বনফুলের এই গল্পটি যতবার পড়ি মজা পাই ।এখানে নিদারুণ হাস্যরসের পাশাপাশি স্বামি-স্ত্রীকে এক করুণ বাস্তবের মুখোমুখি এনে দিয়েছেন,সেটা বেশ মর্মান্তিক। গল্পের নাম "অদ্বিতীয়া"
===============
বেশ ছিলাম ।
আপিসে সাহেব এবং গৃহে মা-ষষ্ঠী আমার প্রতি সদয় ছিলেন । সাহেব আমার মাহিনা এবং মা-ষষ্ঠী আমার সংসার বাড়াইতেছিলেন । আমার পিতৃমাতৃকুলে আর কেহ ছিল না । উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু টাকাও জুটিয়ে গিয়াছিল । খাসা ছিলাম ।
প্রভাবতী অর্থাৎ আমার গৃহিণী গড়ে বছরে দেড়টি করিয়া সন্তান প্রসব করিয়া চারি বৎসরেই ছয়টি পুত্রকন্যার মালিক করিয়া তুলিয়াছিলেন- মাঝে দুইবার যমজ হয় ।
এবম্বিধ প্রজাবৃদ্ধি সত্ত্বেও কোন অভাব ছিল না । হঠাৎ কিন্তু বেকুব বনিয়া গেলাম ।
পঞ্চম বর্ষেও গৃহিণী তার স্বাভাবিক গর্ভভার বহন করিতেছিলেন । এবার কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক হইলেও সহজ ছিল না বোঝা গেল । কারণ তিনি মারাই গেলেন । তিনি তাঁহার পিত্রালয় শান্তিপুরে ছিলেন । যদিও আমার শ্বশুর ও শ্বাশুড়ী উভয়েই অনেককাল স্বর্গীয় হইয়াছেন,কিন্তু আমার শ্যালক বিনোদ ডাক্তার বলিয়া প্রভা প্রতিবারই সেখানে যাইত । বিনোদ লিখিতেছে – “হঠাৎ ‘এক্লেস্পসিয়া’ হইয়া দিদি তিন চার ঘন্টার মধ্যে মারা গেলেন । আপনাকে খবর দেয়ার সময় ছিল না । ‘কিডনি’ খারাপ ছিল । সেজদি ছেলেদের লইয়া সম্বলপুরে চলিয়া গিয়াছেন। তাঁহার চিঠি বোধহয় পাইয়াছেন”
পাইলাম তো । তিনি লিখিতেছেন –“কি করিবে বল ভাই । সবই অদৃষ্ট । তোমার ছেলেমেয়েরা এখন আমার কাছে কিছুদিন থাকুক । আমি তো বাঁজা মানুষ । আমার কোন অসুবিধা হইবে না । ছেলেরা ভালই আছে । কোন ভাবনা করিও না। ইতি... ”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া ছুটির দরখাস্ত করিলাম। কপালগুণে আমার সাহেবও বদলী হইয়া গিয়াছিলেন । ছুটি সুতরাং মঞ্জুর হইল না ।
দুইমাস পরে ।
সম্বলপুরবাসী শ্যালিকার আর একখানি পত্র পাইলাম । তিনি অন্যান্য নানা কথার পর লিখিতেছেন –
“প্রভা সতীলক্ষ্মী ভাগ্যবতী ছিল । সে গেছে,বেশ গেছে । জাজ্বল্যমান স্বামী ছেলেপুলে সব রেখে গেছে । কিন্তু তোমার তো তা বলে সংসারটা ছারখার করাটা ভাল দেখায় না । উচিতও নয় । আমার কথা শোনো । আবার বিয়ে কর তুমি ... এখানে একটি বেশ ডাগর-ডোগর মেয়ে আছে । যদি তোমার ইচ্ছে হয় বল- সম্বন্ধ করি।আমার তো মেয়েটাকে বেশ পছন্দ। তোমার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে”
সাতদিন ভাবিয়া –অর্থাৎ এক টিন চা ও এক টিন সিগারেট নিঃশেষ করিয়া আমি এই চিরন্তন সমস্যার যে মীমাংসা করিলাম তাহা মোটেই অসাধারণ নয় ।সেজদিকে যে পত্র দিলাম তাহা অংশত এইরূপ-
“বিয়ে করতে আর ইচ্ছে হয়না। প্রভার কথা সর্বদাই মনে পড়ে । কিন্তু দেখ সেজদি, আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের উপর নির্ভর করে তো সংসার বসে নেই । সে আপনার চালে ঠিক চলছে এবং চলবে । সুতরাং ভাবপ্রবণ হওয়াটা শোভন হলেও সুযুক্তিকর নয় – এটা ঠিকই । তাছাড়া দেখ আমরা “মা ফলেষু কদাচন” দেশের লোক । আর তোমরাও যখন বলছ – তখন আর একবার সংসারটা বজায় রাখবার চেষ্টা করাই উচিত হবে বোধহয় । দ্বিতীয় পক্ষের বিয়েতে আবার পছন্দ-অপছন্দ! তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”
ক্রমশ বিবাহের দিন ধার্য হইল । সম্বলপুরেই বিবাহ । সেজদি বুদ্ধিমতী । লিখিয়াছেন- “ছেলেদের লাহোরে বড়দির কাছে পাঠিয়ে দিলাম । বাপের বিয়ে দেখতে নেই”। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম ।
যথাকালে সাহেবের হাতেপায়ে ধরিয়া হপ্তাখানেকের ছুটি লইয়া সোজা রওনা হইয়া পড়িলাম। একাই । এ বিয়ের কথা কাউকে বলিতে আছে? কি ভাবিয়া গোঁফটা কামাইয়া ফেলিলাম । একে এই কালো মোটা চেহারা –তাহার উপর কাঁচাপাকা একঝুড়ি গোঁফ বিবাহ করিতে যাইতে নিজেরই কেমন বাধ-বাধ ঠেকিতে লাগিল ।
বিবাহ বাসর । এই অবগুন্ঠিতা চেলি-পরা মেয়েটিই আবার আমার সঙ্গিনী হইতে চলিয়াছে ।
প্রভাকেও একদিন এইভাবেই পাইয়াছিলাম – সে কোথায় চলিয়া গেল। আজ আবার আর একজন আসিয়াছে । ইহার ‘কিডনি ’ কেমন কে জানে? নানারূপ এলোমেলো কথা মনে আসিতে লাগিল । প্রভার মুখ বারবার মনে পড়ে । ছেলেগুলো না জানি এখন কি করিতেছে ? ... মৃত্যুর পরও আত্মা কি সত্যি থাকে?... এমেয়েটি বেশ বড়সড় দেখিতেছি- কিন্তু ভারি জড়সড় হইয়া আছে- একেবারে মাথা নীচু করিয়া। আচ্ছা ,প্রভার আত্মা যদি... গৃহ্নামি,গৃহ্নামি
যন্ত্রচালিতবৎ বিবাহঅনুষ্ঠান চলিতে লাগিল । শুভদৃষ্টির সময় মেয়েটি কিছুতেই ঘোমটা খুলিল না। সেজদি বলিলেন- ভারি লাজুক । বাসরঘরেও শুনিলাম- ভারি লাজুক । আপাদমস্থক মুড়িয়া পাশ ফিরিয়া শুইল । আমিও ঘুমাইলাম । সেজদি লোক জমিতে দেন নাই । তাছাড়া দ্বিতীয় পক্ষের বিবাহ ,কে আর আমোদ করিতে চায় । মেয়েটির আপন বলিতে কেহ ছিল না । পরের বাড়িতে মানুষ । সেজদির বাড়িতেই বিবাহ – বলিতে গেলে সেজদিই কন্যাকর্তা । সুতরাং বিবাহউৎসব জমে নাই ।
জমিল ফুলশয্যার রাত্রে ।
বক্ষে অনেক আশা ও আশঙ্কা লইয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখি আমার ছয় সন্তান ও আর এক নবজাত শিশু লইয়া স্বয়ং প্রভা খাটে বসিয়া । স্বপ্ন দেখিতেছি নাকি?
প্রভা কহিল – “ছি ছি,সেজদিরই জিত হইল”
“মানে আবার কি! এবার ছেলে হওয়ার সময় ভারি কষ্ট হয়েছিল । অপরাধের মধ্যে সেজদিকে বলেছিলাম আমি ম’লে ওঁর ভারি কষ্ট হবে । সেজদি বললে ‘হাতী হবে’। তিনমাস যেতে না যেতে ফের বিয়ে করবে ।আমি বললাম ‘কক্ষণো নয় ’ তারপর বাজি রেখে সেজদি আর বিনোদ মিলে এই ষড়যন্ত্র! আমি শান্তিপুরেই ছিলাম । আজ এই সন্ধ্যেবেলা এসেছি । এসে দেখি সেজদিরই জিত । পাড়ার মানকে ছোড়াকে কনে সাজিয়ে সেজদি বাজি জিতেছে । একশটি টাকা দাও এখন । ছি ছি –কেমন তোমরা! অমন গোঁফটা কি ব’লে কামালে?”
আমার অবস্থা অবর্ণনীয় ।
পরদিন প্রভাতে সেজদির পাওনা চুকাইয়া দিয়াছি । এখন গোঁফটা উঠিলে বাঁচি ।