১৯৮৭ সন।
বেবী আপা দৃঢ়ভাবে বললেন, মনটা শক্ত কর। জানতে চাইলাম, কেন?
'সোনিয়া তোমার সাথে দেখা হউক আর চায় না। সে চায় না তোমার সাথে আর সম্পর্ক থাকুক, ভুলে যাও, ভুলে যাও ।' শেষের ‘ভুলে যাও’ কথাটি বলতে কস্ট পাচ্ছিলেন, উনার গলা ধরে আসছিল।
আমাদের সম্পর্কের অনেক কিছুর সাক্ষী বেবী আপা। দেখা হলেই সোনিয়াকে নিয়ে কোন একটা কথা বলে আমাকে লজ্জায় লাল করে দিতেন। আমাকে লজ্জা দিয়ে তিনি বিশেষ মজা পেতেন। শুরুতে বরাবরের মতো লজ্জা দিয়ে এবার আর আমার মুখ রাঙানোর চেষ্টা করলেন না। আমি বলার ধরন দেখে বুঝে গেলাম, সোনিয়া আর আমার প্রেমের সম্পর্ক আর নেই। ভালোই তো ছিলো সব, হঠাৎ কি এমন হলো? প্রচন্ড অভিমান পেয়ে বসলো, কি কারণে চায় না দেখা হোক জানতেও ইচ্ছা করলো না।
ব্যাথায় মাথাটা নুয়ে পড়তে লাগলো, মনে হচ্ছে মাথাটা বারান্দার গ্রিল বানানোর দোকানে পড়ে ছিল, লোহার হাতুড়ির বাড়ি ক্রমাগত মাথায় পড়েছে। ফিরে আসবার সময় দেখি বেবি আপার চোখের কোনায় পানি জমেছে, চোখের পাতা থিরথির করে কাঁপছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে রুমে ফিরে আসলাম।
সারাক্ষণ এলমেলো একই চিন্তা ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো, কি এমন হলো যে আমায় ছেড়ে চলে গেলো, কি দোষ ছিল আমার! শেষ যেদিন দেখা হয় সে বলেছিলো, কিছুদিন হলো মহল্লার কিছু বখাটে ছেলে বিরক্ত করছে। সে কি চেয়েছিল আমি হলের চেনা কিছু ক্যাডার নিয়ে বখাটেদের শাসিয়ে দিয়ে আসবো? উল্টো মজা করে বলেছিলাম, সুন্দরী মেয়েদের পাড়ার ছেলেরা একটু তো বিরক্ত করবেই। সেদিন তাঁর মুখটা একটু মলিনই ছিলো, আমি অমন করে বললাম কেন? সেজন্যেই কি দূরে চলে গেলো?
রাতে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে গেলাম, আগেই ঠিক কর ছিল। ফেরার পথে শাকুরের দোকানে ডিম পরটা খেলাম, ওরা কেরু কোম্পানির মদ নিলো। হলে এসে আনসারীর রুমে মদ আর তাসের আড্ডা জমে উঠলো। সবাই কয়েক ঢোক গিললো আর রিয়াজ আমায় মৃদু ভর্ৎসনা করে বলল ‘তুই তো আবার খাবি না, জানলে তোর ‘উনি’ তো রাগ করবে। আমি আর বলতে পারলাম না, সে আর কোনদিনই রাগ করবে না। আমি বললাম, আমিও খাব, দে। রিয়াজ বলল, আরে খা, খা, একদিন খেলে কিচ্ছু হয় না।
এত হৈচৈ আর আড্ডার মাঝেও চোখ বন্ধ করে নির্জনতা খুঁজে নিই। বেশ কিছুক্ষণ পর মনে হল আমার পাকস্থলি বের হয়ে আসছে, কয়েকবার বমি হলো, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে মনে হলো। রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বরের প্রকোপও বাড়তে লাগলো। শেষরাতে আনসারীর রুম থেকে বের হতে যেয়ে পড়ে গেলাম। রুমমেট রিয়াজ গায়ে হাত দিয়ে বলল, তোর গা তো আগুনের মত পুড়ছে। এর পরের কোন কিছু মনে নেই, সকালে আবিস্কার করলাম আমি হাপাতালে। কিছুক্ষণ পর রিয়াজ আসলো, কি রে এখন কেমন আছিস? আমি ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকলাম, কথা বলার শক্তি বা আগ্রহ কোনটাই নেই। একটু থেমে বলল, তোর মনটাও যে রকম নরম পেটটাও সেরকম, চিন্তা করিস না সুস্থ হয়ে যাবি।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি, অনেকেরই স্বজন পাশে রয়েছে, কত আদর ভরসা তাঁদের, সোনিয়া যদি একটু আসত, কপালে হাত বুলিয়ে দিতো! আমি জানি সোনিয়া আসবে না, তবু ভাবলাম যদি আসে! সকাল পেরিয়ে দুপুর হোল, ডাক্তার সব দেখেশুনে আমায় রিলিজ করে দিল।
হলে আর কিছুতেই মন টিকছিল না, নাইট কোচে চড়ে বসলাম। সকালে বাসার সকলে আমায় হঠাৎ পেয়ে খুব খুশি। মা আমায় দেখে বুঝে ফেললেন কিছু একটা ঠিক নাই কিন্ত মুখে কিছু বললেন না। ছোট বোন দুটি স্কুলে গেল না, বাবাও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলেন অনেক বাজার নিয়ে। মা আমার প্রিয় রান্নাগুলো শুরু করে দিলেন। রোজি, ডেইজি ঘরের চারপাশ ঘুরতে লাগলো কখন আমি তাদের সাথে গল্প করব। বাবা ড্রয়িং রুমে একটানা টিভি দেখতে লাগলেন। কিন্ত মনে এত বিষাদ নিয়ে কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হলো না, নিজের ঘরে যেয়ে শুয়ে রইলাম। সে রাতের বাসে ফিরে আসবার আগে সবাইকে বললাম, তোমাদের সবাইকে খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো তাই দেখে গেলাম। রোজি, ডেইজি সামনের ছুটিতে তোদের সাথে অনেক গল্প করব, সিনেমা দেখতে নিয়ে যাব। মা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে চোখের কান্না আড়াল করে ফেললেন।
আমাকে ফিরে আসতে হলো, ক্লাস চলছে, আর দুইমাস পর ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা। ক্লাসে যাই, আর আসি কিন্ত পড়াশুনায় মন দিতে পারি না। ঘুরেফিরে সোনিয়ার চিন্তা চলে আসে। ক্লাসে স্যার একদিন এক প্রশ্ন করলেন, আমি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার বুঝলাম না।
স্যার বললেন, তুমি তো মনে হয় কি বুঝ না তাও বুঝ না। সবাই হো হো করে হাসল। আমি আসলেই এখন সহজ বিষয়ও বুঝি না। সোনিয়াকে হারানোর পর সব তালগোল পাকিয়ে গেছে।
রিয়াজ জেনে গেছে আমি একজন ব্যার্থ প্রেমিক, তবু সে এ নিয়ে আমাকে কিছু বলে না, করুনা করে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। সেদিন রিকসায় করে হলে ফিরছি, হটাৎ একটা ট্রাক খুব পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে পার হয়ে গেল অনেক ধুলা উড়িয়ে, মনে হল ইঞ্চিখানেক দূরে ছিলাম মৃত্যুর হাত থেকে, কিন্ত পরক্ষনেই মনে হলো এই ইঞ্চি দূরত্বটুকুন না থাকলেও চলত, কেন ট্রাকটা আমায় ধাক্কা দিল না, সমস্ত দুঃখটুকুন কেন উড়িয়ে নিয়ে গেল না!
পড়ার টেবিলে বসলে নানান রকম কল্পনা মাথায় আসে, নিজের কাছে নিজেকেই অসহায় মনে হয়, গভীর রাত পর্যন্ত রুমে একা একা বসে থাকি, দেখি সোনিয়া শাদা রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে ঘরের কোনায়। আমি কাছে এগিয়ে যেতে থাকি, দেখি শাড়ির রং বদলে নীল হয়ে যাচ্ছে, আমি আরো কাছে যাওয়া শুরু করি , যতই কাছে যাই ততই সেই নীল রং গাঢ় হতে থাকে, গাঢ় হতে হতে কালচে রঙে দেয়ালে মিলিয়ে যায়।
টেবিলে সোনিয়ার দেওয়া কয়েকটা বই। আমার জন্মদিনে পাওয়া। বইগুলো শুধু সাজানোই থাকে, পড়া হয়ে উঠেনি। দেয়ালে একটা পেইন্টিং তাঁরই দেয়া, The Storm। বলেছিলো, শোন তোমার রুমে আসলে দেয়ালটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে, একটা পিয়েরে অগস্টের ফ্রেঞ্চ পেইন্টিং এনেছি। পেইন্টিংটা দেয়ালে স্কচ টেপ দিয়ে ঝোলানোর পরে সোনিয়া কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বললো, দেখো প্রেমিক প্রেমিকাকে কেমন করে বাহু আগলে ঝড়ের রাতে দৌড়াচ্ছে!
এক ভোররাতে স্বপ্নে দেখলাম ঝড়ে পড়েছি, Storm পেইন্টিংটার মত আমরা দৌঁড়াচ্ছি আর দৌঁড়াচ্ছি। ঘুম ভেঙে দেখি পেইন্টিংটার টেপ একদিকে খুলে হেলে পড়েছে, আগে কখনো সেটা খেয়াল করিনি। সেটা ঠিকমত লাগানোর আগ্রহ পেলাম না।
রিয়াজ সবকিছুই খেয়াল করছিল, মাঝে মাঝে ওকে দেখলে মনে হয়, সে সম্ভবত অনেক কিছু জানে, হয়ত জানে সোনিয়া কেনো দূরে সরে গেলো, কিন্ত তাঁর সাথে তো বেবি আপার তেমন জানাশোনা নেই। একবার অল্প সময়ের জন্য রিয়াজের সঙ্গে দেখা করিয়েছিলাম, এই বিরাট শহরের কোন বাসায় সোনিয়া থাকে তা তাঁর জানা সম্ভব না।
খুব কষ্ট হতো, তবে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলাম, বাড়ির বড় ছেলের দায়িত্ব অনেক, ব্যার্থ প্রেমের শোক হৃদয়ের কোনায় লুকিয়ে রাখতে হয়। আমি পাশ করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করলাম।
রিয়াজ এখন আমেরিকায় মাস্টার্স করছে, আর বাকি সবার সাথে যোগাযোগ রাখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। বন্ধুহীন সময় পার হয়ে যায়। অফিস যাই আর আসি, কারও সাথে আমার সময় কাঁটানোর কেউ নেই, এ শহরে দুতিন দূরসম্পর্কের আত্মীয় আছে, তাদের ঠিকানা, ফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি, অনেকটা ইচ্ছা করেই হারিয়ে ফেলেছি। সোনিয়ার কথা এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, সেইসব রাতে গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না। স্মৃতির খামগুলো বের করি, কি এক অজানা কষ্ট হৃদয় ভেদ করে বের হয়ে আসে, মনটা থমকে যায়, সময়টা আটকে যায় অতীতে। সে রাতগুলোতে তাঁকে দেখার সুতীব্র ইচ্ছা হয়, ভাবি আর কোনদিন কি দেখা হবে!
ছুটির দিনগুলোতে আমি সকালে দৈনিক পত্রিকাগুলো দেখি, দেখি কোথায় কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে, আমি যে কোন এক অনুষ্ঠানে চলে যাই। যেমন, আর্ট গ্যালারি, দর্শনার্থীর ভিড় নেই, যতক্ষণ খুশি থাকা যায়। অলস সময় কাটানোর এরচেয়ে আর উৎকৃষ্ট জায়গা হয় না। বিমূর্ত চিত্রশিল্প আমি বুঝি না, তবু দাঁড়িয়ে থাকি, বোঝার চেষ্টা করি। একদিন ছবি দেখতে দেখতে ক্লান্ত, মাথার ওপরে সিলিং দেখছি, আশপাশের দেয়াল দেখছি। দূর থেকে মনে হলো গাড় নীল শাড়ি পড়ে কে যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে, হাঁটার চলন দেখে মনে হচ্ছে সোনিয়া, সেও তো আর্ট পছন্দ করে, শৈল্পীক মন। মনের ওপর অভিমানের ঝড় এসে পড়লো। আমি দ্রুতগতিতে উলটো দিকে হেঁটে বের হয়ে গেলাম। ফিরে এসে সারাক্ষণ নিজেকে দুশতে লাগলাম, কেন দাঁড়িয়ে দেখলাম না সে সত্যি সোনিয়া কি না, নিজের বোকামি সারাদিন সুচের মত মনে খোঁচা দিতে লাগলো।
সোনিয়া আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল, বলেছিল সব কথা মুখে বলা যায় না তাই চিঠিতে লিখলাম। এই চিঠিটা আমি ছিঁড়তে পারিনি, যক্ষের ধনের মত আগলে রাখি, যেখানেই যাই সযতনে লুকিয়ে রাখি। আজ আবার খামটা বের করলাম, চিঠিটা খুললাম, চিঠির গন্ধে বুকটা চিনচিন করে উঠলো, পৃষ্ঠার ভাঁজে রাখা রজনীগন্ধা ফুলের পাঁপড়িগুলো বের হয়ে আসলো। চিঠির শুরুতেই লেখা, আমারও পরানো যাহা চাই তুমি তাই গো। আজকে শিমুল বাগানে পিকনিকে গিয়েছিলাম। শিমুল ফুল কুঁড়াচ্ছিলাম আর তোমায় খুঁজছিলাম, একটা শিমুলফুল খোঁপায় বেঁধে দেবে? জানো, শিমুল বাগানের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা নদী চলে গেছে। আমার সবাই নৌকায় করে ঘুরলাম। কত হইচই আর আনন্দ। আমি ফাঁকে ফাঁকে পানির দিকে তাকাচ্ছিলাম আর নিজের ছবির পাশে তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তোমাকে খুব মিস করেছি সারাদিন।
নাতিদীর্ঘ এ চিঠির বাকিটুকুন আর পড়তে পারি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ভাবি তুমি কি কখনো আমাকে আর মিস করো! অথবা কোন সকাল বেলায় আয়নায় তোমার চেহারার পাশে ভুলে আমাকে দেখতে পাও! সেদিন কি সেই শিমুল বাগান আর নদী তোমায় বিষণ্ন করে তোলে!
এর মধ্যে হটাৎ মা ফোন করে বাসায় আসতে বললেন, বাবা খুব অসুস্থ, হাসপাতালে। নাইট কোচে বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। সকালে হাসপাতালে সরাসরি চলে গেলাম। বাবার ম্যাসিভ হার্ট এ্যট্যাক হয়েছে। গভীর ঘুমে অচেতন বাবা আর জেগে উঠলেন না, পরপারে চলে গেলেন।
শোকে আমি আরো জড়োসড়ো হয়ে মুষড়ে পড়লাম। ফজরের নামাজ পড়ে আমার দিন শুরু হয়, রাতে এশার নামাজের পড়ে সূরা ইয়াসিন পড়ি। জসিমউদ্দিনের 'শোন মোমিন মুসলমান, করি আমি নিবেদন' গানটি কেমন জানি দীর্ঘশ্বাস ফেলার জায়গা করে নিলো। শোক আর পারিবারিক দায়িত্বে সোনিয়া আমার জীবন থেকে প্রায় হারিয়ে গেলো।
মাস দুই পর শীতে আমার সাময়িক বদলি হলো রাজশাহীতে। এ শহরটি ছিমছাম, কোন কোলাহল নেই। হোটেলে চেকইন করে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো। কাছেই নদীর পাড়, সেদিকে যাবার উদ্দেশ্য বের হলাম। একটা খালি রিক্সা পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, উদাস মুখে তাকাচ্ছে সকালের প্রথম ভাড়াটা যদি হয়। দরকার নাই তবু উঠে পড়লাম। কিছু মুসল্লি নামাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কিছু পাখি গাছে আর কিছু নিচে নেমে দিন শুরু করেছে, কি সুন্দর তাদের গুঞ্জন। মনে হলো অনেকদিন পর তাদের কিচিরমিচির কানে আসলো। বুক ভরে নিঃশাস নিলাম।
অফিসে সকালের দিকে নিজের ডেস্কে ফিরে আসছি, মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় প্রেজেন্টেশনের জন্য একজন মহিলা সহকর্মী একটা ছোট স্ট্রাকচার দাঁড়া করানোর চেষ্টা করছেন, কিন্ত বারবার পড়ে যাচ্ছে। কাছে যেয়ে বললাম, ‘আমি কি একটু ট্রায় করতে পারি?'
‘স্ট্রাকচারটা ব্যালান্স করতে পারছি না। এই নিন ধরুন।’
আমি ধরবার কয়েক সেকেন্ডে কাজটি হয়ে গেল, একটা লক পুরাপুরি পুশ করা ছিল না। তিনি বললেন,
'দারুন, অনেক শুকরিয়া, আপনি তো খুব স্মার্ট! আমি লাইজু, আপনি?'
'আমি রেহমান'
'ঢাকা থেকে নিশ্চয়? শুনেছিলাম আজ সকালে ঢাকার অফিস থেকে একজন জয়েন করবেন।
'হ্যা'
'আচ্ছা এখন যান পরে কথা হবে।'
অল্প হাসিতে আন্তরিক ভাবেই বললেন এবং কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মিস লাইজু আমার মতই সম্ভবত পাশ করেই চাকুরিতে ঢুকেছেন। উনাকে খোলামেলা, প্রাণবন্ত মনে হলো। শাড়ির প্রত্যেকটা ভাঁজ মনে হলো আলাদাভাবে ভাঁজ করেছেন, অত্যন্ত পরিপাটি মূর্ত শিল্প। স্নিগ্ধ মুখাবয়বে কোন মেকাপ নেই অথবা থাকলেও বোঝার উপায় নেই। গলার স্বর অনেকটা রানী মুখার্জির মত কিছুটা হাস্কি কিন্ত কনফিডেন্ট।
আজকে অফিসে লাঞ্চের ব্যাবস্থা আছে, রাজশাহী ব্র্যাঞ্চ সেলস টার্গেট এক্সসিড করেছে সেই উপলক্ষে। কাজ গুছিয়ে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। মিস লাইজু পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন, বললেন,
'আপনি খেয়েছেন তো?'
'না'
'ঠান্ডা হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি যান, হাঁসের ভুনা চমৎকার হয়েছে, ওটা মিস করবেন না।'
'হাঁসের ভুনা আমার ভীষণ প্রিয়।'
'আর লেবু দিয়ে খতে চাইলে ভুট্টোকে বলবেন সে এনে দিবে'
আমি উনার ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কদিন হলো এসেছি অথচ মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা।
সকালে টি-রুমে গেলাম চা বানানোর জন্যে, আমাদের টি-বয় ভুট্টো আসেনি। মিস লাইজু কেতলি থেকে গরম পানি ঢালছেন। পানির গরম বাষ্প উনার মুখে ছড়িয়ে পড়ছে, ভারী সুন্দর সে দৃশ্য। আমি ভেতরে আসতেই তিনি বললেন, আজ ভুট্টো নেই আসুন এখানে কি কোথায় আছে দেখিয়ে দিই।
তিনি দেখাচ্ছেন কোথায় কাপ, চায়ের পাতা, চিনি, চামচ ইত্যাদি। কিছুক্ষণ থেমে বললেন বললেন, ‘আচ্ছা থামুন, প্রথম চা-টা করে দেখিয়ে দিই আপনাকে।’
‘ছি ছি আপনি কষ্ট করবেন কেনো, আমি করে নিচ্ছি।’
‘ধরুন আজ আমার জন্মদিন, সেই উপলক্ষে করে দিচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ, এরকম জন্মদিন বার বার ফিরে আসুক।’
আমরা দুজনেই হেসে ফেললাম, আজকের সকালটা অন্যরকম মনে হতে লাগলো।
বিকালে নিউমার্কেটে সময় কাটানোর জন্য গেলাম, অনেকটা উইন্ডো শপিং। তবু একটা নীল শার্ট কিনলাম, ঘুরতে ঘুরতে একটা পারফিউমও কিনে ফেললাম, অনেকদিন ব্যাবহার করা হয়নি। একটা গল্পের বই কিনলাম, রাতে সময় কাটবে। আরো একটি বই কিনলাম মিস লাইজুর গতকালকের জন্মদিনের উপহার হিসাবে। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখে দিলাম, “Belated happy birthday, এক কাপ চা নিয়ে বইটি পড়ুন।”
সকালে মিস লাইজুর কিউবিকলের পাশ দিয়ে কয়েকবার গেলাম, কিন্ত জন্মদিনের উপহারটা দিতে পারলাম না। চারিদিকে সবাই কাজ করছে এর মাঝে একজন মহিলা সহকর্মীকে বই উপহার দেয়াটা উনার জন্য হয়ত খুব অস্বস্তির হবে, অন্যরাও কি বা মনে করবে। ভাবলাম দিন শেষে সবাই যাবার পর দিয়ে আসবো। কাজ শেষে যখন উনার ডেস্কের কাছে গেলাম তখন পুরো অফিস ফাঁকা, টি-বয় ভুট্টোও নেই। আমি উনার ডেস্কে বইটি রেখে দিলাম।
পরের দিন সকালে ব্যাংকে যেতে হলো, কিছু কাজ ছিলো। অফিসে আসতে একটু দেরী হলো। দেখলাম ডেস্কের উপর ছোট্ট একটা চিরকুট “গল্পের বইয়ের জন্য ধন্যবাদ, এক কাপ চা নিয়ে কাজে বসে পড়ুন।” মনের অজান্তে হেসে ফেললাম, এরকম হাসি অনেকদিন হাসিনি, মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে একটা পাথর সরে যাচ্ছে।
একদিন বিকালে সবাই চলে গেছে, হোটেলে যেতে মন চাইছিল না, কিছুক্ষণ চারপাশ হাঁটলাম, ফাঁকা, কেউ নেই, কথা বললে আমার শব্দ আমার কানেই আসবে। কি মনে করে একটা চিরকুটে লিখলাম, 'সেদিন হাঁসের ভুনা চমৎকার ছিলো'। আমি সেটি মিস লাইজুর ডেস্কে দিয়ে চলে গেলাম এই আশায় যে পরের দিন সকালে কোন চিরকুট পাবো মিস লাইজুর কাছ থেকে। সেরকম কোন কিছুই ঘটলো না সেদিন, সেদিন আমি ডেস্ক থেকে পারতপক্ষে উঠলাম না, কোনক্রমেই মিস লাইজুর সাথে মুখোমুখি হতে চাইলাম না। পরেরদিন সকালে দেখি ডেস্কের উপর একটি টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত ও হাঁসের ভুনা মাংস এবং একটি ছোট চিরকুট। অসম্ভব ধরণের ভালো লাগার অনুভূতি, আমার চোখে পানি আসবার উপক্রম হলো। এভাবে মাঝে মাঝে চিরকুট চালাচালি চলতে চলতে আমাদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। তিনিও হাত বাড়িয়ে দিলেন আর আমিও, আমার সামনের এই লম্বা জীবন তো আর একা পার করে যায় না!
লাইজুর সাথে ঘুরতে ঘুরতে পুরো শহর চেনা হয়ে গেলো। ঝাল চাটনি দিয়ে কালাই রুটি খাওয়া শিখলাম, বট আর পরোটা খেলাম আর খেলাম বারো ভাজা। 'আপনি' থেকে সম্পর্ক এক সময় 'তুমি' হয়ে গেলো। আমার ফিরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসলো। আসার আগের দিন আমরা পদ্মার ধারে বেড়াতে গেলাম। প্রাণবন্ত লাইজুকে অনেকটুকু চিন্তিত আর নিস্পৃভ দেখলাম। তাঁকে চাঙা করার জন্যে তাঁর প্রিয় বাদাম ভাজা আর আমরার টকঝাল অর্ডার করতে যাবো এমন সময় সে বললো সে খাবে না, আজ রোজা। আমি শ্রদ্ধায় নত হয়ে গেলাম। একটু নির্জনে নিয়ে বললো,
'আমায় ভুলে যাবে না তো?'
'না, কেন বলছো?'
'ঢাকা অনেক বড় শহর। অনেক মানুষ সেখানে, কত আনন্দ, কত উৎসব,
বড় ভয় হয়, আমার হাত ছুঁয়ে বলতে পারো?'
'হাত ছুঁয়ে বলছি আমি আছি, থাকবো তোমার হয়ে চিরকাল।'
আমি ফিরে আসলাম আগের মেসের জায়গায়। মেসটাকে অন্ধকার কয়েদিদের কূপ মনে হতে থাকলো। মেসে থাকতে কেমন জানি বিবমিষা শুরু হলো। মেস ছেড়ে একটি বাসায় উঠলাম আরো দুজন সহকর্মীর সাথে। দেখে নিলাম অন্যদের রুম কিভাবে সাজানো, সেই সাথে নিজের রুমটিও একটু গুছিয়ে নিলাম। সহকর্মীদের সাথে দারুন ব্যাস্ত সময় পার শুরু করলাম। এক সাথে আড্ডা দেয়া, সিনেমা দেখা আর সময়ে সময়ে তাশ খেলে সময় চলে যেতে লাগলো।
লাইজুর সাথে নিয়মিত অফিস ফোনে যোগাযোগ অব্যহত রইলো। বর্তমানটা আমার কাছে রঙিন হয়ে ধরা দিলো। অতীতের গ্লানিগুলো মুছে দিতে চাইলাম। সোনিয়ার দেয়া চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললাম, সেটি শেষবারের মত পড়বার ইচ্ছাও হলো না, পেইন্টিংটাও ছিঁড়ে দিলাম। তাঁর দেয়া গল্পের বইগুলো বিনে পয়সায় নীলক্ষেতে দান করে দিলাম। আমি ক্যারিয়ারে মন দিলাম, সেলস প্রজেকশন, টার্গেট, এ্যচিভমেন্ট এগুলো জীবনের মোড় পাল্টা দিতে লাগলো। সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলে এলো, আমার জীবনে ছন্দ ফিরে এলো। এই পথ চলতে লাইজুকে আমার ভীষণ প্রয়োজন মনে হতে শুরু করলো। বিয়ের চিন্তা মাথায় আসা শুরু হলো। মাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। দোকানে যেয়ে মায়ের জন্য একটি শাড়ি আর রোজি-ডেইজির জন্যও কিছু কাপড় কিনে রাখলাম। মাকে ফোন করে জানিয়ে রাখলাম সামনের সপ্তাহে পহেলা বৈশাখের ছুটিতে আসছি।
আজ চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহের শেষ দিন। খুব ভ্যাপসা গরম। আকাশে কিছু কালো মেঘ করেছে। ডঃ আলমের চেম্বারে প্রেজেনটেশন আছে, বিখ্যাত প্লাষ্টিক সার্জন। আমাদের কিছু প্রোডাক্ট লঞ্চ হবে, উনাকে সেই দিনে আনার ব্যাপারে কনভিন্স করতে হবে। ঘন কালো মেঘ সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়লো, কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝাপিয়ে বৃষ্টি নামলো। ডঃ আলমের চেম্বারে যখন পৌঁছালাম তখনো মুষলধারে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আমি যেয়ে বসলাম পেশেন্ট রুমে, দিনের প্রায় শেষভাগ। এখানকার বেশির ভাগ রোগী আগুনে পোড়া অথবা বিভিন্ন কারণে যারা প্লাস্টিক সার্জারি করাচ্ছেন। একজন মহিলা রোগী বসে আছেন, তাঁর পাশের চেয়ারটা খালি। তাঁর দুই গাল একই রকম নয়, একদিকটা বেশ মসৃন, বোঝা যায় অন্য দিকটায় কিছুটা রিকন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। উনার চোখটা খুব পরিচিত, মনে হলো একদম সোনিয়ার মত। চোখে চোখ পড়তেই দেখি তিনি আমার দিকে অপলক তাঁকিয়ে আছেন, সে দৃষ্টি পাথরের মত। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর একজন মহিলা সেই খালি চেয়ারে বসলো। তিনি বললেন, কেমন আছো বাবা? আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। আমি দেখলাম ইনি সোনিয়ার মা, একবার খুব অল্প সময়ের জন্য কথা হয়েছিল তাঁদের বাসায়। আমি দ্বিধান্বিত যাঁকে উনার পাশে দেখছি সেকি সোনিয়া না তাঁর বোন তানিয়া! আমি বললাম, জি ভালো। তিনি নিজে নিজে বলা শুরু করলেন,
‘"মহল্লার পাষন্ড একটা ছেলে কিছুদিন তাঁকে বিরক্ত করছিলো। পড়াশুনা করা অসম্ভব হয়ে উঠছিল। সারাদিন বন্ধু নিয়ে বাসার সামনে আড্ডা দেয়। নিষেধ করলে ওঁর বাবাকে মারতে উদ্যত হয়। ওঁর মামার বন্ধুর পরিচিত মহল্লার ওয়ার্ড কমিশনার। উনার মাধ্যমে কমিশনার সাহেবকে সাহায্য করতে বললাম। উনি বাসায় এসে অভয় দিয়ে বললেন কোন ভয় নেই ওরা আর বিরক্ত করবে না। দেখলাম বাসার সামনে ওই ছেলেদের দলের আনাগোনা, আড্ডা আর নেই। আমার মেয়ে বাইরে যাওয়া আসা শুরু করলো। কদিন বাদে সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরছে, হঠাৎ বাসার সামনেই আমার সোনিয়ার মুখে এসিড ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।"
তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সোনিয়ার পাথর চোখ দেখি তখন ভিজে নত, দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, সোনিয়াও তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি আর সোনিয়া মুখোমুখি। আজ এই মুহূর্তে আমায় জীবনের এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সোনিয়াকে ফেলে গেলে প্লাস্টিক সার্জারিতে তাঁর ঝলসানো মুখ সেরে গেলেও হৃদয় ঝলসে যাবে। আগামীকাল পহেলা বৈশাখে আমার মায়ের সাথে লাইজুর বিয়ে নিয়ে কথা আছে। আমি যদি সোনিয়াকে কাছে টেনে নিই তবে লাইজুর হৃদয় ঝলসে যাবে। আমি কি সোনিয়ার পাশে থেকে তাঁর বাকি জীবন সংগ্রামের সাথী হবো? আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমাকে এক নিষ্ঠূর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
(আমি এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম সেইসব নারীদের উদ্দেশ্যে যাঁরা এসিড সন্ত্রাসের শিকার।)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০২৩ ভোর ৪:৫৬