১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বার পার হয়ে গেছে সেই কবেই। সফল একটি সংগ্রামের মাধ্যমে দুটি দেশের জন্ম হয়েছে এটাও পুরোনো কথা। তবে যেটা সব সময় নতুন থাকবে সেটা হল আমাদের হ্রদয়ের রক্ত ক্ষরন। পাকিস্তান একটি মুসলিম দেশ হিসাবে আমাদের ভাতৃপ্রতিম দেশ। আমরা তাদেরকে ভাইয়ের মত দেখতে চাই। কিন্তু সেই দরজাটা তাদেরই খুলে দিতে হবে। কারন দরজা তো আমরা বন্ধ করিনি। আমরা চাই পাকিস্তান আমাদের জন্য তাদের সবগুলো জানালা খুলে দিক। তাদের বিনয় দেখে যেন আমরা বুঝতে পারি ৭১ এর সামরিক বাহিণীর নৃশঙসতার দায় এই প্রজন্মের নয়। এরকমই একটি উদ্যোগ নিয়েছেন এক পাকিস্তানি।
"আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন এ বছরের ২৬ মার্চ। ওই দিন আমি ছিলাম নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচারের দেওয়া সার্ক আজীবন সম্মাননা পুরস্কার নেওয়ার জন্য সেখানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ওই সময় ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ নয়াদিল্লিতে তিন দিনের সার্ক সাহিত্য উৎসবেরও আয়োজন করেছিল। আর এতে অংশ নিতে এসেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর লেখক, সাংবাদিক ও শান্তিকর্মীরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। তাই ঘুম থেকে একটু সকাল সকালই উঠি। ই-মেইল দেখার জন্য যখন কম্পিউটারটি চালু করি তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা। আমার অ্যাকাউন্ট খুলতেই দেখি ই-মেইলের বন্যা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথম আলোর পাঠকেরা আমার লেখার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ই-মেইল করেছেন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত আমার একটি লেখার ব্যাপারে পাঠকদের এই অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া। ওই নিবন্ধে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম আমি এবং দাবি জানিয়েছিলাম, পাকিস্তান সরকারকে অবশ্যই বাংলাদেশের কাছে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। আমি নতুন কিছু বলিনি; কারণ, পাকিস্তানে আমি অনেক দিন থেকেই এ ধরনের কথা বলে আসছি। তবে স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশি ভাইবোনদের জন্য হয়তো বিষয়টি অপ্রত্যাশিত ছিল। আমি সব কটি ই-মেইলের জবাব দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সম্ভব হয়নি। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ই-মেইলের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। বেশির ভাগ বাংলাদেশি পত্রলেখক দুঃখ প্রকাশের জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান। অনেক ই-মেইল পড়ে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। পৌনে ১০টার দিকে কম্পিউটার বন্ধ করে আমি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাই।
অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি ও পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাওয়ের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা উপস্থিতই হননি। পরে জানতে পারি, সম্মেলনের স্মরণিকায় ছাপা একটি কবিতা নিয়ে তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কবিতাটি সম্মেলনের মূল আয়োজক অজিত কাউরের লেখা। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার পর দিল্লিতে শিখ সম্প্রদায়ের ওপর চালানো সহিংসতার বিরুদ্ধে ওই কবিতটি লেখেন তিনি। ভারত সরকারের শীর্ষস্থানীয় ওই দুই কর্মকর্তার এ ধরনের আচরণ আমাকে পাকিস্তানের কিছু লোকের নাম মনে করিয়ে দেয়; যারা এখনো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যার সত্যটি মানতে নারাজ। দিল্লি ও ইসলামাবাদ অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। কিন্তু তারা তা স্বীকার করতে রাজি নয়। যা হোক, ওই ‘ভিআইপি’দের অনুপস্থিতি কেউ অনুভব করেননি। কারণ, সার্ক দেশগুলোর লেখকদের কাছে ওই দুজনের চেয়েও অজিত কাউর বেশি জনপ্রিয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় সাড়ে ১০টায়। আমি আমার বক্তব্যের শুরুতেই ২৬ মার্চের তাৎপর্য তুলে ধরি এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। আমার এই বক্তব্যের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে হাততালি দেন দর্শক আসনে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কয়েক শ লেখক ও সাংবাদিক। ওই সময় বাংলাদেশের সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের চোখে পানি দেখতে পাই। অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন, সৈয়দ শামসুল হক ও অন্য বাংলাদেশি লেখকদের সঙ্গে মঞ্চের সামনে দ্বিতীয় সারিতে বসে ছিলেন তিনিও। তাঁর ওই চোখের পানি ছিল আনন্দের। কারণ, ২৬ মার্চ এক পাকিস্তানি ভাইয়ের সঙ্গে দিল্লিতে তাঁরা স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করেছেন।
পুরস্কার গ্রহণের পর মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে আমি আবার কম্পিউটারের সামনে ফিরে আসি এবং আবারও অবাক হই। তখনো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশিদের ই-মেইল আসছিল। শত শত বাংলাদেশির এ আবেগ উপেক্ষা করা আমার জন্য ছিল কঠিন। পাঁচ হাজার ডলারসহ আজীবন সম্মাননা পুরস্কারের চেয়ে এ প্রতিক্রিয়া আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরের ২৬ মার্চ আমার জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। কারণ, ২৩ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে আমার আর কোনো লেখার জন্য আমি এত প্রতিক্রিয়া পাইনি।
পরের দিন আমি পাকিস্তানে ফিরে আসি। সব ই-মেইল পড়তে আমার এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। আমার নিবন্ধটি পাকিস্তানেও প্রকাশিত হয়েছিল। কাউন্সিল অব পাকিস্তান নিউজপেপার এডিটরসের সভাপতি ও ডেইলি জিন্নাহ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক খুশনুদ আলি খান আমাকে ডেকে নেন এবং বলেন, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের দুঃখ প্রকাশ নিয়ে আমার ভাবনাকে সমর্থন করেন তিনি। জিয়ো টিভির প্রধান নির্বাহী মির ইব্রাহিম রেহমানও আমার ভাবনাকে সমর্থন করেছেন এবং এ ব্যাপারে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি পাকিস্তানের সরকার নই, একজন সাধারণ নাগরিক মাত্র। তবে বাংলাদেশের ভাইবোনদের আমি জানাতে চাই, পাকিস্তানে আমি একা নই। পাকিস্তানের একটি বড় অংশ দুঃখ প্রকাশ করতে চায়; কারণ, এদের বেশির ভাগই জানে না ১৯৭১ সালে আসলে কী ঘটেছিল। আর এর কারণও পরিষ্কার। ওই সময় পাকিস্তানে সেনাশাসন চলছিল।
ওই সময় পাকিস্তানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না। পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগও খুব সীমিত ছিল। কিন্তু আজকের পাকিস্তান ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের তুলনায় অনেক আলাদা। এখন আমার লেখা পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া থেকে জিয়াউদ্দিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তিনি জানাতে পারেন, তাঁর বাবা পাকিস্তান আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন, যিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর আসাম থেকে সিলেটে চলে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। ওই মুহূর্তে একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি কয়েকজন আহত ব্যক্তির চিকিৎসা করছিলেন। জিয়াউদ্দিন পাকিস্তানকে ঘৃণা করতেন। কিন্তু ২০০৫ সালে একটি ঘটনায় তাঁর ওই মনোভাব পাল্টে যায়। ওই সময় উত্তর আমেরিকায় পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওমর আতিক তাঁদের কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান জিয়াউদ্দিনকে। আতিকসহ আরও কয়েক শ পাকিস্তানি চিকিৎসক ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার জন্য বাংলাদেশি ভাইদের কাছে ক্ষমা চান। বাবার হত্যাকারীদের নাম এখনো মনে আছে জিয়াউদ্দিনের। ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী মেজর রিয়াজ ও কর্নেল সরফরাজকে আদালতের কাঠগড়ায় দেখতে চান তিনি।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ওমর হুদার কাছ থেকেও ই-মেইল পেয়েছি আমি। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন তরুণ ক্যাপ্টেন ছিলেন। ওই সময় তাঁকে লাহোরে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু ২৬ মার্চ ঢাকায় সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর ওই বদলির আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৭৪ সালে তিনি মুক্তি পান এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে একজন কর্নেল হিসেবে যোগ দেন। অবসর নেওয়ার পর এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে বাস করছেন। এখনো পাকিস্তানে তাঁর অনেক বন্ধু রয়েছে। বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাকিস্তানের সেনা অভিযান নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। তাঁর ধারণা, সম্ভবত ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমার মতোই আর কেউ এই অভিযানের প্রাণহানি নিয়ে লিখবে। কর্নেল হুদা আশা করেন, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আর নিজেদের জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরবে না। তাঁর এই চাওয়াকে সমর্থন করি আমি। সব ই-মেইল, সব নাম আমি এখানে লিখতে পারছি না। আবেগ আর চোখের পানি নিয়ে লিখেছেন অনেকে। এ আবেগে আমার চোখেও পানি এসেছে। আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশি বন্ধুদের আশ্বস্ত করতে চাই যে আমি এখন আর শুধু পত্রিকায় কলাম লিখে দায়িত্ব শেষ করব না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখব এবং দাবি জানাব, তাঁরা যেন অবশ্যই ১৯৭১-এর কৃতকর্মের জন্য বাংলাদেশের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। আর তাঁরা তা না করলে এই বিষয়ে আমি বই লিখব। এরপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করব, যাতে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, ১৯৭১ সালে তাদের পূর্ব সূরিরা কী ধরনের ভুল করেছিল। আমি নিশ্চিত, একদিন আমার কথা সত্যি হবে। কারণ, আমি সত্যের জন্য লড়ছি। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটা আমার প্রতিশ্রুতি। এটা এক পাকিস্তানির প্রতিশ্রুতি যে সব সময় সামরিক শাসকদের ঘৃণা করেছে, বাংলাদেশিদের মতোই। বাংলাদেশিরা আসলে দুটো দেশ সৃষ্টি করেছে। প্রথমে পাকিস্তান ও তারপর বাংলাদেশ। আপনারা সত্যিই অনন্য।"
সকালে উঠে সংবাদটি পড়ে মনটাই ভাল হয়ে গেল আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। মুল : প্রথম আলো
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৭:২৬