গ্রীষ্মের মধ্যদুপুর ।
সারাদিনের গণগণে সূর্যের তাপটা এখন একটু থিতিয়ে পড়ছে । টিনশেড বাড়ীর ভেতরটা কিন্তু গরম খেয়ে বেশ ভালই তেতে উঠেছে ।
এই গরমের মধ্যেই শ্বাসের সাথে সাথে ঈষৎ স্থূল পেটের উঠানামা চলছে সানাউল্লার । সেইসাথে ওর পেটের উপর রাখা আসিয়ার হাতও । আসিয়া সানাউল্লার বিবাহিতা স্ত্রী । সানাউল্লাহর ঘর্মাক্ত পেটের ওপর থেকে হাত সরায় আসিয়া ,দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে ,খাবার তৈরী আছে অনেকক্ষণ । লোকটার বেঘোরে ঘুম দেখে মায়া হয় আসিয়ার । ডেকে তুলতে মন চায়না আসিয়ার । নিজেই উঠে বসে বিছানায় । গোসল সেরে তৈরি হয়ে নেবে । তারপর ডেকে তুলবে সানাউল্লাকে । দু’জনে মিলে টুকটাকা আলাপ করতে করতে ভাত খেয়ে নিবে এই বিছানায় বসেই । খাবে গরম ভাত,রুইমাছ,ডাল আর আলুভর্তা । সানাউল্লার পছন্দমতন রুইমাছ ভাজা ভাজা করে ভূনা রান্না করা হয়েছে,আর অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে আলুভর্তা ।
হঠাৎ তীক্ষ্ম একটা যান্ত্রিক শব্দ । সানাউল্লার মোবাইল ফোন বাজছে ।
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে সদ্য ঘুম থেকে জাগা সানাউল্লা । মোবাইল টা রিসিভ করে কানে লাগায় , একবার আসিয়াকে দেখে । কথা বলা শেষ করে আবার কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে সানাউল্লা । আসিয়া চলে যায় গোসলে । মনে মনে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে সানাউল্লা, চাকরি দিয়ে কি ওকে কিনে নিয়েছে নাকি ? আর এই বেগম সাহেব মানে ম্যাডাম হচ্ছে একটা বদমায়েশ, বজ্জাতের হাড্ডি । আগের ম্যাডামও খারাপ ছিল,কিন্তু এবারের মতন এত দজ্জাল, বজ্জাত তো ছিল না । প্রায় সপ্তাহ তিনেক পরে গোটা একটা দিন পাওয়া গেল ছুটি হিসেবে কাটানোর জন্য ।
চোখ মুখ কুঁচকে হাঁটুর উপর হাত রেখে বসে থাকে সানাউল্লা । যাবো না আমি, দেখি কী করে? আবার,নিজেকে বুঝায় না গেলে এ চাকরী থাকবে না? একটা চাকরী পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা ?
কিন্তু কিছুতেই বোধ মানছে না সানাউল্লার মন । ভেবে রেখেছিল দুপুরে ভালমন্দ খেয়ে, বিকেলে আসিয়াকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, বউটাকে নিয়ে অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না । সারাদিন-রাত পরের পরিবার, বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে এদিক সেদিক করে সে । চোখ গেল খাটের কোণায় । গত ঈদের শাড়িটা ভাঁজ করে রেখেছে আসিয়া । নাহ,যাবে না,আজকে- মতস্থির করে ফেলে সানাউল্লা, ঐ বেটি যখন তখন এভাবে হুকুম করবে, তা মেনে নিয়ে বসে থাকবে সানাউল্লা? হাইকোর্ট দেখিয়ে দেবে ওই বেটিকে ...
ঠিক এই মুহুর্তে আবার ফোন শব্দ করে বেজে উঠল । ম্যাডাম ।
কন্ঠস্বর যথাসম্ভব নরম করে বলে সানাউল্লা
– জ্বি,ম্যাডাম, আমি এক্ষুণি বের হচ্ছি, দুপুরেরে খানাটা খাইয়া নিয়াই ।
-কি ম্যাডাম? বেশি জরুরি? আইচ্ছা ম্যাডাম । আমি এক্ষুণি আইতেছি ।
তারপর গোসল সেরে আসা আসিয়ার হতভম্ব দৃষ্টির সামনে দিয়ে একটা সাদা শার্ট গায়ে চড়িয়ে দুদ্দাড় ক দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সানাউল্লা,বেরিয়েই আবার ফেরত আসে, মোবাইল টা ফেলে গেছিল । আবার, আসিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়ে বলে না । এবার,একেবারে বের হয়ে যায় সানাউল্লা।
ঘরের মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আসিয়া । চুল বেয়ে পানি পড়ছে টপটপ । চোখের কোণেও হালকা দুয়েক ফোটা ।
গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয় সস্তার একটা সিগারেট টানতে টানতে গাড়ির হেডলাইট বরাবর হালকা একটা লাথি কষায় সানাউল্লা । কোনো একদিন পুরোটা ভেঙ্গে ফেলবে, সুযোগমত । পেটের ভিতরটা খিদেয় মোচড় দিয়ে ওঠে । আহ, রুইমাছ আর আলুভর্তা !
থুঃ করে নিকোটিনের গন্ধ মেশানো একদলা থুতু ছোঁড়ে । গিয়ে পড়ে গাড়ীর সামনের গ্লাসে । পরক্ষণেই সাথের গামছা দিয়ে মুছে দেয় । চাকরি চলে গেলে খাবি কী বোকা?বউকে খাওয়াবি কী-নিজেকেই শাসন করে। এভাবে না,অন্যভাবে ঘায়েল করা লাগবে বজ্জাতিদের... হঠাৎ বিরক্ত মুখে সিঁড়ি দিয়ে তাকায় । কেউ তো নামছে না এখনো ... “আমাকে দুপুরের খাওন খাইতে না দিয়া,তেনারা নটাঙ্কি করতেছে ...”-অশ্রাব্য একটা গালি দিয়ে মেজাজ টা হালকা করে সানাউল্লা ।
চাকরীর শুরুতে হিসাবটা ছিল এমন । সাহেবকে দিনে দুইবার অফিসে নিয়ে আসা-যাওয়া,আর বাচ্চাদের একবার নিয়ে আসা। অথচ দিনে দিনে সেখানে যোগ হতে থাকে তালিকা । বেগম সাহেব প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও যায় । তারউপর, সকাল-বিকাল-রাত কত ধরণের তলব তো আছেই ... রেগেমেগে এবার বেশ জোরেই একটা লাথি চালায় , টায়ারে ।
আধঘন্টার উপর গাড়ি চালিয়েছে সানাউল্লা । গন্তব্য সাহেবের দূরসম্পর্কের আত্নীয়ের বাড়ি , শহর থেকে যেতে সময় লাগবে । জ্যাম থাকলে তো দিন শেষ । আসিয়াটা কী করছে কে জানে?
থিতিয়ে পড়া মেজাজ আবার একটু একটু করে চড়তে শুরু করে । সাহেবের ছেলেটা,ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে-আঙ্কেল এটা কী,আঙ্কেল ওটা কী... বকবক করেই যাচ্ছে । বেটা তুই কী বড় হয়ে গাড়ি চালাবি?চুপ থাক... মনে মনে বললেও মুখে হাসি রেখেই কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছে সানাউল্লা ।
মেইনরোডে উঠে পড়েছে গাড়ি । যান চলাচল স্বাভাবিক । জ্যাম নেই । মৃদু বাতাস । এই বাতাসেই কিনা ,ম্যাডামের মনে হঠাৎ যেন ফূর্তি হল, সানাউল্লাকে বলা হল ,একটা রেস্টুরেন্ট এর সামনে কিছুক্ষণ পর যেন পারলে থামায় । বাচ্চারাও খুশিতে হইহই করে ওঠে । সময় দেখে সানাউল্লা । তিনটার মত প্রায় বাজে ঘড়িতে । দিন গড়াতে আরো প্রায় চার ঘন্টা । হিসেব টা কষে মনে মনে ।
মিনিট দশেক পর । গিয়ার টা একেবারে শার্পলি চেইঞ্জ করে ,এতদিন গাড়ি চালিয়ে গাড়ির মেজাজ-মর্জি ভালই জানা আছে সানাউল্লার । ঘড় ঘড় করে, কিছুক্ষণ পর থেমে যায় গাড়ি । ব্যতিব্যস্ত হয়ে নেমে আসে সানাউল্লা । নিছক একটু এদিক সেদিক ঘাঁটাঘাঁটি করে জানিয়ে দেয়- গাড়ি যাবে না, মেরামত করা লাগবে । ম্যাডাম স্বভাব মোতাবেক একটু ঝাড়ি লাগায় সানাউল্লাকে । সেগুলো হজম করেই সানাউল্লা জানায়, এখন গ্যারেজে নেয়া ছাড়া উপায় নেই । কোনমতে চালিয়ে,ঠেলে ধাক্কা দিয়ে গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া যাবে, ততক্ষণ ম্যাডাম আর বাচ্চারা সামনের কোনো রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করতে পারে । বলাবাহুল্য, ম্যাডামের আর করার কিছুই থাকে না, গাড়ি সারানোর জন্য সানাউল্লাকে পাঁচহাজারের মত টাকা দিয়ে রেস্টুরেন্টেই আশ্রয় নেয় ।
******
“এই গাড়ি তুমি চালাও? কি সুন্দর”
“আরে আরে, কর কি ? কর কি? আরাম কইরা বস, এইডা এখন তোমার আর আমার গাড়ি, সারা বিকাল বেলা আমি আর তুমি মিলা ঘুরমু...”-বলে বউয়ের দিকে চেয়ে চোখ টিপ মারে সানাউল্লা ।
আসিয়া হাসে, কি যেন ভাবে । -“সাহেব জানতে পারে যদি?”
“ হেদেরকে হাইকোর্ট দেখাইয়া দিছি আইজকা"-হর্ণ মেরে গাড়ি চালিয়ে যায় সানাউল্লা ।
(সমাপ্ত )