ভারতের মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এলেই সেই পুরানো গানটা মনে পড়ে যায় "নানা ভাষা নানা কথা নানা পরিধান, বিভেদের মাঝে দেখ মিলন মহান"। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি কপালে সাদা ভস্ম দিয়ে আড়াআড়ি তিলক কাটা এক দক্ষিন ভারতীয়, কিছুদুর গিয়ে দেখি শেরওয়ানী পরে কোনো এক উত্তর প্রদেশের মানুষ পান কিনে খাচ্ছেন। আবার দেখি মঙ্গলীয় ধাঁচের সরু চোখের কোনো মণিপুরী মহিলা জগন্নাথের রথযাত্রায় পথে হরে কৃষ্ণ বলে উদ্যম নাচ করছেন। কোনো কাশ্মিরী শালওয়ালা শাল বিক্রী করছেন। কিংবা হয়ত কোনো গুজরাতি মাসিমা অনেকদিন বাদে রাস্তায় দেখা তার প্রিয়জনকে গুজরাতি ভাষায় জিজ্ঞাসা করছেন "কেম ছো? মাজা মা?" (কেমন আছো? ভালো তো?)।
বেশ ভালই লাগে এই রকম মিশ্র সংস্কৃতি। সবাই তার নিজের নিজের ধারা বজায় রেখে চলেছে অথচ সব ধারা এসে মিলে মশে একাকার হয়ে গেছে। তখন মনে হয় শুধু পশ্চিমবঙ্গটা আমার নয়। আমার দেশ সারা ভারতবর্ষ। আর আমাদের মত একা থাকা লোকেদের তো পোয়াবারো। এক এক দিন এক এক প্রদেশের খাবার খাওয়া। এই ধরুন আজ মালায়ালী ফিস কারী আর রাইস খেলাম। কাল কন্নড় বিসি বেলে ভাত, পরশু বাঙালী আলু পোস্ত আর রুটি। আর উইক এন্ডে গেলাম কোনো পাঞ্জাবী হোটেলে ডাল মাখনি, শাহী পণির আর রুটি খেতে।
দিল্লীতে একটা স্হায়ী মেলা আছে। নাম দিল্লী হাট। ওখানে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ তাদের ক্ষুদ্রশিল্পের ভান্ডার নিয়ে আসেন ব্যাবসা করার জন্য। কী কী চান আগে থেকে ভাবতে হবে না। শুধু একবার ১০ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে পড়ুন, ব্যাস। আমি দুবার ওখানে গেছি। শেষেরবার গেছিলাম আমার মায়ের জন্য নাগাল্যান্ড রাজ্যের মানুষদের তৈরী বিখ্যাত লাল আর কালো উলের শাল কিনতে। ভেতরে ঢুকে দেখি দিল্লী হাট হলো মিনি ভারতবর্ষ।
কী কী আছে বলার থেকে কী কী নেই বলাই বোধহয় সোজা। তবে ওখানে কোনো বড় কোম্পানীর প্রবেশ নিষেধ। শুধুমাত্র শিল্পীরা নিজেদের জিনিস বিক্রী করতে পারেন। কাশ্মরী শাল, দক্ষিন ভারতের সিল্ক, তেলেঙ্গীদের আচার,আসামের সাদা গামছা, উডিষ্যার কটকী শাড়ী, কর্ণাটকের সুগন্ধী চন্দন কাঠ, আগ্রার তাজমহলের পাথরের তৈরী মিনিয়েচার, নাগা শাল, নানা প্রদেশের হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প, দারুশিল্প। সে একেবারে ফাটাফাটি অভিজ্ঞতা।
আবার সব প্রদেশের খাবারের স্টলও আছে ওখানে। আমি সেবার কাশ্মিরী বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়বার গিয়ে খেলাম নাগা খাবার। ভাত ডাল, শাক দেওয়া স্যুপ ও শুকরের মাংস। মাংস ছাড়া সবই তেল ছাড়া সেদ্ধ রান্না। এছাড়া আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের প্রিয় পানীয় "বিজলী গ্রীলসের আইসক্রীম সোডা" পেয়ে কোনোবার মিস করিনি। কেমন যেন আমার সোনার বাঙলার কথা মনে পড়ে গেছিল। নস্টালজিয়া। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কোথাও ওটা পাবো ভাবিনি।
দিল্লী ছেড়েছি আজ প্রায় চার বছর হল। কিন্তু দিল্লী হাটকে বড্ড মিস করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০০৮ দুপুর ১২:২৫