"এক্সপেক্টেশন" শব্দটার কোন যুৎসই বাংলা অনুবাদ করতে পারছি না। “"আশা”" বললে “"উইশ"” বোঝায়, তো "“চাওয়া"” বললে "“ওয়ন্ট"”। প্রত্যাশা বা প্রতীক্ষাকে মিলিয়ে দিলেও "এক্সপেক্টেশন" উঁকি দেয় খানিকটা। একটা সময়ের পর থেকে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকেই আমার ভেতর এক্সপেক্টেশন জন্মায়। অর্থ না জেনেও এক্সপেক্টেশন ব্যপারটা ঘুম থেকে আস্তে আস্তে আড়মোড়া ভাঙে ভেতরে। তার-ও পরে আমার কাছে” এর অর্থ ছিল কাছের ভবিষ্যৎ-এর নিজেকে নিয়ে একটা ছবি আঁকা আর ভবিষ্যৎটা বর্তমানে পা রাখলে তার সাথে ছবিটা মিলিয়ে দেখা যে কতটুক মিললো। যখন অর্থটা পুরোপুরি বুঝতে শিখে গেলাম তখন থেকেই চেষ্টা শুরু হলো কিভাবে অর্থটা বেমালুম ভুলে থাকা যায়।
প্রথম প্রথম না বুঝেই এক্সপেক্ট করা শুরু করেছিলাম। তখন আমার বয়স চার-পাঁচ। মা-বাবা দু'জন-ই ডাক্তার আর হঠাৎ একসাথে দু'জনের পোস্টিং-ই টাঙাইল হয়ে গেল। আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পুরোপুরি-ই ঢাকায়। বুবু(নানু)-দাদু সবার বাড়িই ঢাকা। আমি নানার বাসায় নানা-বুবু-খালাম্মিদের কাছে থাকতাম। প্রতি বৃহস্পতি সকাল-দুপুরে মা-বাবা ঢাকা আসতো আমাকে দেখতে, আবার শুক্র রাতে বা শনির ভোরে ওখানে ফিরে যেতো। শনি থেকে বুধ আমি বাবা-মার জন্য কাউন্টডাউন করতাম। ক্যালেন্ডারের বারগুলোয় নানা ক্রেয়ন-রঙের ক্রস থেকে শুরু করে ঘড়িতে এ্যলার্ম দেয়ার মতো বিচিত্র ধরনের কাউন্টডাউন চলতো মাঝের ঐ দিনগুলোয়। মাঝের এক বৃহস্পতিতে নিয়ম মেনে বাবা-মা আসলো না। ফোনে জানিয়ে দিল, হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে প্রচুর রোগী, কিছুতেই আসা যাবে না ঢাকায়। ক্যালেন্ডার নিয়ে বসলাম হিসেবে। হিসেব করে বের হলো প্রায় তেরো-চৌদ্দ দিন দেখা হবে না! মা-বাবা ফোনে বুঝিয়েছে ... অনেক বড় হয়ে গেছি, বুঝতে হবে কখন ইমার্জেন্সি হয়। ডাক্তারদের সবচে' বড় কাজ হচ্ছে মানুষের দরকারে থাকা।... কথা শুনে নিজেকে বুঝিয়ে সবাইকে দেখালাম আমি বুঝে গেছি। তারপর ছাদে গিয়ে কতক্ষণ কেঁদে মুখ ফুলিয়ে এসে সবাইকে বললাম পিঁপড়া কামড়ে দিয়েছে। তারপর আবার এ্যলার্ম পরের বৃহস্পতির জন্য ঠিক করে নতুন কাউন্টডাউন শুরু করলাম। সেই এক্সপেক্টেড বৃহস্পতির ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ঘড়ির কাঁচে নাক লাগিয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। একসময় এ্যলার্ম বাজতেই প্রায় উড়ে গিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম তীব্র প্রিয় মুখগুলো দেখা যায় কি না! তার-ও প্রায় মিনিট দশেক পর সিঁড়িতে বাবার কন্ঠ শুনে দৌড়ে পাঁচ তলার দরজার সামনে দাড়িয়েছি মা-র কোলে ঝাপিয়ে পড়বো ভেবে। মা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই আমার খালাম্মির প্রায় আমার সমান মেয়েটা সামনে দাড়িয়ে মাকে ভেতরে আসার জন্য বললো। মা এসেই ওকে কোলে নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে শুরু করলো। আমি হালকা পায়ে পেছন থেকে সরে গেলাম। মা'র কাছেও গেলাম না সারাদিন। বাবাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে শুরু করলাম কান্না। কিছুতেই কান্না থামাতে পারি না। মা কে তো কাছেও আসতে দেই না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তাও বলি না। কাঁদতে কাঁদতে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। রাতে বাবা বললো আমি না বললে বাবা খাবেও না, ঘুমাবেও না। আমার সাথে কাঁদবে। বেস্ট ফ্রেন্ড এর নানান ধরনের প্রতিজ্ঞা করিয়ে বাবাকে বলেছিলাম কিভাবে মা আমার এক্সপেক্টেশন ভেঙে ফেললো। সেবার বাবা-মা আমাকে প্রায় এক সপ্তাহের জন্য টাঙাইল ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল। আমার ক্যালেন্ডার, ক্রেয়নস বা এ্যলার্ম ক্লকটা একা একা পড়ে ছিল ঢাকায় সেসময়। কিন্তু আমি প্রায় সাত-আটদিন মা'র সাথে কথা বলি নি, কাছে যাই নি। কি এক অদ্ভুত কষ্ট ভেতরে গেঁথে বসেছিলাম! সেটা কি ছিল ? নিছক হিংসা ? না "এক্সপেক্টেশন" ভাঙার কষ্ট ?!
এরপর বড় হতে হতে এক্সপেক্টেশনের সাথে কখনো বন্ধুত্ব কি কখনো শত্রুতার একটা সখ্য হয়ে গিয়েছিল আমার। এস.এস.সি.-র রেজাল্টটা আমার এক্সপেক্টেশনের বাইরে ছিল। রেজাল্ট দেখে খুশিতে ভেউভেউ করে কেঁদে দিলাম। মা আসতে করে বললো আমাকে কাছে নিয়ে বললো, "ছিঃ! তুমি টিপিক্যাল ছিঁচকাদুনেদের মতো কান্না শুরু করে দিলা! দেখো তোমার দিকে রিপোর্টাররা আসছে, পুরাই আনস্মার্ট ভাববে কিন্তু তোমাকে!" আমার স্কুলের আপা-স্যার বা ফ্রেন্ডরা সবাই জড়িয়ে ধরছে, পাগল করে দেয়া ড্রাম বাজছে আকাশ কাঁপিয়ে... আর আমি প্রানপন ঠোঁটে ঠোঁট আটকে ফোঁপানো ঠেকাচ্ছি যাতে আমাকে "টিপিক্যাল ছিঁচকাদুনে" না ভাবে কেউ। একটু পর দেখলাম আমাকে একটু আগে বুঝ দিয়ে যাওয়া মা ফোনে আমার বাবাকে রেজাল্ট বলতে বলতে ফোঁপাচ্ছে!
এই দিনটার পর কেন যেন ধনাত্মক এক্সপেক্টেশনের একটা বাজে স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। সেজন্যই জীবনে পরপর ভয়ানক কিছু ধাক্কা খেলাম কলেজ থেকে ভার্সিটিগার্লে রূপান্তরের বছরগুলোতে। হয় আমার ভিকারুননিসার সেই ছোট্ট থেকে বড় হওয়া সবচে' কাছের বন্ধুটাই বিশাল একটা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলো, নাহলে হয়তো যাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম তার একটা বাস্তব রূপ জেনে ফেললাম। ধাক্কাগুলো আমাকে হঠাৎ করেই কঠোর বাস্তব কিছু শিক্ষা দিল। আমি মুখোশের ভেতরের সত্যিকার মানুষ চিনতে শিখে গিয়েছিলাম। আমি ক্লাস নাইন-টেনের বায়োলজির ভুল ধরে দেখেছিলাম সরীসৃপের মতো মানুষ-ও অনায়াসে রং বদলাতে পারে! আমি হঠাৎ করে এই দু'বছরে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলাম। আর সেসময় থেকে "এক্সপেক্টেশন" নামের অনর্থক জীবাণুটাকে কড়া এ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মেরে ফেলেছিলাম। অদ্ভুত একটা নিস্পৃহ জীবন শুরু করেছিলাম ভার্সিটির শুরু থেকেই। তাতে ভাল না থাকলেও কমপক্ষে এক্সপেক্টেশন ভাঙার রগছেঁড়া কষ্টটা পেতাম না।
২০০৮ এর শেষদিক থেকে আমার সময়টা খুব অদ্ভুতভাবে বদলে গেল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবার ভাল একটা সময়ের মোড়কে পেঁচিয়ে গেলাম। আমার আশে-পাশে খারাপ কোন কিছুর অস্তিত্ব-ই ছিল না। হয়তো অস্তিত্ব বোঝার মতো মানসিকতাই ছিল না আমার। একটা অপার্থিব মোহে অন্য একটা মায়াবী পৃথিবীতে থাকা শুরু করলাম। ভেতরের মৃত জীবাণুটা পুনর্জন্ম পেয়ে মাথা তুললো এ সময়টায়। অশিক্ষিত-অন্ধের মতো, নাকি মোহাবিষ্ট হয়েই আবারো এক্সপেক্ট করতে শিখলাম আমি। কিন্তু এবার আমি খুব খুব সাবধানী। আমি কখনোই বড় কিছু এক্সপেক্ট করি না। বেশ হিসাব করে, চিন্তা-ভাবনা করে এক্সপেক্টশনের নক্সা করি। যদি কেউ জেনে ফেলে তাহলে চোখ কুঁচকে তাকায় আমার দিকে... ভাবে! মেয়ের সমস্যা কি! এইটুক একটা ব্যপার নিয়ে ভেবে সেটাকে আবার "এক্সপেক্টশন" নাম দিচ্ছে!... আসলে এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই আমার কাছে বিশাল কিছু হয়ে যায়! এই "ছোট্ট" আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তব হলেই আমি স্বর্গীয় একটা আনন্দ পাই! কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আমার এই নিছক এক্সপেক্টশনগুলো-ও বেশিরভাগ সময়-ই আমার অপেক্ষা বা অনুভূতি নিয়ে বিদ্রুপ করে যায়। আমি কষ্ট পাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। এখন খুব অসহায় লাগে নিজেকে যখন কোন এক্সপেক্টশনের মুখোমুখি হয়ে যাই!
সেজন্য আজকে আর এ্যান্টিবায়োটিক না বরং নিজেকে কেটে-ছিঁড়ে বের করে আনবো সেই জঘন্য জীবাণুটাকে। এ্যান্টিডোট দিয়ে বিষিয়ে মারবো ওকে। ওর কালচে-নীল দেহটা নিথর করে দেবো। সবসময়ের জন্য।
ঝড়লিপি I
ঝড়লিপি II
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:০৫