দিনলিপির অর্থ যদি একদিনযাপনলিপি হয় তো এটা প্রায় নয়দিনলিপি। গত সাত থেকে আজকে ষোল। গত মাসের তেইশ থেকে এ মাসের সাত পর্যন্ত ভার্সিটির পুতুলনাচ টিমের অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি। নাচিয়ে-কুদিয়ে-কাঁদিয়ে ছেড়েছে আমাকে! সাত তারিখ সব শেষ করে বেশ ঈদ-ঈদ অবস্থা... পিসির সামনে প্রায় বিছানা করে ফেললাম ম্যরাথন থাকবো ভেবে! এই-সেই লেখা রেডি করে ফেললাম ব্লগের সবার মাথা ভাজার জন্য। ক্যামেরা নিয়ে পোকাদের পিছনে ঝাপিয়ে বেড়ানো শুরু করলাম। পিঁপড়া পেলে লাফ, তেলাপোকা পেলেও ঝাপ। আমার মা আমার আয়োজনে-লাফ-ঝাপে মোটামোটি শঙ্কিত-অতিষ্ট!
হঠাৎ রাত যুবতী না হতেই (২টা) দেখি কেমন যেন ম্যারম্যারা লাগে। পিসির আলো বাড়তে বাড়তে চোখের পানির পাইপ লিক করে ফেললো, স্পিকারের গীটার বা পিয়ানো দুটাই কানে গিয়ে ড্রামবিটস্ হয়ে গেল! পিসি বন্ধ করে ভাবলাম শেষ ক'দিনের ধকলের জন্য বোধ হয় ঘুম দরকার। আজকে বাদ দেই প্ল্যান, কালকে থেকে ম্যারাথন ফটোগ্রাফি-ব্লগিং-ফেইসবুকিং! উঠতে গিয়ে দেখি ঠিকমতো দাড়াতেও পারি না। "বুড়া হয়ে গেসি নাকি এতো তাড়াতাড়ি!" বিছানায় গিয়ে দেখি বিছানা দুলে-ঘুরে। আমার মনে হয় মাথা এবার পুরা গেছে। আগে আধা খারাপ ছিল, এখন পুরাই শেষ। নাকি ভূমিকম্প ?! এখন তো ঢাকাও কতক্ষণ ঝাকাঝাকি করে জাপানিজ ভাব নেয়। কিছুক্ষণ বসে থাকলাম কাহিনী বুঝতে। কিছুতেই কিছু হয় না। ঘর দুলছে তো দুলছেই! এর মধ্য হঠাৎ অফলাইন দেখে এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলে, দোস্ত কারেন্ট গেল ?... না, আচ্ছা দোস্ত শুন, তোর কি চারপাশ দুলতেসে? ...না তো! তোর দুলে? ... হুমম... শুন, তুই ঘুমা। রেস্ট দরকার, বেশি-ই পেইন দিসে তোকে ভার্সিটি এবার। হ্যাপি সেহ্রী!
সেহ্রীতে মা এসে দেখে আমি ঠকঠক করে কাঁপছি! মা প্রায় দৌড়ে এসে গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বর ১০৫ এর মার্জিন ছেড়ে যাচ্ছে। আমি তখন কি জানি একটা গানের লিরিক্স ঠিকমতো পারছি না দেখে বেশ চিন্তিত! মা খুব-ই অসহায়ের মতো বাবাকে ফোন দিল (আমার বাবার পোস্টিং ঢাকার বাইরে)। শরীর থেকে হীটারের মতো তাপ ছড়াচ্ছে। মা আর আমার পিচ্চি বোন বিস্ফোরিত চোখে তাকায় আমার দিকে, স্পন্জ করে, কোল্ড ব্যাগ দেয়, অষুধ খাই। কিছুতেই জ্বর যায় না। পিচ্চি শুরু করলো কান্না..."মা! দি মরে যাচ্ছে তো!"
সকাল প্রায় ৮টার দিকে জ্বর কমলো। ১০৪। আমার শীত যায় না কিছুতেই, কম্বল গায়ে শুয়ে আছি। ৯টা না বাজতেই আবার ১০৫+। বাসায় চাচ্চুরা এসে ফিসফাস করে দোয়া পড়া শুরু করলো। আমাকে কোন অষুধেই ধরে না। এদিকে আমি শুয়ে শুয়ে বহু কষ্টে মোবাইলে টিপাটিপি করেছি এতোক্ষণ, মাকে ডেকে বললাম, "মা শুনো, আমি মরে গেলে একটা গ্রুপ ক্রিয়েট করা আছে আর একটা ম্যসেজ সেইভ করা আছে। এই গ্রুপকে সিলেক্ট-ও করে রেখেছি। খালি কষ্ট করে সেইভড্ ম্যাসেজটা পাঠায় দিবা। দুই মিনিটের কাজ।" মা গজগজ করতে করতে বললো, "মরার আগে তো দেখি বিরাট কাজ করলি! সারাদিন শয়তানের বাক্সের সামনে টিপাটিপি। মরার আগে তার কাজ হলো ম্যাসেজ সেইভ করা! বেয়াদব মেয়ে!" আমি গালি খেয়ে বোনকে ডেকে ব্যপারটা বুঝিয়ে দিয়ে আবারো কম্বলের মধ্য ঢুকে গেলাম। বোন মা-র মতো প্র্যাকটিক্যল না। সে আমাকে জড়িয়ে ভেউভেউ করে শুরু করলো কান্না। আমি ওকে স্বান্তনা দিতে গিয়ে আরো কয়েকটা বেহুদা কথা বলতে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভয়াবহ ধমক খেলাম।
ঘটনা হলো, আট তারিখ সকাল থেকে রাতের মধ্য আমার জ্বর কমলে ১০৩ আর বাড়লে ১০৫+। ১০৩ হলেই আমার মনে হয় আমি ভাল হয়ে গেছি। উঠতে গিয়ে দেখি পারি না, হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পিসির সামনে আসতে পারলেও পিসি অন করলেই তীরের মতো আলো চোখে ঢুকে আমি প্রায় অন্ধ হয়ে যাই। বেশ কিছুক্ষণ চোখে কিছু দেখতেই পাই না। সারা শরীরে কারেন্ট শকের মতো চিনচিনে তীব্র ব্যাথা। হাত-পা থেকেও জোড়-বল বিট্রে করে বসে আছে। রাগে-জিদে কতক্ষণ কাঁদলাম। বাবা ফোন দিয়ে বলে, "আরে তুই তো বাঘের বাচ্চা! এটা ফালতু জ্বর। একটুও ভয় পাবি না। তিনদিন থাকবে। পাত্তাই দিবি না।" মা মাথার কাছে বসে অনেকক্ষণ খাওয়ানোর তদ্বির করে একটা হুংকার দিয়ে বললো, "তুমি কিন্তু ছোট নাই আর! তোমার যে ভাল হওয়াটা প্রয়োজন এটা বুঝবানা? কেন খাচ্ছোনা ?"... "কারন আমি বাঘের বাচ্চা!" মা হাল ছেড়ে দিয়ে বললো, "ভাল, তাহলে বাঘের বাচ্চার জন্য স্যলাইনের নিড্ল আনাচ্ছি।" ... "মা শুনো, তুমি এটা করবা না।" ... "অবশ্যই করবো, কারন আমি বাঘের বাচ্চার মা।" এবার আমি-ই হাল ছেড়ে দিলাম। রাত নাগাদ জ্বর কমে হলো ১০২।
নয় তারিখ। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার সাথে চরম জঘন্য ব্যবহার শুরু করলাম। মা ছুটি নিয়েছে ৩ দিন তাই হসপিটাল যায় নাই। তার জন্য মাকে কতোক্ষণ বকলাম। বোনকে কারন ছাড়াই বকলাম। জ্বর ডিসকো করেই যাচ্ছে ভেতরে। ১০২-১০৫+। বিকালে ব্লাড নিয়ে গেল টেস্টের জন্য, স্যলাইন লাগানো থাকলো। ব্লাড নেয়ার সিরিন্জটায় আমার কুচকুচে কালো রক্ত থরথর করছে। বামহাতে তাকিয়ে দেখি সবুজ শিরাগুলো ফুলে ফুলে ফোঁপাচ্ছে। ওরা ভয় পেয়ে গেছে হয়তো একটু। পাঁচটার দিকে জ্বর কমে হলো ১০২। আমি খুব খুশি। খুশির চোটে পিসিতে এসে ডানহাত দিয়েই প্রায় পাঁচ-সাত মিনিটে রোগমাখা শব্দজোট লিখে ফেললাম। লিখে শেষ না করতেই আমার চেয়ারটা থরথর করে কাঁপতে থাকলো। নিজেকে প্রায় ছেঁচড়ে নিয়ে বিছানায় ফেললাম। কিন্তু হঠাৎ-ই বুঝলাম আমি চোখে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। প্রথমবারের মতো আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। মা কে ডেকে বললাম, "মা আমার চোখের ভেইন শুকিয়ে গেছে কড়া এ্যান্টিবায়োটিকের জন্য। কিছু দেখা যায় না। তোমাকেও দেখতে পাই না। সত্যি! মা কি হবে এখন! মা মা মা..." মা বললো জ্বর বেড়েছে খুব এজন্য এমন হচ্ছে। কেন গেলাম পিসির সামনে...এই সেই। ১৫-২০ মিনিট পর আবার সব দেখতে পেয়ে আমার চিৎকার থামলো। কিন্তু সেই শীত আবারো পেঁচিয়ে-বেয়ে উঠলো পা থেকে উপরে একটু একটু করে। কম্বলের নিচে ঠকঠক করে কাঁপছি আর ভাবছি যে এবার তো মরেই যাবো। তারপর ভাবলাম, আচ্ছা আমি কেন এতো মানুষকে জড়ালাম আমার জীবনের সাথে! এরা তো কষ্ট পাবে আমি মরে গেলে। কেউ কেউ হয়তো জানতেই পারবে না যে আমি মরে গেছি! কী মোটাদাগের জীবন কাটাই আমি!
রাতের সাথে সাথে আমার জ্বর আর পাগলামী বাড়তে থাকে। ছায়ার মতো আমার সাথে মিশে থাকে মা আর ছোট্ট বোনটা। বোনটা কাঁদে আর আল্লাহ্-কে অতিষ্ট করে দেয়। আর মা শক্ত করে জড়িয়ে বসে থাকে। আমি মা-র অসাধারণ গন্ধে আমার মাথা ছিড়ে দেয়া ব্যাথাটা ভুলে যেতে চাই। আমার শরীর তপ্ত-হালকা হয়ে পতপত করে উড়তে থাকে আর মাথাটা ভার হয়ে বালিশে গেঁথে যায়।
এরমধ্যে বাবাও চলে আসে। ৩ দিন পাড় হয়ে যাওয়ার পর-ও জ্বর কেন কমছেনা সেটা নিয়ে আমার সবসময়ের আনসিরিয়াস বাবার কপালের ভাঁজেরা ঘন হয়ে আসে। রিপোর্টে সব নরমাল। না ডেঙ্গু, না টাইফয়েড... না শূয়োরে-ফ্লু! কিছুই ধরা দেয় না। তবে এবার জ্বর ১০৩ এর মার্জিন পাড় হয় না। আমি শোয়া থেকে উঠে বসি। বিষ নেমে যাচ্ছিল বোধ হয়। ১১-তে আমার জ্বর আসেই না। আমি ছোবলের জন্য অপেক্ষা করে থাকলেও, সাপ আমাকে ছেড়ে যায় শিরশির করে। তবে বসতে পারি না বেশিক্ষণ, দাড়ানোর কথা তো বাদ-ই দিলাম।
১১ সন্ধ্যা থেকে মা আর ১৪ রাতে বোন সেই সাপটার ছোবলে থরথর করতে থাকে। আমার নিজেকে এতোটা অপরাধী বোধহয় অন্য কখনো লাগে নি। সারা রাতদিন নিজেকে গালি দেই। ঠিকমতো ওদের যত্নটাও নিতে পারি না। আজকে থেকে মা আর বোন মোটামোটি সুস্থ। বাসাটা কেমন যেন ভাইরাসের গুদাম হয়ে গেছে। আমাদের কেউই এখনো শক্তি ফিরে পাই নি, এখনো আগের জীবনে ফিরি নি পুরোপুরি।
এখন অনেক ধরনের ফ্লু-র জীবানু খুব দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসের সাহায্যে। এখনকার যেকোনো ফ্লু-ই খুব ভয়াবহ। ভেতরটা দুমরে-মুচরে বিপর্যস্ত করে দেয় প্রথম তিনদিনে। কোনো অষুধেই কিচ্ছু হয় না। সেটা ভাল হয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে অন্তঃত দশদিন সময় নেয়। তাও শক্তি ফেরে না পুরোপুরি। মাথা ঘোরা, প্রচন্ড জয়েন্ট পেইন বা ভীষণ ঠান্ডা লেগে যায়।
এ কয়েকদিনে কিছু মানুষের ভালবাসা বা উদ্বিগ্ন কন্ঠ আমাকে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছে। তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে তাদের অসাধারণ ভালবাসাকে সাধারণ করে দেয়া উচিৎ হবে না। অসাধারণ মানুষগুলোর জন্য আমি আজকে সত্যি আবার বেঁচে আছি! মা, বাবা, বোনটুশ, কষ্টপোকা, ডিজিটাল বয়াতী (গোল্লা), ছন্নছাড়ার পেন্সিল, অরুনাভ ভাই, বৃত্তবন্দী কাক ভাই... আমি আমার এই ছায়াগুলোকে অনেক অনেক ভালবাসি!!!
প্রত্যেকে যতভাবে সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করুন। যারা যেকোনো জ্বর বা ফ্লুতে আক্রান্ত তারা হাঁচি-কাশির সময় রুমাল-টিস্যু ব্যবহার করুন। নিজের ভয়াবহ কষ্টটা ছড়িয়ে দেবেন না। আপনি নিজে ভাল না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকতে চেষ্টা করুন। হয়তো আপনার ছড়িয়ে দেয়া বিষ আপনার-ই প্রিয় কারো ভেতর ঢুকে যাবে বা হয়তো আপনার বাড়ি ফিরে আসবে। তীব্র সচেতনতা ছড়িয়ে দিন। তবে ভয় ছড়াবেন না। আক্রান্তদের সাহস দিন, মানসিক শক্তি বাড়িয়ে তুলুন। চলুন আমরা সবাই শক্ত মজবুত একটা দেয়াল দিয়ে আমাদের প্রিয়দের রক্ষা করি। আমরা প্রমান করে দেই যে আমরা আমাদের সামান্য সাধ্যেও অসাধ্য সাধন করতে পারি। সবার কাছে সচেতন হওয়ার ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার গভীর অনুরোধ থাকলো। সবাই ভাল থাকুন, পাশের মানুষটা যাতে ভাল থাকে সে ব্যবস্থা করে দিন।
ফ্লু-র ব্যপারে এখানে বিস্তারিত বলা আছে, যা থেকে আপনারা সাবধানতা অবলম্বন করতে পারবেন আর অহেতুক ভয় দূর করে সত্যিকার কারন আর প্রতিকার জানতে পারবেন। পোস্টটা বিবর্তনবাদী ভাইয়ের সৌজন্যে পাওয়া।
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ঝড়লিপি I
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:৩৫