একজন জগৎজ্যোতি! বাংলাদেশের প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ! যাকে ’৭১ এর ১৬ নভেম্বর শহীদ হবার পর অনন্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাব প্রদানের ঘোষনা দেয়া হয়। কেন ঘোষনা দিয়েও জগৎজ্যোতিকে প্রদান করা হলো না মরনোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব- এই প্রশ্নের উত্তর আজো অজ্ঞাত। জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের গবেষকরাও আজও খুঁজে বেড়ান এই প্রশ্নের উত্তর।
আর আজ তাকে নিয়েই এ আয়োজন।
সূর্যের লাল আভাটা পশ্চিমাকাশে! সময় তার শেষ সন্ধায় দাঁড়িয়ে। যুদ্ধের মিশনে এক যোদ্ধার মরণপণ চালিয়ে যাওয়া ক্রান্তিকাল। সহযোদ্ধাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়ে মরনপন লড়াই চালিয়ে যাওয়া যোদ্ধা। হঠাৎ! পাশে থাকা সহযোদ্ধাও গুলিবিদ্ধ। নিজের মাথার গামছা খুলে বেঁধে রক্তপড়া বন্ধ করেন সহযোদ্ধার। পালানোর প্রস্তাব। কিন্তু না! গর্জে ওঠে তার বীরকন্ঠ। তেজোদীপ্ত সুরে বলে- ‘পালাবো না, সবকটাকে শেষ করে তবে যাবো।’ তারপর ! একাই ১২ জন পাকসেনাকে খতম। অস্ত্রভান্ডারও শূন্য। তবু পিছু ফেরা নয়! আচমকা একটা বুলেট সূর্যের লাল আভাটার ন্যায় বিদ্ধ হয় যোদ্ধার শরীরে। শেষবারের মতো চিৎকার করে ওঠা- ‘আমি যাইগ্যা’।
শেষ চিৎকার! সূর্যের প্রদীপ নিভে যাওয়ার সাথে সাথে এক যোদ্ধার আলোও নিভে যায়! বলছি যোদ্ধা নামের সেই ব্যক্তিটির কথা। যুদ্ধের ময়দানে যার হাত দিয়ে তৈরি হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ‘দাস পাটির্’। যাকে ’৭১ এর ১৬ নভেম্বর শহীদ হবার পর অনন্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাব প্রদানের ঘোষনা দেয়া হয়। সেই যোদ্ধা, সেই খেতাব যার গলায় পরার কথা তিনি আমাদের অহংকার ‘জগৎজ্যোতি’। আমাদের নিজস্ব মানচিত্র আর নিজস্ব পতাকার মালিকানা দিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেয় সেই ‘জগৎজ্যোতি’ দাস। অথচ তার প্রাপ্য সেই সর্বোচ্চ খেতাব আজও তাকে দিতে পারেনি দেশ!
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই মুক্তিযুদ্ধের উত্তরপূর্ব রণাঙ্গণের মুক্তি সেনাদের কাছে কিংবদন্তিতে পরিণত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্বগাথা সংগ্রামের কাহিনী। আজও তার কথা ভুলতে পারেনি যুদ্ধকালীন সময়ে তার সহযোদ্ধারা। তাদের চোখে এখনো ভাসে জগৎজ্যোতির সাথে তাদের শেষ দেখা।
একটি সম্মুখযুদ্ধে পাকবাহিনীর দোসরদের কূটচালের ফাঁদে পড়ে আর নিজ সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে গিয়ে আত্ম উৎসর্গ করেন জগৎজ্যোতি দাস। তবে তার আগেই শহীদ জগৎজ্যোতি অমর বীরত্বগাথার মাধ্যমে নিশ্চিত করে যান আমাদের নিজস্ব মানচিত্র আর নিজস্ব পতাকার মালিকানা। বিগত আ’লীগ শাসনামালে শহীদ জগৎজ্যোতির পরিবারকে একখন্ড জমি দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জগৎজ্যোতিরই নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেই অঙ্গিকারটিও কেবল ফাঁকা বুলির মধ্যেই থেকে গেছে। বাস্তবায়িত হয়নি আজও। ফলে মুক্তিযুদ্ধের অনন্য অবদানের জন্য মরনোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব অর্জনকারী প্রথম ব্যক্তিটির উত্তরসূরীরা এখন যাযাবরের মতো জীবন কাটাচ্ছেন। এককালে তাদের নিজেদের যে বাড়িটা ছিলো, ’৭১-এ জগৎজ্যোতিকে হত্যা করে সেই বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো হায়েনারা। তারপর অভাবের তাড়নায় ভিটেমাটিও বিক্রি করে ফেলে জগৎজ্যোতির পরিবার। এখন জগৎজ্যোতির উত্তরসূরীরা হবিগঞ্জে ভাড়া করা বাড়িতে থাকেন। দিনমুজুরের কাজ করে টেনে চলেন জীবিকার জোয়াল।
একজন ‘জগৎজ্যোতি’
গ্রামের নাম জলসুখা। হবিগঞ্জের আজিমিরগঞ্জ উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম। সেই গায়ের জীতেন্দ্র চন্দ্র দাস ও হরিমতি দাসের কনিষ্ঠ পুত্র জগৎজ্যোতি দাস। জগৎজ্যোতির জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল। বাবা ও বড় ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেই ১৯৬৮ সালে ২য় বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন জগৎজ্যোতি।
দাস পার্টি
১৯৭১ সালে জগৎজ্যোতি ছিলেন সুনামগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সারির কর্মী। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার লক্ষে সদলবলে ভারতের শিলংয়ে ট্রেনিং নিতে যান তিনি। নেতৃত্বগুন সম্পন্ন, নেতৃত্বের প্রতি সংবেদনশীলতা, কঠোর পরিশ্রমি এবং ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার দক্ষতা থাকার কারনে সে দলের নেতা মনোনিত হন জগৎজ্যোতি। জ্যোতির নেতৃত্বাধীন এই দলটিই পরবর্তীতে ‘দাস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী ও রাজাকারদের কাছে দাস পার্টি ছিলো মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাফল্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তৃর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়ে জগৎজ্যোতির উপর। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় জ্যোতির দাসপার্টি। ভাটির জনপদে শত্রুদের ভীত কাঁপিয়ে দেন জগৎজ্যোতি। দাস পার্টির মূহুর্মূহ আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না।
মাত্র ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বানিয়াচংয়ে প্রায় ২৫০ পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের ঠেকিয়ে দেন জ্যোতি। এ লড়াইয়ে প্রাণ হারায় শত্রু পরে ৩৫ সদস্য। পাকিস্তানিদের গানবোট ধ্বংস করে দেন জগৎজ্যোতিরা। ১৭ আগস্ট পাহাড়পুড়ে জগৎজ্যোতির বুদ্ধিমুত্তা ও বীরত্বে রক্ষা পায় অসংখ্য নিরীহ বাঙালির প্রাণ ও নারীর সম্ভ্রব। এখানেও পিছু হটে পাকিস্তানীরা। এরপর একের পর এক যুদ্ধজয়ী অভিযান চলতে থাকে জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন দাস পার্টির।
যুদ্ধের ময়দানে জগৎজ্যোতি
জগৎজ্যোতি একদম একা হাতে একটা এলএমজি নিয়ে দখল করে নেন জামালগঞ্জ থানা ভবন। সেখানে আস্তানা গেড়েছিলো রাজাকাররা। এরপর জামালগঞ্জ মুক্ত করার অভিযানে রাখেন গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা। এ সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। মাত্র ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শ্রীপুর শত্রুমুক্ত করেন জগৎজ্যোতি। খালিয়াজুড়ি থানায় ধ্বংস করে দেন শত্রুপরে বার্জ। আগস্ট মাসে দিরাই-শাল্লায় অভিযান চালিয়ে কোনরূপ গুলি ব্যয় না করেই কৌশলে আটক করেন ১০ জন রাজাকারের একটি দলকে। যারা এলাকায় বেপোরোয়াভাবে খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাচ্ছিলো। রানীগঞ্জ ও কাদিরীগঞ্জে অভিযান চালিয়েও জ্যোতি আটক করেন রাজাকারদের। জগৎজ্যোতি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এক কিংবদন্তির নাম। সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস।
চক্রব্যুহে অভিমন্যু
১৬ নভেম্বর ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই দাস পার্টির ৪২ সদস্য নিয়ে নৌকাযোগে বাহুবল অভিযানে রওয়ানা দেন জগৎজ্যোতি। ল্ক্ষ্যস্থলে যাওয়ার পূর্বেই বদলপুর নামক স্থানে হানাদারদের পাতা ফাঁদে পা আটকে ফেলেন জগৎজ্যোতি। বদলপুরে পৌঁছামাত্রই জগৎজ্যোতি দেখতে পান ৩/৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছে। ক্ষুব্ধ জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেই পিছু হঠতে থাকে রাজাকাররা। এতে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জ্যোতি। ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে তাড়া করেন রাজাকারদের। অথচ কুচক্রীরা পাকসেনাদের বিশাল বহর আর প্রচুর সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে একটু দূরেই ঘাপটি মেরে ছিলো। শুরু হয় এক জ্যোতির সীমিত গোলাবারুদের সাথে পাকবাহিনীর বিশাল অস্ত্রভান্ডারের এক অসমযুদ্ধ। এক পর্যায়ে গোলাবারুদ কমে আসায় বেকায়দায় পড়ে যায় দাস পার্টি। সঙ্গীদের জীবন বাঁচাতে স্থান ত্যাগের নির্দেশ দেন জ্যোতি। সহযোদ্ধাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়ে মরনপন লড়াই চালিয়ে যান জগৎজ্যোতি ও তার সহযোদ্ধা ইলিয়াস। হঠাৎ করে ইলিয়াসও গুলিবিদ্ধ হন। নিজের মাথার গামছা খুলে জ্যাতি ভালো করে বেঁধে রক্তপড়া বন্ধ করেন ইলিয়াসের। ইলিয়াস পালানোর প্রস্তাব দেন। গর্জে ওঠে জগৎজ্যোতির বীরকন্ঠ।
তেজোদীপ্ত সুরে বলেন- ‘পালাবো না, সবকটাকে শেষ করে তবে যাবো।’ একাই ১২ জন পাকসেনাকে খতম করে দেন জ্যোতি। বিকেল পৌনে পাঁচটা। জ্যোতির অস্ত্রভান্ডার শূন্য। তবু পিছু ফিরছেন না। এমন সময় আচমকা একটা বুলেট বিদ্ধ হয় জ্যোতির শরীরে। জগৎজ্যোতি শেষবারের মতো চিৎকার করে ওঠেন- ‘আমি যাইগ্যা’।
মৃত জগৎজ্যোতিতেও ভীত রাজাকারেরা
জগৎজ্যোতির নিথর দেহকেও রেহাই দেয়নি পাক হায়েনাদের দোসররা। আজিমিরিগঞ্জ বাজারে যেদিন জ্যোতির লাশ আনা হয় সেদিন ছিলো ঈদের বাজার। বীর সেনার লাশ দেখতে শত শত লোক জড়ো হন বাজারে। মুক্তিযোদ্ধার পরিণতি দেখানোর জন্য জ্যোতির নিথর দেহ রাজাকাররা বেঁধে ফেলে ইলেকট্রিক খুঁটির সাথে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচাতে থাকে জ্যোতির শরীর। তবিত করার পর বিবস্ত্র করা হয় এই প্রয়াত সেনাপতিকে। সদলবলে জ্যোতির গায়ে থু থু ফেলে রাজাকারের দল। এই বিভৎসতার স্মৃতি ধরে রাখতে এক দালালকে দিয়ে সেই ছবিও তুলানো হয়।
এইখানেই থামে না রাজাকাররা। জগৎজ্যোতির মা-বাবাকে নিয়ে জ্যোতির বিভৎস লাশ দেখিয়ে তারা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। লাশ নিয়ে যখন পুরো পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে তখন রাজাকারেরা আগুন ধরিয়ে দেয় জগৎজ্যোতিদের বসত ভিটায়। এরপর জগৎজ্যোতিকে ভাসিয়ে দেয়া হয় ভেড়ামোহনা নদীর জলে। এভাবেই ঘটে দেশ মাতৃকার শ্রেষ্ঠতম সন্তানটির ভাসানযাত্রা।
সর্বোচ্চ খেতাবের ঘোষণা
যুদ্ধ ক্ষেত্রে জ্যোতির শহীদ হবার সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। সেই সাথে তার বীরত্বগাঁথা তুলে ধরা হয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা করেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয়। এই ঘোষণায় অনেক মুক্তিযোদ্ধাই উদ্ভুদ্ধ হয়েছিলেন, সাধুবাদ জানিয়েছিলেন সরকারকে।
জগৎজ্যোতিকে মরনোত্তর সর্বোচ্চ পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েও সে প্রতিশ্রুতি থেকে অজ্ঞাত কারণে সরে আসে সরকার। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয় তাকে। এই পুরস্কারও বাস্তবে প্রদান করা হয় আরো দু’যুগ পর। কেন ঘোষনা দিয়েও জগৎজ্যোতিকে প্রদান করা হলো না মরনোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব- এই প্রশ্নের উত্তর আজো অজ্ঞাত। জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের গবেষকরাও আজও খুঁজে বেড়ান এই প্রশ্নের উত্তর। তাদের নানা লেখায় প্রকাশ পেয়েছে এ নিয়ে ক্ষুভ।
মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী ‘একাত্তরের দির