প্রথম সন্তানের পর চার বছরের মাথায় দ্বিতীয় সন্তান হল রুহির।
পরপর দুই ছেলে সন্তানের জননী হয়েও রুহির মনে একফোঁটা শান্তি নেই।ছোটটি দেখতে শুনতে ফর্সা,বাপের রঙই পেয়েছে।কিন্তু ও যখন একটু বড় হল কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে লাগল রুহি।কোলে নিলে কেমন ভ্যাবলার মত চেয়ে থাকে,মুখ দিয়ে লালা ঝরে ক্রমাগত,চোখের দৃষ্টি কেমন যেন।নেহাত ছোট বাচ্চা,বড় হতে হতে ঠিক হয়ে যাবে-আশেপাশের লোকজন তাই বলল।বলাবাহুল্য,এসব সূক্ষ্ণ ব্যাপারগুলি কেবল মায়েদের চোখেই পড়ে।
-আম্মা,ভাত!
চমকে উঠে রুহি।রান্নাঘরে পিঁড়িতে বসে মাছ কুটছিল।ছোট ছোট মাছগুলো কোটা যে কি ঝামেলা। হাত দিয়ে কপালের চুল গুলো সরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো রুহি।সোহান দাঁড়িয়ে আছে চৌকাঠে।ও কথা বলছে মায়ের সাথে,কিন্তু দৃষ্টি ছাদে।মুখ হাঁ।মাঝেমাঝেই নিজের ছোটছেলের এই দশা দেখে রুহির বুকের ভিতরটা কান্নায় ভরে উঠে।
'আয়'- বলে মাছধরা হাতেই ছেলেকে বুকে টেনে নেয়।শাড়ি দিয়ে ছেলের মুখের লালা মুছে দেয়। ছেলে মায়ের কোলে থেকেও কেমন দিশেহারা দিশেহারা ভাব
'ভাত খাব,আম্মা!'
'ভাত হচ্ছে বাবা,একটু আগে না কলা দিলাম?'
সে কথা সোহানের কানে যায় না যেন।তাকে যেন ভাতই খেতে হবে।এরকমই করে ও।এত খিদে ওর ঐ ছোট্ট পেটটিতে কোত্থেকে যে আসে,মা হয়েও মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে পড়ে রুহি।
বাজারে গিয়েছিল রুহি।দুই ছেলেকে ঘরে রেখে।ওদের বাবা বিদেশ থাকেন।বছরে আসেন দুয়েকবার।
বড়সড় থলি হাতে দরজার কাছে আসতেই কানে আসল তারস্বরে কান্না।
রুহান দরজা খুলে দিল।পাশে দাঁড়িয়ে সোহান কাঁদছে।মাকে দেখতে পেয়ে যেন কান্নার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল।
'আমাকে মারছে।আম্মা!'-কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বড় ভাইয়ের প্রতি সমস্ত রাগ অভিযোগ রুহিকে বর্ণণা করল।
'ওকে মারলা কেন,রুহান?'
'আমার সব বইয়ে পানি ফেলে ভিজিয়ে দিছে ও'
রুহান কে কিছু বলল না আর,সোহান কে টানতে টানতে নিয়ে গেল ভিতরে।চোখের পানি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিল।তারপর,ব্যাগ থেকে একটা মিমির প্যাকেট বের করে দিল ছেলেকে।চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলল সোহান।মিমির প্যাকেট খোলার চেষ্টা করছে মনোযোগ দিয়ে।ছেলেটার হাঁটুর দিকে নজর দিল রুহি।ফুলে আছে।এটা খারাপ অসুখ।রুহির এক আত্নীয় বড় ডাক্তার।বলেছে,রেয়ার ডিজিস।আরো কত কিছু বলেছে।সবকথা সহ্য হয় নি রুহির।
###
সেদিন মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি রুহি।সোহান কে সবার সামনেই বেদম মারতে শুরু করল।
'আর পারি না আমি এই ছেলেকে নিয়ে।কথা বলতে পারেনা,হাঁটতে পারে না।সারাদিন খাই আর খাই'- বলতে বলতে মারল সোহানকে।একসময় নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল।বসে রইল চুপচাপ।
দুইছেলেকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিল বড়খালার বাসায়।দুপুরে সেখানে খেতে গিয়েই সোহান বায়না ধরল,তাকে আরো মাংস দিতে হবে।সে কথা অনেক লজ্জা করে বলেছিল রুহি।তারপর,ছেলের প্লেটে আরো তিন-চার টুকরা মাংস দিয়ে বসিয়ে দিল খেতে। সেই মাংস খাবার পর আবার ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল।গৃহস্থ রীতিমত বিরক্ত,রুহি জানে। প্রথমে হালকা বকা দিল,তারপর একটু কড়াভাবে শাসন।বোঝাল অনেক।সোহান গিয়ে তার খাবার জায়গায় বসে জোরে হাত নাড়িয়ে দিল,ব্যস,প্লেট আর গ্লাস টেবিল থেকে তৎক্ষণাৎ পড়ে গিয়ে এই দৃশ্যের সূচনা।
'আর পারিনা আমি এই ছেলেকে নিয়ে,আল্লাহ!আমাকে মুক্তি দাও'
ছেলেকে মারার পর নিশ্চয়ই খারাপ লেগেছিল রুহির।কষ্ট তার নিজের জন্য নয়,নিজের পেটের সন্তানের কষ্টই সে সহ্য করতে পারছে না আর। সেই খারাপ লাগা প্রকাশ করতে পারেনি। এই কষ্ট থেকেই হয়ত মুক্তি খোঁজে।
মুক্তি পেয়েছে একসময় রুহি। তের বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিল সোহান।ডাক্তার আগেই বলেছিল এই ছেলে বেশিদিন বাঁচবে না।
গরুর মাংস,কলা কিংবা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত দেখে সবার অলক্ষ্যে এখনো কাঁদে রুহি।সোহানের খুব প্রিয় ছিল।
(সমাপ্ত)