কমলগঞ্জের ধলই সীমান্তে এ বীরের স্মরণে স্মৃতিসৌধ থাকলেও তাঁর বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে। ৩৯তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে কমলগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন বীরশ্রেষ্ট হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধে সকালে পুষ্পমাল্য অর্পন করার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে তাঁর ঐতিহাসিক পটভূমিকা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা দিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
জানা যায়, ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সিপাহী হামিদুর রহমান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাতৃভূমির অকৃত্রিম টানে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। নিজের জীবনকে বাজি রেখে স্বাধীনতার লাল সূর্যø আনয়নে যুদ্ধের ময়দানে তিনি শহীদ হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত। যুদ্ধ পরবর্তীকালে যে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয় সিপাহী হামিদুর রহমান তাদের একজন। কিন্তু তার শেষ রক্ত ঝরা কমলগঞ্জের ধলই সীমান্ত চৌকির কথা
যে ভাবে শহীদ হন সিপাহী হামিদুর রহমান
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে কমলগঞ্জের ধলাই সীমান্ত এলাকায় প্রানপন লড়াই করে দেশের জন্য শহীদ হন সিপাহী হামিদুর রহমান। চারদিকে চা বাগান, মাঝখানে ধলই সীমান্ত চৌকি। ধলই সীমান্ত চৌকি থেকে দণিপূর্ব দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কমলপুর শহরে ছিল মুক্তিবাহিনীর সাবসেক্টর ক্যাম্প। সব প্রস্তুতি নিয়ে ২৮ অক্টোবর ভোর রাতে লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে একটি দল পাক সেনাদের উপর চতুর্দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমন চালায়। ব্যাপক গোলাবর্ষনে পাক সেনাদের ক্যাম্পে আগুন ধরে যায়। প্রচন্ড গুলিবর্ষন ও পাকবাহিনীর পঁুতে রাখা মাইন বিষ্ফোরণে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। সিপাহী হামিদুর রহমান সাহসিকতার সাথে সীমান্ত চৌকি দখলের উদ্দেশ্যে মৃতুকে তুচ্ছ ভেবে মেশিনগান নিয়ে বিপ্তি গোলাগুলির মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে শত্রু পরে ৫০ গজের মধ্যে ঢুকে পড়েন। গর্জে উঠে তার হাতের মেশিনগান। শত্রুদলের অধিনায়কসহ বেশ কয়েকজন সৈন্য এতে প্রাণ হারায়। এমন সময় শত্রুসৈন্যের একটি বুলেট হামিদুর রহমানের কপালে বিদ্ধ হয়। কিছুনের মধ্যে কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই সীমান্তের তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিডিআর ফাঁড়ি) এর সামনে মৃতূর কূলে ঢলে পড়েন তিনি।
কমলগঞ্জে স্মৃতিফলক
স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ দিন পর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনীর উদ্যোগে সর্বপ্রথম কমলগঞ্জ উপজেলার ধলাই সীমান্ত চৌকির পাশে নির্মাণ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিফলক। ২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ১০ শতাংশ জায়গার উপর সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে গণপূর্ত বিভাগ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্ম্মাণ করে। সাথে সাথে কমলগঞ্জ পৌরসভার ভানুগাছ- মাধবপুর সড়কটিকে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়।
পাঠ্য পুস্তকে ভুল সংশোধনের দাবী
অথচ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত চতুর্থ শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বই’ এর ৭১নং পৃষ্ঠায় রচিত “বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান” পাঠের প্রথম অংশে উল্লেখ করা হয়েছে “সিলেটের সীমান্ত এলাকা”। শ্রীমঙ্গল থেকে ১০ মাইল দক্ষিনে ধলই সীমান্ত ঘাটি”। যাহা তথ্যগতভাবে ভূল। বাস্তবে এই ধলই সীমান্ত কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত।
সচেতন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ধলই সীমান্ত কমলগঞ্জ উপজেলাধীন। কিন্তু এই ভুল সংশোধন করার ব্যাপারে সরকারীভাবে কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের সাথে সামিল হয়ে কমলগঞ্জের অনেক মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন। তাদের অনেকেই জীবিত আছেন। তারা বলেন, এখন নতুন পাঠ্য পুস্তক মুদ্রনের কাজ চলছে যদি এখনই এই ভুল সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে ২০১১ সালের পাঠ্যপুস্তকে সঠিক তথ্য জানতে পারবে নতুন প্রজন্ম। উপজেলা প্রাথমিক শিা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিস ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর জাতীয় শিাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর সচিব বরাবর চতুর্থ শ্রেণীর বইয়ে হামিদুর রহমান পাঠে শ্রীমঙ্গলের স্থলে কমলগঞ্জ উল্লেখ করার জন্য লিখিতভাবে চিঠি দেয়ার পরও এখনো কোনো কার্যকর পদপে নেওয়া হয়নি। জাতির শ্রেষ্ট সন্তান হামিদুর রহমানের শহীদ হওয়ার সঠিক স্থান নিয়ে তথ্য বিকৃতির অবসান সম্পর্কে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, তথ্যভ্রান্তি দূরীকরনে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামী বছরের শিক্ষা পাঠ্যসূচীতে এর ভ্রান্তি দুর হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দেশ প্রেমিক তরুন হামিদুর রহমান দেশকে পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত করার শপথ নিয়েই মৌলভীবাজার এলাকায় অংশ গ্রহন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মৌলভীবাজারে সর্বচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার পরও তার স্মৃতি রক্ষায় নেই কোনো উদ্যোগ। ৪৩ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে কমলগঞ্জ উপজেলায় নবনির্মিত অডিটোরিয়ামটি বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে করার দাবী করেন হামিদুর রহমান এর সহযোদ্ধা।
২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কবর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা গ্রাম থেকে এনে পূর্ন রাষ্ট্রীয় মর্যদায় শহীদ বুদ্ধিজীবি কবর স্থানে সমাহিত করা হয়।