বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসতে আর খুব বেশি বাকি নেই । বড়জোর আর আধঘন্টার মত আছে হয়ত । ছোটছেলে রাহুল এখনো ঘুমাচ্ছে ;খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে সেই তিনটায় । ওকে এখন আর উঠিয়ে কাজ নেই । ঘ্যানঘ্যান করবে । বড়ছেলে পড়তে গেছে স্যারের কাছে । সাতটার দিকে ফিরবে ।
বসে বসে টিভি তে সিরিয়াল দেখছিল রোকেয়া।হুট করে ইলেকট্রিসিটিটা চলে গেল।
একটা পাত্রে কিছু চাল আর একটা ছোট প্লাস্টিকের কৌটো হাতে করে নিয়ে বারান্দায় চলে আসল রোকেয়া । তার এক অভ্যাস বা বদভ্যাস- কাজ ছাড়া, কোনো কিছু করা ছাড়া এক মুহুর্ত বসে থাকতে হাঁসফাস লাগে । হোক সেটা রান্না করা, টুকটাক কাজ, বা টিভি দেখা কিংবা পত্রিকা-ম্যাগাজিন পড়া । কিছু একটা করা লাগবেই ।
এজন্যে, বারান্দায় আসবার সময় সাথে করে জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে । বসে বসে চালগুলো বেছে ফেলা যাবে ।
একটা প্লাস্টিকের মোড়া সবসময় বারান্দায় থাকে ।
চালভরা পাত্রটি কোলের উপর নিয়ে মোড়ায় বসে পড়ল । এজায়গা থেকে সামনের পথচলা রাস্তাটি চোখে পড়ে । পথচলা বলতে রাস্তাটির প্রস্থ এমনই যে, দুইজন মানুষ পাশাপাশি কোনমতে চলতে পারে । বড়গাড়িগুলোকে আরেকটু আগেই থামত হয় । এদিকটাতে হেঁটে আসা-যাওয়া করা লাগে সবার ।ওর স্বামির কথা আলদা । অফিসে যায় আসে নিজের মোটরবাইকে করেই ।
চালগুলো আঙ্গুল দিয়ে ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিতে দিতে সামনে চোখ রাখল রোকেয়া । ঐ বাড়ির মেয়েটি । খুব সেয়ানা হয়েছে । বয়স কত আর হবে? বড়জোর ক্লাশ এইট কী নাইনের পড়ে হয়ত। দেখতে শুনতে একটু বড়সড় হয়ে গিয়েছে ।
এইসময়েই কেন মেয়েটা ছাদে উঠে আসে,হাঁটে –এগুলো রোকেয়ার অজানা নয় । শুরুতে অনুমানই ছিল । কিন্তু দিনে দিনে পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছে রোকেয়া – সে যা ভেবেছিল তাই ঠিক । ওদের দুজনের মাঝে কিছু আছে ।
ছেলেটাও এই সময়ে ছাদে আসে । দুটো বাড়ি কিন্তু আলাদা । তবে গায়ে গা লাগালাগি । এখনকার বাড়িগুলো যেভাবে উঠে আর কি । তফাত থাকে না ।
ছেলেটা হাঁটে ।মেয়েটাও । একটু একটু দাঁড়ায় । কথা বলেনা। কখনো বলতে দেখেনি ।
তবু এখানে বসেই,এই বারান্দা থেকেও যেন রোকেয়া ঐ দুটি মনের ভিতরকার সব না বলা কথা যেন টের পায়।
চাল বাছতে থাকে রোকেয়া । আজকে ছেলেটা এখনো আসেনি। দেখল রোকেয়া । মেয়েটা রেলিং এ ভর দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ।
এই দিনের বেলাতেও মশা উৎপাত শুরু করেছে খুব । হাতের উপরে বসা একটা মশাকে ঠাস করে মারল রোকেয়া । চালবাছা অর্ধেক প্রায় শেষ ।
একি!মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না । চলে গেল নাকি ?
চালের ময়লাগুলো একপাশে করে কৌটোয় নিল।চালভর্তি পাত্র সাবধানে নীচের মেঝেতে রেখে বসল রোকেয়া। গলার ভাজের ঘাম ওড়না দিয়ে মুছে ফেলল ।
ইলেকট্রিসিটি আসলে বোঝা যেত ।আসেনি মনে হচ্ছে এখনো ।
পশ্চিমমুখী বারান্দা । তেজহীন রোদ ঠিকরে পড়ছে উঁচু-নীচু বাড়িগুলোর জানালার গ্লাসে । সেই আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে চারপাশে ।
শব্দ কানে আসতে চোখ গেল । দরজা খুলছে পাশের বাড়ির ছাদের ।
আসলে,তো এত দেরি করলে কেন?
ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ।
আর দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই বাছা । ও চলে গেছে । আসবেই যখন আরো আগে আসলেই পারতে,তাহলেই না দেখা হত? আর মেয়েটাও?এত অস্থির কেন?আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ালে কি ক্ষতি হত তার?
মাগরিবের আযান পড়ে গেল । কানে আসতেই মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিল রোকেয়া । তারপর,মোড়া থেকে উঠে অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে ভেতরে চলে গেল । ইলেকট্রিসিটি এসে গেছে ।
#########
দুপুর থেকেই মনটা ভার হয়ে আছে রোকেয়ার । মন ভারের কারণ আছে । কথাটা ওর স্বামি মাহমুদ কে দুপুরে খেতে বসে বলবে ভেবে রেখেছিল রোকেয়া ।
জুমার দিন। অফিস ছুটি ।ভাল রান্না হয়েছিল বাসায় । সবার জন্য পোলাও, মুরগির কোর্মা রেঁধেছিল । বাচ্চারা খুব পছন্দ করে খেয়েছে । রাহুলতো একেবারেই নিজহাতে খেতে চায় না । কিন্তু আজকে নিজে নিয়ে বসে বসে খেয়েছে । রাতুলও রান্নার প্রশংসা করেছে। মাহমুদও ।এই ফাঁকে আস্তে করে কথাটা পেড়ে বসেছিল রোকেয়া।
তার মা সপ্তাহখানেকের জন্য মেয়ের বাসায় এসে থেকে যেতে চায় । বিধবা মহিলা ডাক্তার দেখাবেন । ঢাকায় রোকেয়াই আছে শুধু । তার বড়ভাইয়ের ফ্যামিলি থাকে সিলেটে। সেখানে যাবার ঝক্কি আছে অনেক ।
আর তাছাড়া বড়ভাবির সাথে ভাল বনে না উনার।শখ করে রোকেয়াকে সেদিন বলেছিল মা- তোদেরকে অনেক দিন দেখি না।মায়ের কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়েই রোকেয়া বলেছিল,একদম অসুবিধা নেই । তুমি যতদিন ইচ্ছা থাকবে মা,রাহুল-রাতুলও তোমাকে পেয়ে খুশি হবে । কথাটা আজকে দুপুরে খেতে খেতে মাহমুদের কানে তুলেছিল রোকেয়া ।
-জানো,মা আসতে চাচ্ছে,কয়টা দিন থাকবে আমাদের এখানে।
কথাটা কানে গেল কি গেল না,কেবল রোকেয়ার দিকে একপলক চাইল মাহমুদ ।
-দেখি,মুরগির বাটী টা এদিকে দাও।
তারপর খেয়াল করল রোকেয়া ।
কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল –কিছু বলছ না যে!
-আচ্ছা –এই বলে মাহমুদ রাহুলের মাংস লাগবে কিনা সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ুল ।
তার মানে রোকেয়াকে টোটালি ইগনর করে গেল মাহমুদ । মাহমুদের এঅভ্যাসে আগে থেকেই অভ্যস্ত,তাই আর কথা বাড়ালো না। নতুন প্রোমশান হয়েছে,তাই ভেবেছিল সবমিলিয়ে এখন এই কথা শুনে মনে মনে খুশি না হোক,অন্তুত বেজার হবে না। অথচ ,তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল ।
-আম্মু,নানু কখন আসবে?
রাতুলের প্রশ্নের কী জবাব দেবে রোকেয়া ? একজনের গম্ভীর অস্তিত্বের সামনে বসে খোলামনে ছোটছেলের সামান্য প্রশ্নের জবাব টা দিতেও অস্বস্তিতে ভুগে রোকেয়া ।
(অসমাপ্ত)