখে পাকিস্তানের আইএসআই-এর ফ্যাক্টরি থেকে উদ্ভূত একটি সন্ত্রাসী তত্পরতা মাত্র। আর বাংলাদেশে যারা জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা বলে, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলে তারা জঙ্গি, মৌলবাদী, পাকিস্তানিদের চক্রান্তের ফসল।
ভারত আমাদের সম্পদ লুট করেছিল ’৭১ সালে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে হত্যা করেছে পদ্মাকে। অভিন্ন ৫৪টি নদীতে দিয়েছে বাঁধ। বিনষ্ট হয়েছে পরিবেশ। মরে গেছে শত শত নদী। এখন টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে শুকিয়ে মারতে চাচ্ছে সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনাকে। তারা তাদের দালালদের দিয়ে আদায় করে নিয়েছে করিডোর। এশিয়ান হাইওয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে ভারতের প্রেসক্রিপশন মতো। সীমান্তে বিনা বিচারে প্রতিদিন পাখির মতো গুলি করে মারছে বাংলাদেশীদের। লাশ ঝুলিয়ে রাখছে কাঁটাতারে। সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশের যুব সমাজকে ধ্বংসের জন্য শতাধিক ফ্যাক্টরিতে ফেনসিডিল তৈরি করে পাঠিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের ভেতরে। গরু চোরাচালানি কিংবা সাধারণ কৃষক বিএসএফের গুলিতে মারা গেলেও আজ পর্যন্ত কোন মাদক ব্যবসায়ীকে তারা হত্যা করেনি। কাঁটাতার দিয়ে একটি বন্ধু দেশকে খাঁচার মধ্যে পশুর মতো আটকে রেখে দাবি করছে বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের কৃষিখাতকে সর্বনাশের কিনারে ঠেলে দিয়ে করা হয়েছে ভারতনির্ভর। শিল্প-কারখানাগুলোতে জ্বলছে লালবাতি। আর ভারতীয় দ্রব্যাদি দিয়ে পূর্ণ এদেশ। অনাবৃত আকাশ দিয়ে গলিত পুঁজের মতো ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে ভারতীয় সংস্কৃতি। পাড়ায় পাড়ায় ভিডিওর দোকান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে শাহরুখ, ঐশ্বরিয়া রাই, হৃত্মিক রোশন আর ক্যাটরিনাদের বিজাতীয় কর্মকাণ্ড। সুপার মার্কেটগুলো ভারতের পণ্য বিক্রির সেন্টার। বাদ বাকি যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিটি ছিল আমাদের, তাকেও হত্যা করার জন্য এখন অবাধে চলবে ভারতীয় ছবি। হিন্দির পাশাপাশি চলবে বাংলার ওপর বাংলার আগ্রাসন। বইয়ের দোকানগুলোতে এখন তো কেবল ভারতীয় বই।
শিক্ষাঙ্গনগুলোকে করা হয়েছে রণক্ষেত্র। আর প্রতিবছর লক্ষাধিক ছেলেমেয়ে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যাচ্ছে ভারতে। ফেরার পথে তারা ফিরছে ভিন্ন মানুষ হয়ে। বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের বিরাট অংশ ভারতের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য লালায়িত। তারাই ভারতের ইশারায় বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বানানোর জন্য প্রতিনিয়ত রচনা করে গবেষণাপত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাভাবে খাড়া হয়েছে ভারতীয় সংগঠন।
উল্টোদিকে ভারত থেকে আমরা পেয়েছি মিথ্যাচার, বন্ধুত্বের ফাঁকা বুলি আর আশ্বাস। অন্তঃসারশূন্য আশ্বাস। এক ফোঁটা পানি আমরা পাইনি। শান্তি বাহিনীর লালন-পালন করেনি ত্যাগ। বন্ধ করেনি সীমান্ত হত্যা, বাঁধ নির্মাণ। বাংলাদেশের একটা চ্যানেলকেও আজ পর্যন্ত দেয়নি সেদেশে প্রচারণার অনুমতি। বাংলাদেশের দ্রব্যাদির ভাগ্যেও জোটেনি শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার। সিনেমা তো দূরের কথা।
তারপরও দালালরা ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্বের গান গাইবে। তবে এই গান শুনতে শুনতে আমাদের এগুতে হবে সংগঠন প্রক্রিয়ায়।
তিন
পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলা বুঝেছিলেন, বগলের নিচে বিড়ালের বাচ্চা রেখে যুদ্ধ করা কত কঠিন এবং এই ভুলের খেসারত তিনি দিয়েছিলেন জীবন দিয়ে, দেশের স্বাধীনতা হারিয়ে। মীর কাসিম এই ভুল করেননি। তিনি আমাদের ইতিহাসের একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে যাবার আগে, দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দালালদের একত্রিত করেন রাজধানী মুঙ্গেরে। এসব দালালের মধ্যে ছিল— রায় রায়ান, উমেদ রায়, তদীয় পুত্র কালীপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, রাজবল্লভ, জগত্ শেঠ মহাতার চাঁদ, স্বরূপ চাঁদ, দিনাজপুর, নদীয়া, গোরকপুর, বীরভুম, রাজশাহীর জমিদার, ভোজপুরের দুলাল রায়, টিকারীর রাজা ফতেসিংহ, আজিমবাদের নাহার, রামনারায়ণ, মুন্সী জগত্ রায়, রাজা সুন্দর সিংহ ও মোহাম্মদ মাসুমের মতো বিশিষ্ট লোকজন। [রিয়াজ উস সালাতিন : গোলাম হোসেন সলিম]।
মীর কাসিমের নির্দেশে এদের প্রত্যেককে হত্যা করে বস্তায় ভরে ভারি পাথর যুক্ত করে নিক্ষেপ করা হয় গঙ্গাবক্ষে।
যদিও দালালদের সংখ্যা সে সময় অনেক। তবুও মীর কাসিমের এই তালিকা উল্লেখযোগ্য। এর ভেতর দিয়ে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ার দিকে ইঙ্গিত করে গেছেন এই দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক।
চার
দালাল প্রতিরোধে সবচেয়ে নৃশংস এবং হিতাহিতবোধ বর্জিত হলো ভারত। তারা দালাল ধরার নামে যে কাজটা করে থাকে তা হলো মুসলমানদের একটু ‘টাইট’ দেয়া। যেখানে যাই ঘটুক, স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করে ওইসব এলাকার মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয় নানা জুলুম, নির্যাতন, হামলা ও মামলা। বিশেষ করে কোনো এলাকায় কোনো মুসলিম ছেলে একটু ভালো রেজাল্ট করলে বা অর্থশালী হলে তার আর রেহাই নেই। অচিরেই তাদের ওপর নেমে আসবে পাকিস্তানি গুপ্তচরের অপবাদ। তারপর গ্রেফতার, রিমান্ডের নির্যাতন। তারপর হয়তো দেখা গেল সব অভিযোগ মিথ্যা। কিন্তু ততদিনে নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে গেছে ছেলেটি। আর মামলা ঠেলতে ঠেলতে হয়ে পড়েছে পথের ভিখারি। এই নিয়মে চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন এক সময় কলকাতা করপোরেশনের মেয়র সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা।
১৯৭৪ সালের আগে এই নির্যাতনের মাত্রা কতটা ভয়াবহ ছিল তার একটা জ্বলন্ত নজির হলো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার। সে সময় চুরুলিয়া কাজী পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন কাজী আলী হোসেন। গ্রামের নির্যাতিত কৃষক মজুরদের মহাজনী ও জোতদারী ঋণের বোঝা থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি ঋণ সালিশি বোর্ড নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধিচালিত কংগ্রেস রাজনীতি এই বিষয়টাকে ভালোভাবে নেয়নি। তারা তাঁকে ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারি নিজের বাড়ির সামনেই নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার আজও পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে যে জিনিসটা ভয়ঙ্কর তা হলো নজরুল পরিবারকে ভারতের তত্কালীন কংগ্রেস সরকার চিহ্নিত করে পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসাবে। ১৯৬৩ সালে এল সরাসরি আঘাত রাজনৈতিক দিক থেকে। পাকিস্তানের দালাল আখ্যা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী মজহার হোসেনকে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় নজরুলের আরেক ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী আলী রেজাকে। সরকারি অভিযোগে বলা হয়েছিল, ‘চুরুলিয়া গ্রামে অভিযুক্তরা গভীর রাতে পাকিস্তানি হেলিকপ্টার এনে দেশের সব গোপন দলিল পাকিস্তানকে দিয়ে দিয়েছিল।’ এই উদ্ভট ও হাস্যকর অভিযোগের জবাবে কবির ভ্রাতৃবধূ শহীদ আলী হোসেনের ক্ষুব্ধ জননী পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়কার প্রধান কংগ্রেস নেতা অতুল্যঘোষকে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেরা যদি দেশদ্রোহী হয়, তাহলে প্রকাশ্য রাজপথে তাদের গুলি করে মারুন। না হলে সসম্মানে ছেড়ে দিন। আমার ছেলে যদি দেশদ্রোহী হয় তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীও তাই।’
তারপর অশেষ অত্যাচার নির্যাতন আর রিমান্ডের অনবরত জিজ্ঞাসাবাদের যন্ত্রণা সয়ে এরা মুক্তি পান।
নজরুলকে ভারতীয়রা পাকিস্তানি চেতনার কবি বানিয়ে ফেলেছিল সে সময়। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছিল যে, ভারতীয় শাসকরা রেডিও-টিভিতে নিষিদ্ধ করে দেয় নজরুল সঙ্গীতের প্রচার ও পরিবেশন। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই হতবাক করা নিষেধাজ্ঞাটি বলবত্ ছিল।
১৯৭০ সালেও আঘাত আসে নজরুল পরিবারের ওপর। প্রিভেনটিভ পাওয়ার অ্যাক্টে আবারও গ্রেফতার করা হয় নজরুল পরিবারের সদস্যদের। ১৯৭২ সালে সিআরপির (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ) হামলায় ভণ্ডুল হয়ে যায় নজরুল জয়ন্তীর উত্সব। ১৯৭৪ সালে আবার গ্রেফতার করা হয় কবি পরিবারের সদস্যদের।
পাকিস্তান আমলে এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা তা বোধকরি ভারতের কর্মকাণ্ডের পাল্টা হিসেবেই এসেছিল।
পাঁচ
ভারতীয় দালালদের নির্মূল করতে হবে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে। প্রথমে গড়ে তুলতে হবে একটি সংগঠন। তারপর অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তৈরি করতে হবে তালিকা। তারপর সেই তালিকা সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করতে হবে। এরপর এই তালিকা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি শহর ও জনপদে ভাগ ভাগ করে তালিকাগুলি প্রকাশ করে ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে। আগে স্থানীয়ভাবে পরে জাতীয়ভাবে গড়ে তুলতে হবে জনমত। এই সংঘবদ্ধ জনমত দালালদের বিষয়ে সামাজিকভাবে বয়কটের ডাক দেবে। এই আহ্বান অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে উত্খাত করতে হবে ভারতীয় দালালদের। অভিযোগের গুরুত্ব অনুযায়ী দালালদের সোপর্দ করতে হবে আদালতে।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে এই মহত্ কর্মটি সাধিত হলে একদিকে যেমন শান্তি পাবে আমাদের শহীদরা, অন্যদিকে সব ধরনের আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অপতত্পরতা মুক্ত হয়ে সত্যিকার অর্থেই অর্থবহ হয়ে উঠবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
বিজয়ের ডিসেম্বরে যখন পাকিস্তানি দালালদের বিচার হচ্ছে, সেই সময় জাতির আরেক সংকট ভারতীয় দালালদের রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করার কাজ শুরু হলে আশা করা যায়, আরেকটি অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে দেশ। কিন্তু এই কাজে গড়িমসি করলে আমাদের সামনে আছে চোগিয়ালের সিকিম, নিজামশাসিত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাশেম রিজভীর ভাগ্য। তখন দালালরাই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। যেভাবে এখন গওহর রিজভী কিংবা ড. মশিউর রহমান করে থাকেন।
click Here