ক্লাস ব্রেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সবাই মিলে।সবাই বলতে অধিকাংশ ছাত্ররাই।সবার সাথে পরিচয় হয়নি।হচ্ছে ধীরে ধীরে।ছাত্রও তো কম নয়।নতুন নতুন ক্লাশ।হাইস্কুলে উঠে গেছি।অনেক ভাবনা,ভাললাগা,এত বড় স্কুলে ভর্তি হওয়া,সেই নিয়ে সামান্য ভীতি!তো যা বলছিলাম,দাঁড়িয়ে ছিলাম।পরের ক্লাশের আগে পাঁচ মিনিট বাকি।
হঠাৎ, কেউ কিছু বুঝার আগেই সপাং সপাং সপাং।
হই হই পড়ে গেল।ছাত্ররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।আতংক সবার চোখে মুখে।
বেতের বাড়ি থেকে কেউ রেহাই পেয়েছি কিনা জানিনা। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করবার আগেই সবাই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করে বসে পড়ল ক্লাশরুমে গিয়ে।
‘তোমাদের এই ক্লাস আমি নেব’-তারপর নাম,পরিচয় এবং হুমকি।ক্লাশে কেউ এদিক সেদিক করলে খবর আছে। এই হচ্ছে ইন্ট্রডাকশানের নমুনা।
ক্লাশে সবার বুদ্ধিমত্তা একমাত্রায় থাকেনা।এই পরিস্থিতির পরেও একজন টেবিলে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছিল।স্যার উঠে এসে ঐ ছেলের সামনে দাঁড়ালেন।চশমা ছিল।চশমা খুলে নিলেন ছেলেটির।তারপর এয়সা একটা চড়,চড়ের চোটে ছেলের অবস্থা কেমন জানিনা।ঝালমুড়ি বাতাসে উড়তে লাগল।
এরপর আর কিছু বলে দেয়া লাগেনা।আমরা সতর্ক হয়ে গেলাম।কোনদিন কোন পিরিয়ডে এই স্যারের ক্লাশ আছে বের করে ফেললাম।তবুও দুয়েকজন মার খেত।
শারীরিক শাস্তির সাথে সাথে কথার শাস্তিও ছিল।যেমন ধরা যাক,ছেলেটির নাম মোর্শেদ।বাড়ির কাজ তৈরি করেনি।
স্যার বলতেন-‘চলে আস’-মানে,বেঞ্চ থেকে উঠে স্যারের ডায়াসের সামনে যেতে আহবান।
মোর্শেদ ভয়ে ভয়ে গেল।
‘নাম কি?’
‘স্যার...’ (আতঙ্কে মানুষ নাম ভুলে যায়)
‘নাম কি!!!!!’
‘মোর্শেদ স্যার’ (এইবার ধমকের চোটে মনে পড়ে)
জিজ্ঞাসাবাদ চলছে মোর্শেদের,কিন্তু গোটা ক্লাসে আত্নারাম খাঁচাছাড়া।পিনপতন নিস্তব্ধততা।
‘মা কয়জন?’
‘হ্যাঁ?স্যার?’
‘বাপ কয়জন?’-জিজ্ঞাসা করতে করতে ডায়াস ছেড়ে উঠে এসে মোর্শেদের কান ধরে সপাং সপাং সপাং।বেত।
আমরা আতঙ্কে থাকতাম কখন স্যারের ‘চলে আস’ শুনতে হয়।‘চলে আস’ শব্দটা একটা ভীষণ ভীতিপ্রদ হয়ে গেল সবার কাছে।প্রতি ক্লাসেই দুয়েকজন এই ‘চলে আস’ শুনত এবং তারপর কী হত সে অবস্থা উপরে বর্ণিত।
আমরা গোটা সিক্সক্লাস এই স্যারের ভয়ে ভয়ে কাটালাম।আশা, সেভেনে উঠলে হয়ত ক্লাস পাবেনা।কিন্তু আশা মিলল না।
অতএব,আবার আরেকটি বছর।
স্কুল ছুটির পর নতুন ক্লাস।নতুন বই।
স্যার ডায়াসে।ক্লাস নিচ্ছেন।পড়াচ্ছেন।আর কিন্তু কেউ মার খেল না।এরকম অনেকদিন কেটে গেল।কেউ মার খায়নি।আমরা জানতে পারলাম স্যারের ছোট মেয়েটি গ্রামে পানিতে ডুবে মারা গেছে সম্প্রতি।
স্যার আসতেন,শান্ত ভঙ্গিতে পড়াতেন,পড়াতে পড়াতে উদাস হয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবতেন।